এক মাসেই এসিআই এগ্রোলিংকের টার্নওভার ৩০০ কোটি টাকা : ড. আনসারী
প্রকাশিত : ০৭:৩৪ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ০১:৪৭ পিএম, ২ ডিসেম্বর ২০১৭ শনিবার
কৃষিকাজ এখন আর ক্ষেত-খামারে সীমাবদ্ধ নেই। চাষাবাদের বিষয়টি এখন অনেকটা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে শহর এখন আর শুধু ইট-পাথরের দালান-কোঠা নয়। সবুজ চাদরে ঢেকে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় নগরী। আর এসব কিছুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেড। ইটিভি অনলাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ‘সবুজ ঢাকা’ পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় এসব কথা বলেন এডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি বা এসিআই’র সহযোগি প্রতিষ্ঠান এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেড, এসিআই মটরস এবং প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এফ.এইচ. আনসারী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের সহ-সম্পাদক সোলায়মান শাওন।
ইটিভি অনলাইন : ‘সবুজ ঢাকা’ আপনাদের একটি অন্যতম সফল ক্যাম্পেইন। বর্তমানে কেমন চলছে এর কার্যক্রম?
ড. আনসারী : ‘সবুজ ঢাকা’র প্রস্তাবনাটা আসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে। তবে তা শুধু প্রস্তাবনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের এসিআই এগ্রোলিংকের পক্ষ থেকে পরবর্তী কাজগুলো করা হয়। আমরা হিসেব করে দেখলাম, ঢাকা শহরে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার বহুতল ভবন আছে। আমরা পরিকল্পনা করলাম, এই বাড়িগুলোর ছাদে একটি করে বাগান করার। এ লক্ষ্যে আমরা বাড়ি বা ভবন মালিকদের সঙ্গে কথা বলি। আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, এই ক্যাম্পেইনে এখন আমাদের প্রায় ১ লাখ সদস্য যুক্ত আছেন।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভবনের ছাদে ইতোমধ্যে বাগান করা হয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা আসলেই ‘সবুজ ঢাকা’ হবে। উপর থেকে দেখলে শুধু সবুজ আর সবুজ দেখা যাবে। এমনকি ঢাকা শহরের প্রতিদিনের তাপমাত্রা চার থেকে পাঁচ ডিগ্রী কমে যাবে।
ইটিভি অনলাইন : শুধু কী ছাদেই এমন বাগান করা সম্ভব? নাকি বারান্দায়ও করা যায়?
ড. আনসারি : এ ধরনের বাগান শুধু ছাদেই নয়, বাসার বারান্দাতেও করা সম্ভব। এমনকি বাসার ভেতরেও করা যায়। আমাদের দেশের আবহাওয়া বৃক্ষবান্ধব। এ দেশে অনেক গাছ আছে, যা বিভিন্ন আবহাওয়ায় জন্মায় ও বেড়ে ওঠে। কিছু গাছ আছে যেগুলো আমাদের বাসার রুমের ভেতরেও জন্মায়। আমাদের এসিআই এগ্রোলিংকের পক্ষ থেকে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করব। এতে কোন ঋতুতে, কোন কোন পরিবেশে কী কী গাছ জন্মায় তার পূর্ণ বিবরণ থাকবে। এমনকি কোন ধরনের গাছের জন্য কোন ধরনের মাটি ও সার উত্তম তারও তথ্য দেওয়া থাকবে।
আমি একটি উদাহরণ দিই, সিঙ্গাপুর শহরে কিন্তু এখন কোনো খালি জায়গা নেই। চাষাবাদ বা বাগান করার মতোও একটু জায়গা সেখানে নেই। কিন্তু ওই দেশে বিভিন্ন বহুতল বাড়িতে মাল্টি লেয়ারে বাগান করা হয়েছে। বাড়ির বারান্দায় ও ছাদে বাগান করে কিন্তু তারা ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে।
ইটিভি অনলাইন : এসব বাগান বা গাছ থেকে পোকা-মাকড় বা কীটপতঙ্গের উপদ্রবের একটা ঝুঁকি থাকে। এর জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যায়?
ড. আনসারী : এর জন্য ফেন্স নেট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাগানের চারপাশ ফেন্স নেট দিয়ে ঢেকে দিলে এ ধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এক ধরনের নেট হাউস এর মতো করা যেতে পারে।
ইটিভি অনলাইন : বীজ সংগ্রহ থেকে শুরু করে মাটি তৈরি, গাছের চারা লাগানো থেকে এর পরিচর্যা- এতকিছু করা একজন শহুরে মানুষের পক্ষে অনেক সময়ই কঠিন। তাহলে সহজে কীভাবে এই বাগান করবে?
ড. আনসারী : এটা একটা বড় সমস্যা। তবে এর জন্য আমাদের এসিআই এগ্রোলিংকের পক্ষ থেকে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার সুযোগ আছে। আমাদের সবকিছুই করা হয় অনলাইনে। আমাদেরকে শুধু একটি ফোন দিলে সবকিছু ব্যবস্থা করে ওই ব্যক্তির কাছে দিয়ে আসা হয়। গাছের চারা, তার জন্য উপযুক্ত ধরনের মাটি এবং সার থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক যা যা লাগে, সবই আমাদের অনলাইনে পাওয়া যাবে।
এমনকি গাছ লাগানোর টবও পাওয়া যাবে আমাদের কাছে। আর এসব কিছু বাজারের দাম থেকে অনেক কমে পাওয়া যাবে। আবার কেউ হয়তো এগুলো বাজার থেকে কিনে আনল, কিন্তু বাড়িতে নিয়ে আসা তার জন্য কঠিন। আমরা সেই সেবাও দিয়ে থাকি। আপনার যা যা দরকার, তার সবই আমরা বাসায় পৌঁছে দেব। এমনকি কেউ চাইলে তার বাগান সেটআপ করেও দিয়ে আসবো। এক কথায় ‘কমপ্লিট সল্যুশন’ বা এক জায়গা থেকেই সবকিছুর সমাধান পাবেন।
ইটিভি অনলাইন : এ ধরনের বাগান করা কোনো ব্যক্তি যদি কয়েকদিন বাসার বাইরে থাকেন তাহলে সে বাগানের পরিচর্যা কীভাবে হবে?
ড. আনসারী : আমরা এ বিষয়েও চিন্তা করেছি। এর সমাধানের রাস্তাও বের করেছি। বাগান পরিচর্যায় আমরা যেটা দেখেছি, কোনো ব্যক্তি বাসা বা ওই বাগান থেকে কয়েকদিনের জন্য দূরে থাকলে তিনি যদি একবার পর্যাপ্ত পরিমাণে কীটপতঙ্গ তাড়ানোর স্প্রে করে যান, তাহলে নিয়মিত পানি দেয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এর জন্য আমরা একটি অটোমেটেড ওয়াটার ড্রপিং সিস্টেম তৈরি করেছি। এটি আপনার বাগানের সঙ্গে ইনস্টল করে নিলে আপনি না থাকলেও যতটুকু পানি প্রতিদিন দেয়া দরকার তা সেটি নিজ থেকেই দেবে। তাই ঘরের বাইরে থাকলেও বাগানের কোনো সমস্যা হবে না।
ইটিভি অনলাইন : অনেকেই মনে করেন ছাদে বা বারান্দায় বাগান করা ব্যয়বহুল। আসলেই কী তাই?
ড. আনসারী : অনেকেই আসলে এমনটা মনে করে থাকেন। কিন্তু প্রজেক্টটি খুবই কম খরচে করা যায়। প্রায় ৫০০ বর্গফুট বা ১ ডিসিমেল জায়গায় অনেক কম খরচে অনেক সুন্দর এবং পরিকল্পিত বাগান করা সম্ভব। বিভিন্ন নার্সারি থেকে চারা বা আনুষাঙ্গিক জিনিস কিনতে গেলে অনেক সময় দাম বেশি লাগে। এখানে আবারও আমাদের এসিআই এগ্রোলিংকের কথা বলতে চাই। আমাদের কাছে এ জিনিসগুলো অনেক কম দামে পাওয়া যাবে। ব্যবসায়িক ভাষায় বললে, এ ধরনের বাগান করা খুবই ইকোনমিক। যারা এ ধরনের বাগান করতে আগ্রহী তারা সবসময় আমাদের থেকে পরামর্শ নিতে পারেন।
ইটিভি অনলাইন : কৃষিকাজ এবং প্রযুক্তি। এ দুটোকে আপনারা অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। এ ধরনের উদ্যোগে আপনারা আগ্রহী হলেন কীভাবে?
ড. আনসারী : আগে কৃষিকাজ বলতে শুধু মাঠে বা ক্ষেত-খামারে কাজ করা বুঝাত। এখনও কৃষিকাজ মাঠ আর ক্ষেতেই করা হয়। তবে এখন তা অনেকটাই প্রযুক্তির আশীর্বাদ পুষ্ট। আগের মতো সচরাচর যন্ত্রপাতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের উন্নত প্রযুক্তি এবং কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘ক্রিয়েটিং ওয়েলথ ফর দ্য ফারমার্স’ বা কৃষকের জন্য সম্পদ তৈরি করাই হচ্ছে আমাদের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতেই আমরা কৃষিকাজের সঙ্গে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।
ইটিভি অনলাইন : একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। অনেক সময়ই অভিযোগ থাকে, কৃষকেরা তাদের ন্যায্য মূল্য পায় না। মধ্যসত্তাভোগীরাই বেশিরভাগ মুনাফা নিয়ে নেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. আনসারী : অনেক সময় এমনটা হয়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, অনেক সময় কৃষকেরা বেশি মূল্যও পান। যেমন গত মৌসুমে ধানের মূল্য কৃষকেরা কম পেয়েছেন, তবে এ বছর কিন্তু অনুমানের চেয়ে বেশি মূল্য পেয়েছেন। এটা বাজারের একটা দিক। কখনও বেশি তো কখনও কম। তবে আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। আর শুধু আমাদের দিক থেকে বললে, আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘স্বপ্ন’-তে আমরা কৃষকদের কাছ থেকে যেসব পণ্য সংগ্রহ করি, তার জন্য তাদেরকে যথাযথ মূল্যই দেয়া হয়। এ ব্যাপারে আমাদের ওপর কৃষকদের সন্তুষ্টি ও আস্থা আছে।
ইটিভি অনলাইন : কৃষি বিভাগে আপনাদের ব্যবসা ইতোমধ্যে সকলের প্রশংসা পেয়েছে। দেশের কৃষি সম্প্রসারণে নিজেদেরকে কতটুকু সফল মনে করেন?
ড. আনসারী : আমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- ‘এট দ্য এন্ড হ্যাপিনেস’। অর্থাৎ সবকিছুর পর আমরা সবার মাঝে আনন্দ দেখতে চাই। সেদিক থেকে বিচার করলে আমরা আমাদের লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি রয়েছি। আমরা এখন পর্যন্ত শতকরা ২০% কৃষকদের সেবা দিয়ে আসছি। আগামী ৩ বছরের মধ্যে তা শতকরা ৪০ ভাগ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অংকের হিসেবে যদি বলি, গত ১ মাসে আমরা কৃষি বিষয়ক লজিস্টিকে টার্নওভার করেছি ৩০০ কোটি টাকা। কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক টার্নওভার ৩১০ কোটি টাকার মতো। আমাদের সেখানে এক মাসেই ৩০০ কোটি টাকা। অবশ্যই এই ব্যাপারে নিজেদেরকে আমরা সফল মনে করি।
ইটিভি অনলাইন : আপনারা আর কী কী নতুন ব্যবসা চালু করতে যাচ্ছেন?
ড. আনসারী : আমরা এখন সবাইকে দুধ খাওয়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি (হাসতে হাসতে)। আমরা বিশ্বের সব থেকে বৃহৎ দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফনটেরা মিল্ক’ এর বাংলাদেশি ডিলারশিপ নিয়েছি। এছাড়া ‘এ্যাংকর মিল্ক পাউডার’ গুড়ো দুধ আমরা আবারও নতুন করে বাজারে ছাড়তে যাচ্ছি।
ইটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের কৃষি বিষয়ক কাজে আপনার প্রায় ৩৭ বছরের অভিজ্ঞতা। নতুন যারা এই বিভাগে কাজ করতে আগ্রহী তাদের জন্য আপনার উপদেশ কী থাকবে?
ড. আনসারী : আমার সুযোগ হয়েছে অনেক তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলার। আমি তরুণদের মধ্যে কৃষি বিষয়ক বিভাগে ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ দেখেছি। এ বিষয়টিকে ধরে রাখতে হবে।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের কৃষির বাজার ব্যাপক। এটাই আমাদের মূল পেশা। এখনও আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষিকাজ। পাশাপাশি আমাদের দেশের আবহাওয়াও কৃষি বান্ধব। তরুণদের জন্য সম্ভাবনাময়ী এক সেক্টর কৃষি। কৃষি মানেই যে লাঙ্গল হাতে নিয়ে জমিতে নেমে পরা, তা কিন্তু নয়। এখন উন্নত সব প্রযুক্তি বের হচ্ছে। আমাদের ভাষায় বললে, কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে নিলে, এটা খুবই ‘প্রফিটেবল’ সেক্টর। তরুণ প্রজন্মের অনেক কিছু করার আছে এখানে। একটা সাসটেইনেবল বিজনেস হতে পারে কৃষিখাত। আত্মস্বাবলম্বী হওয়ার দারুণ সুযোগ আছে এখানে।
একটা উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, বাড়ির ছাদেই খুব অল্প বিনিয়োগে ‘গ্রীন হাউস’ এর মতো প্রজেক্ট করা যায়। এতে খরচ যা লাগে, তা খুবই সামান্য। তবে এর থেকে একজন উদ্যোক্তা তার ক্যারিয়ার শুরু করতে পারেন। ধীরে ধীরে এটাকে বড় করা যাবে।
ইটিভি অনলাইন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ড. আনসারী : আপনাকেও ধন্যবাদ। আমাদের পাশে সবসময়ই একুশে টেলিভিশন পরিবারকে পেয়েছি। আপনাদের জন্য শুভকামনা রইল।
/ডিডি/