‘দুদক এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি’
প্রকাশিত : ১২:২৫ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৩৪ পিএম, ২৪ নভেম্বর ২০১৭ শুক্রবার
২০০৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ রাষ্ট্রপতির সম্মতি পায়। এ আইনের মাধ্যমে দেশের দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ, সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টির দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর বর্তায়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২১ নভেম্বর একজন চেয়ারম্যান ও দুইজন কমিশনারের যোগদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে।
দুদক গঠিত হওয়ার পর প্রথম আড়াই বছর অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে ওয়ান-ইলেভেন (২০০৭-২০০৮ সালে) সরকারের সময় হঠাৎ করেই সংস্থাটি আলোচনায় চলে আসে। তখন নানা কারণেই দুদকের কর্মকাণ্ড তখন নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এরপর ফের ভাটা পড়ে দুদকের অগ্রযাত্রায়। সময়ের পরিক্রমায় আর দুদক হয়ে পড়ে কার্যত ‘নখ দন্তহীন বাঘ’। মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতা, বিত্তশালী-ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময়ক্ষেপনসহ নানা কারণে দুদককে নিয়ে অনাস্থা তৈরি হচ্ছিল জনমনে।
তবে সময়ের পরিক্রমায় বাস্তবতা উপলব্ধি করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দুদক। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তাদের কিছু সাহসী পদক্ষেপ মানুষের নজর কেড়েছে। প্রতিষ্ঠার এক যুগ পরে হলেও মানুষের আস্থায় জায়গায় পৌছাতে কাজ করছে দুদক। দুদক কর্মকর্তারা মনে করেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল কার্যক্রম তাদেরই কৃতিত্ব। এছাড়া হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি ও এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার মামলা দুদকের বড় সাফল্য। পদ্মাসেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলায় সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে তারা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সালে দুদকে অভিযোগ প্রাপ্তি প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালের শুরুতেই দুদক থেকে বলা হয়েছিল ২০১৭ সাল হবে ঘুষগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের আতঙ্কের বছর। কথা রেখেছে দুদক। গত সোমবার পর্যন্ত ২৩টি ফাঁদ মামলা পরিচালনা করে বেশ কয়েকজন ঘুষখোর কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বোপরি দুদকের বহুমুখী পদক্ষেপের কারণেই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এমনটাই মনে করছে দুদক।
মঙ্গলবার দুদক-এর ত্রয়োদশ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটির পথচলা, সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সামনের দিনগুলোতে পরিকল্পনা নিয়ে একুশে টিভি (ইটিভি) অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিনের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : ত্রয়োদশ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দুদক বড় দুর্নীতিবাজদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি’। কেন পারেনি? প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন, আমরা আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তবে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। তাছাড়া এত স্বল্প সময়ে এককভাবে দেশকে পুরোপুরি দুর্নীতি মুক্ত করা সম্ভব নয়। এ জন্য সম্মিলিতভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। তবেই দেশকে পুরোপুরি দুর্নীতি মুক্ত করা যাবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : কেন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি? বাধাটা কোথায়?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : বাধাটা হচ্ছে, আমাদের সামর্থ্যের অভাব, সক্ষমতার অভাব। পাশাপাশি জনশক্তি ও প্রযুক্তির অভাবও রয়েছে। এফবিআই যেভাবে একটি কাজে ঝাপিয়ে পড়তে পারে, আমরা সেভাবে পারি না। ষোল/সতের কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৮০০ লোক নিয়ে দুদক গঠিত হয়েছে। এখানে ইনভেস্টিগেটর আছে মাত্র ৩০০ জন। তাছাড়া এখানে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন লোকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ফলে আমাদের ইচ্ছা থাকার পরও অনেক কিছু করতে পারছি না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৩ বছরের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। এ কারণে মানুষ কখনোই শতভাগ সফল হতে পারে না। কেউ যদি মনে করেন, তিনি শতভাগ সফলতা অর্জন করেছেন, তাহলে তার সামনে এগানোর পথ বন্ধ হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে তাগিদ থাকতে হবে, তাকে আরো এগিয়ে যেতে হবে। তার এখনো অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। তাহলেই তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবেন। এত কথা বলার অর্থ হল, দুদক-কে আরো এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য যত বাঁধা আসুক, তা অতিক্রম করতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা হলেও দুদক মানুষের আস্থার জায়গায় এসেছে। কিন্তু একসময় অনেকেই দুদক-কে দন্তহীন বাঘ বলত। আস্থার জায়গায় আসতে এত বছর লাগল কেন?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : ওই যে বললাম, সামর্থ্যের অভাব। আমাদের চেষ্টা ছিল, কিন্তু উপায় ছিল না। এখানে একটা বিষয় কিন্তু প্রমাণিত। এক সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষে ছিল। কিন্তু এখন আমাদের সে কলঙ্ক নেই। আবার টিআই-এর জরিপে আমরা দুই ধাপ এগিয়েছে। আমাদের অবস্থান যে খুব ভালো হয়েছে, তাও নয়। এখন আমাদের স্কোর ২৬। অন্যদিকে ভুটানের ৬৫, ভারতের ৩৫। আমরা যখন বাইরে যাই, তখন আমরা যত ভালো কথাই বলি না কেন, মানুষ কিন্তু আমাদের একটা জায়গায় আইডেন্টিফাই করছে। তারা বলার সুযোগ পাচ্ছে, এ দেশে সুশাসন ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। যখন আমরা আমাদের দেশের কথাগুলো তুলে ধরতে চাই, তখন তারা (সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের মানুষ) ভুটানের কথা যতটা মনোযোগ দিয়ে শুনে, আমাদের কথাকে ততটা গুরুত্ব দেয় না। বিষয়টি আমাদের জন্য সত্যিই বেদনাদায়ক। দুদক দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করে এ কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে কাজ করে যাচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : অভিযোগ আছে, দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগুলো উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা করে থাকেন। এ বিষয়ে আপনার কী অভিমত?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা নয়। সরকারি কর্মকর্তারা যদি ত্যাগী ও দায়িত্ববান হন, তাহলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে। প্রত্যেককে দেশের কল্যানের কথা ভেবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা উচিত। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া আবশ্যক বলে মনে করছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : বর্তমান সরকার দুর্নীতি দমনে কতটুকু সফল বলে মনে করছেন?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : এক সময় আমাদের অবস্থা খুব বাজে ছিল। পরপর পাঁচবার আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষে ছিলাম। এ অবস্থান থেকে আমরা কিছুটা হলেও সরে আসতে পেরেছি। বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেশের বাইরে কাজ করছেন। তারা যেন বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, আমরা আত্মমর্যাদাশীল জাতি- এ লক্ষ্য অর্জনেই দুদক কাজ করে যাচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : `আমলাতান্ত্রিক জটিলতা` আমাদের দেশে খুব পরিচিত একটি শব্দ। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : হ্যাঁ। এরকম একটা অনুযোগ রয়েছে। দুর্নীতিবাজরা শব্দটা ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। মূলত যে নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, কেবল তিনিই আমলাতন্ত্রের উপর দোষ চাপান। চোর যেখানে যাক চুরি করবেই। আসল বিষয় হচ্ছে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : দুদক কী রাজনৈতিক চাপ অস্বীকার করতে পারে?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : দুদক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে কোনো রাজনৈতিক চাপ আসার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে আমাদের হয়তো সামান্য সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এর জন্য আমাদের দক্ষ জনবল বা প্রযুক্তিগত সমস্যাও দায়ী বলে মনে করছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : দুদকের মামলা সংক্রান্ত কার্যক্রম প্রসঙ্গে বলুন।
ড. মো. শামসুল আরেফিন : এ বছরের ১৭ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ছিল ২,৭১৫টি। চলমান মামলা ২,৩৮২টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলা স্থগিত হয়েছে ৩৩৩টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৭৪টি । সাজা হয়েছে ১১৫টির। খালাস পেয়েছে ৫৯টি। সাজার হার ৬৬.০৯%। সব মিলিয়ে বলা যায় মানুষ আমাদের কাছে এসে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আগামী প্রজন্ম যেন দুর্নীতিতে উৎসাহী না হয় সেক্ষেত্রে দুদক কী কোনো ভূমিকা রাখছে?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : হ্যাঁ, ভালো কথা বলেছেন। দুদক সততা চর্চার জন্য কমিটি করেছে। দুদক-এর উদ্যেগে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্কুলে সততা স্টোর হচ্ছে। স্টোরগুলোতে কোনো দোকানদার থাকে না। ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট বাক্সে টাকা দিয়ে মালামাল নিয়ে যায়। আস্তে আস্তে এভাবে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক সময় আমরা থাকব না। কিন্তু শিক্ষর্থীদের যদি সততায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে তারা একদিন সুশাসন কায়েম করবে। আমরাও সমৃদ্ধশালী একটি দেশ পাবো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনার কী কখনো মনে হয়, দুর্নীতির জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও দায়ী রয়েছে?
ড. মো. শামসুল আরেফিন : আগে বলা হতো শিক্ষা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ কম। ধীরে ধীরে অংশগ্রহন বাড়ল। তারপর বলা হলো, শিক্ষার অনুকূলে শতভাগ পরিবেশ চাই। তারপর বলা হলো, সেটাও ঠিক আছে; কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নেই। এরপর মানসম্পন্ন শিক্ষার উদ্যেগ নেওয়া হলো। এখন বলা হচ্ছে মূল্যবোধনির্ভর শিক্ষা দরকার। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু অপরাধ-দুর্নীতি কমছে না। সবাই স্যুটেড হয়ে, টাই পরে, এসি রুমে বসেই দুর্নীতি করছে। প্রকৃতপক্ষে দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও সচেতনতাবোধ বাড়াতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য আপানাকে ধন্যবাদ।
ড. মো. শামসুল আরেফিন : একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জন্য শুভকামনা। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে হলে গণমাধ্যমের ভূমিকার বিকল্প নেই।
‘‘ড. মো. শামসুল আরেফিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে বিসিএস ক্যাডার (প্রশাসন) হিসেবে সরকারি চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত ২১ আগষ্ট তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব হিসেবে নিয়োগ পান ‘’
//ডিডি// এআর