ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

বৃষ্টিভেজা রাতারগুল

প্রকাশিত : ১২:৩০ পিএম, ২৪ নভেম্বর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ২৪ নভেম্বর ২০১৭ শুক্রবার

প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় ও সেতুবন্ধন তৈরির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভ্রমণ। ভ্রমণ মানেই প্রশান্তি। ভ্রমণ মানেই আনন্দ। তাইতো যখনই সময় পাই, প্রকৃতির কাছে ছুটে যাই। কারণ প্রকৃতি আমাদের বেঁচে থাকার প্ররণা যোগায়। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য লাভের আশায় আমিও মাঝে মাঝে ব্যাকুল হয়ে উঠি। অনেকদিন ধরে আমাদের পরিকল্পনায় ছিলো সিলেট ভ্রমণ। এর আগেও সিলেটে ভ্রমণ করেছি। তবে সেটা ছিলো ঝটিকা সফর। শুনেছি বৃষ্টিতে সিলেট নাকি অন্য রূপে সাজে। তাই বৃষ্টির দিনেই সিলেট রওনা হলাম।

জাফলং, জৈন্তিয়া পাহাড়, ভোলাগঞ্জের সারি সারি পাথরের স্তুপ, বিছানাকান্দি, লালা খাল, হযরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজারসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য স্পট রয়েছে। তবে আজ আমি পাঠকদের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র একটি স্পট নিয়েই আলোচনা করবো। আর সেটি হচ্ছে বাংলার আমাজান খ্যাত ‘রাতারগুল’।

তিন দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য ছিলো ‘রাতারগুল’। নিয়ম অনুযায়ী আমরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কিন্তু তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। হোটেলের জানালা থেকে বাইরের রাস্তা দেখা যায়। আমাদের গাড়ি ইতিমধ্যে চলে এসেছে। তবে বৃষ্টির কারণে কেউই নামতে চাইছে না। সকাল ৭টায় বৃষ্টি কিছুটা কমলে আমরা হোটেল থেকে বের হই। পাশের একটি হোটেলে সকালের নাস্তা শেষ করে গাড়িতে উঠি। আমাদের গন্তব্য ‘রাতারগুল’।

বর্ষায় বাংলার আমাজান নামে পরিচিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল আমাদের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। রাতারগুল আমাদের দেশের একমাত্র ‘ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট’ বা জলাবন। সিলেট থেকে দেশের একমাত্র স্বীকৃত এই সোয়াম্প ফরেস্টের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এ জলাবনের অবস্থান।

উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর; মাঝখানে ‘জলাবন’ রাতারগুল। উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে এর দুটি। একটা শ্রীলংকায়, আরেকটা আমাদের রাতারগুলে।

অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র আমাজনের। রেইন ফরেস্ট নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদুপানির সবচাইতে বড় সোয়াম্প বন কিন্তু এটিই।

সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই মুর্তা অথবা রাতাগাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। আমাজনের মতোই এখানকার গাছগাছালির বেশির ভাগ অংশ বছরে চার থেকে সাত মাস পানির নিচে থাকে। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখানকার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে পানি পুরো রাতারগুল জলাবনকে প্লাবিত করে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে (মে-সেপ্টেম্বর)। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই। যেন পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙ্গা। আর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়েচলা মেঠোপথ। তখন জলজ প্রাণীকুলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বড় বড় ডোবাগুলোতে।

বর্ষায় বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। এ সময় কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলোর আবার শরীরের অর্ধেকই জলে তলিয়ে যায়। এ সময় কোথাও চোখে পড়ে জেলেরা মাছ ধরছে। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগে পুরো বনটা। মাঝে মধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দেয় পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে পথ চলতে হয়। তবে বর্ষায় এ বনে চলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর।

বনবিভাগের তথ্যমতে- এই বনের আয়তন তিন হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে জল-সহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের পানি সহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে নির্বিষ গুইসাপ, জলঢোড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ গাছের ওপর উঠে পড়ে।

বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরো অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এ বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝেমধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পাখি। শুকনো মৌসুমে ডিঙ্গি নিয়ে ভেতরে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আপনাকে উড়ে সরে গিয়ে পথ করে দেবে। এ দৃশ্য আসলেই দুর্লভ!

গাছের মধ্যে এখানে করচ-ই বেশি। হিজলে ফল ধরে আছে শ`য়ে শ`য়ে। বটও চোখে পড়বে মাঝে মধ্যে। আর বনের দক্ষিণে মুর্তা (পাটি) গাছের প্রাধান্য। রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। এ ছাড়া ওদিকে শিমুল বিল হাওর আর নেওয়া বিল হাওর নামে দুটো বড় হাওর আছে।

বর্ষায় হাওরের স্বচ্ছ পানির নিচে ডুবে থাকা গাছগুলো দেখার অভিজ্ঞতা অপূর্ব। শীতকালে আবার বনের ভিন্নরূপ। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে মূর্তা ও জালি বেতের বাগান। সে সৌন্দর্য আবার অন্য রকম! বন এভাবে জলে ডুবে থাকে বছরে চার থেকে সাত মাস। বর্ষা কাটলেই দেখা যাবে অন্য চেহারা। তখন বনের ভেতরের ছোট নালাগুলো পরিণত হবে পায়ে চলা পথে। সেই পথ দিয়ে হেঁটে অনায়াসে ঘুরে বেড়ানো যায়।

রাতারগুল বনে ঢুকতে হয় ডিঙি নৌকায় চেপে। নৌকা একবার বনে ঢুকলেই আর কথা নেই!  দুটি মাত্র শব্দ লাগবে আপনার ভাব প্রকাশের জন্য। আপনি হয়তো বলে উঠবেন- ‘আমি মুগ্ধ’! আর বোনাস হিসেবে পাবেন গোয়াইন নদী দিয়ে রাতারগুল যাওয়ার অসাধারণ সুন্দর পথ। এ ছাড়া নদীর চারপাশের দৃশ্যের সঙ্গে দেখবেন দূরে ভারতের মিজোরামের উঁচু সবুজ পাহাড়।

এতো গেলো রাতারগুলের বর্ণনা। এখন আলোচনা করবো আমাদের ভ্রমণ নিয়ে। আমরা সিলেটের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে কখন যে রাতারগুলে এসে পৌঁছেছি, তা বুঝতেই পারলাম না। আমরা যখন স্পটে এসে পৌঁছেছি, তখন বৃষ্টি ছিলো না। এসে দেখি অনেক পর্যটক এসেছে। বিদেশিরাও আছেন তাদের মধ্যে। দেখে মনে হলো, রাতারগুল ইতিমধ্যে বিদেশি পর্যটকদের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠেছে। যা হোক, রাতারগুল বনের মধ্যে প্রবেশ করতে হলে নৌকা নিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দারাই নৌকা ভাড়া দেন। ভাড়া একটু বেশি। তবে এতো দূরে খরচ করে এসে ভাড়ার কথা চিন্তা করলে হবে না।

বৃষ্টির ভরা মৌসুমে রাতারগুল পানিতে টইটুম্বুর। হাওরের অথৈই পানি দেখে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ে নৌকাতে উঠতে চাইলো না। আমরা দুটি নৌকা নিয়ে রওনা হলাম। এখানে বাচ্চারাও নৌকা চালায়। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসরে তারা নৌকা ভাড়া দিয়ে আয় করে।আমাদের নৌকা যখন হাওরের মাঝখানে, ঠিক তখন আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। বুঝতে বাকি নাই যে বৃষ্টি হবে। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু। আমাদের মত অনেকেই রওনা হয়েছে রাতারগুলের উদ্দেশ্যে। কারও কারও কাছে ছাতা ছিলো বলে রক্ষা। তবে আমাদের কাছে কোন ছাতা ছিলো না। তাই স্থির করলাম বৃষ্টিতে ভিজেই ‘রাতারগুল’ দেখবো। ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে হাওরের জলে নৌকার উপর গলা ছেড়ে গান ধরলেন আমাদেরই এক বন্ধু। আমাদের নৌকার মাঝি ছিলো ছোট ছোট দুটি ছেলে। ওরাও গান ধরলো। আমরা প্রবেশ করলাম রাতারগুলে। আহা, কি রূপ! চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না- এই যে আমাদের বাংলাদেশ। সত্যি বাংলার রূপ পৃথিবীর সব রূপের চেয়ে সেরা। অনেকটা সময় আমরা নৌকায় করে বনের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।এরপর উঠলাম ওয়াচ টাওয়ারে। সেখানে উঠে পুরো রাতারগুলের ভিউটা চমৎকারভাবে দেখা যায়। বৃষ্টি ভেজা রাতারগুল সত্যি চমৎকার। আমরা প্রায় দুই ঘন্টা ছিলাম। এরপর আবারও নৌকায় করে ফিরে আসলাম গড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম সিলেট শহরের উদ্দেশ্যে। চমৎকার একটি দিন কাটিয়ে গেলাম রাতরগুলে আর হৃদয়টা রেখে গেলাম হাওরের জলে।

যেভাবে যেতে হবে
রাতারগুল যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে। তবে যেভাবেই যান, যেতে হবে সিলেট থেকেই।
প্রথম উপায়- সিলেট থেকে জাফলং-তামাবিল রোডে সারিঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ভাড়া ৯০০-১৫০০ এর মধ্যে (আসা-যাওয়া), আর সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘণ্টাপ্রতি লাগবে ৫০০-৮০০ টাকা।
দ্বিতীয় উপায় হলো- সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌঁছানো, ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট-শালুটিকর হয়ে যাওয়া এ রাস্তাটা বর্ষাকালে খুবই সুন্দর। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ভাড়া ৮০০- ১৫০০ টাকার মধ্যে (আসা-যাওয়া), আর সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে মাঝি ঘণ্টাপ্রতি নেবে ৪০০-৫০০ টাকা।
আরো একটি উপায়ে আপনি পৌঁছাতে পারেন রাতারগুল। সেটা হচ্ছে সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মোটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌঁছাতে হবে। ভাড়া নেবে ২০০-৩০০ টাকা, আর সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। এরপর মোটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়। এতে ঘণ্টাপ্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা লাগবে। এই তৃতীয় পথটিতেই সময় ও খরচ সবচেয়ে কম।

কিছু সতর্কতা
রাতারগুল বা তার আশপাশে খাবারের হোটেল বা থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই খাবার গোয়াইনঘাট বা সিলেট থেকে নিয়ে যেতে পারেন। আরেকটা বিষয়, নৌকায় করে বেড়ানোর সময় পানিতে হাত না দেয়াই ভালো। জোঁকসহ বিভিন্ন পোকামাকড় তো আছেই, বর্ষায় বিষাক্ত সাপও পানিতে বা গাছে দেখতে পাওয়া যায়। সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখা জরুরি। এ ছাড়া ছাতা, বর্ষাতি কিংবা রোদ টুপিও সঙ্গে নিতে হবে। এখানে বেড়ানোর নৌকাগুলো অনেক ছোট। এক নৌকায় পাঁচজনের বেশি উঠবেন না।


ছবি : জুলফিকার হুসাইন সোহাগ

এসএ/ডিডি/