ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

স্বর্ণের বাজারে অস্থিরতা-পর্ব-১

এস এম আলমগীর

প্রকাশিত : ০৭:৩২ পিএম, ১ ডিসেম্বর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ০৫:৪৪ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার

দেশের স্বর্ণের বাজারে নয়ছয় অবস্থা চলছে। এখনও পর্যন্ত স্বর্ণ আমদানির কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি হয়নি। এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতারও অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে স্বর্ণের বাজার পুরোপুরি চোরাচালান নির্ভর হওয়ায় এ শিল্পকে ঘিরে বিশাল এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

জুয়েলারি মালিকরা যে যার মতো করে চালাচ্ছেন স্বর্ণের ব্যবসা। এ কারণে স্বর্ণের বাজারে প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের ঠকতে হচ্ছে। অথচ এ অনিয়ম দেখার কেউ নেই।

জানা গেছে, দেশে লক্ষাধিক স্বর্ণ ব্যবসার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সক্রিয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২০ হাজারের মতো। এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ২০ লাখ লোক জড়িত। দেশে বছরে প্রায় ৩৬ টন স্বর্ণের দরকার হয়। এর সিংহভাগ চোরাচালানের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। দেশে দৈনিক ২৫ কোটি টাকার স্বর্ণ লেনদেন হয়। সেই হিসাবে বছরে লেনদেন হয় ছয় হাজার কোটি টাকা। এত বড় খাতে সরকারের কার্যত নিয়ন্ত্রণ নেই। যেসব আইন আছে, তা প্রয়োগে ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, স্বর্ণের বাজারে শৃংখলা ফেরাতে হলে সবার আগে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা দরকার। এ জন্য আইন করতে হবে। আইন করার পাশাপাশি কর প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের মজুদ স্বর্ণের নিবন্ধনের সুযোগ দিতে হবে। ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানি করতে হবে। ব্যাগেজ রুল পরিবর্তন করে বিনা শুল্কে বছরে দুই বার সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম করে স্বর্ণ আনার সুযোগ রাখা যেতে পারে। শুল্ক কমিয়ে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে চোরাচালান বন্ধ হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সাবেক সভাপতি ডা. দিলিপ কুমার ইটিভি অনলাইনকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ নীতিমালা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্বর্ণ নীতিমালা পেলাম না। অনেক দেনদরবারের পর সরকার একটি খসড়া নীতিমালা করেছে, কিন্তু সেটি কবে চূড়ান্ত রূপ পাবে সেটি জানি না। আমি বিশ্বাস করি, স্বর্ণ নীতিমালা করা হলে এ বাজারে শৃংখলা ফিরে আসবে।

স্বর্ণের বাজারে নয়ছয়ের মূলে রয়েছে চোরাচালান। শুল্ক ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খুলে বৈধভাবে কোনো স্বর্ণ আমদানী হয় না। তারপরেও এত হাজার-হাজার দোকানে স্বর্ণের ব্যবসা চলছে কীভাবে? স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের ভেতরে মানুষ যেসব পুরনো স্বর্ণালংকার বিক্রি করে সেগুলো ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে একটা জোগান আসে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আসার সময় একজন যাত্রী শুল্ক ছাড়াই ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ আনতে পারেন। এগুলোই হাত বদল হয়ে জুয়েলারি দোকানে আসে। তবে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর কিংবা বিভিন্ন চোরাই পথে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আসছে। এর মধ্যে কিছু স্বর্ণ ধরা পড়ে শুল্ক কর্মকর্তাদের হাতে। ধরা পড়ার ফাঁকে পাচার হয়ে যায় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ। সূত্র জানায়, ধরা পড়া স্বর্ণের পরিমাণের চেয়ে পাচার হয়ে যাওয়া স্বর্ণের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের মধ্যবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ চোরাচালান রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তাই ঝুঁকি অনেক। শুল্ক গোয়েন্দারা যা আটক করছে তা মূল চোরাচালানের মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আর বাকি ৮০ শতাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের এক হিসাবে দেখা যায়, তিন বছরে তাদের অভিযানে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কেজি স্বর্ণ আটক হয়েছে। যার মূল্য প্রায় এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এ হিসাবে যে পরিমাণ স্বর্ণ পাচার হয়ে গেছে, তার অঙ্ক কয়েক হাজার কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, চোরাই পথে আনা এবং ডাকাতি- চুরি হওয়ার স্বর্ণগুলো জুয়েলারির মালিকরা কম দামে কিনে তাদের নিজস্ব কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যনতুন ডিজাইনের অলংকর তৈরী করে বিক্রি করে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, রাজধানীতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চোরাই স্বর্ণের বেচাকেনা হয়। এসব চোরাই স্বর্ণের সঙ্গে নামীদামী জুয়েলারির মালিক জড়িত। তবে উপর মহলে যোগাযোগ রক্ষা করে চলায় তারা যুগ যুগ ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।

তাঁতীবাজারে স্বর্ণের কারখানায় কাজ করেন (কারিগর) এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চোরাই পথে আনা স্বর্ণ দিয়েই অধিকাংশ কারখানা চলে। চোরাই পথে স্বর্ণের বারগুলো হাত ঘুরে চলে আসে ঢাকার নামীদামী জুয়েলারিতে। জুয়েলারি মালিকরা এসব স্বর্ণ তাদের কারখানায় কারিগর দিয়ে অলংকার তৈরি করে বিভিন্ন শো-রুম সাজিয়ে রেখে বিক্রি করেন। তারা জানান, পুরান ঢাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে, যারা লুণ্ঠিত স্বর্ণালংকার অল্প দামে কিনে সঙ্গে সঙ্গে তা গলিয়ে ফেলে। এতে করে এগুলোর মালিকানা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা করে পুরান ঢাকার অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ডাকাত দল, চোর ও ছিনতাইদের সঙ্গে এসব ব্যবসায়ীর নিবিড় সর্ম্পক রয়েছে । এদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকও আছেন। যারা প্রতিনিয়ত ভারত আসা-যাওয়া করেন বলে তারা জানান।

অভিযোগ রয়েছে, স্বর্ণ চোরাইকারবারি এবং জুয়েলারি মালিকদের সঙ্গে একশ্রেণির অসাধু শুল্ক কর্মকর্তারও যোগাযোগ রয়েছে। অসাধু শুল্ক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তারা স্বর্ণ পাচার থেকে শুরু করে সেগুলো দিয়ে অলংকার তৈরী করে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছে।

বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজার পুরোটাই অস্বচ্ছ। আর এ অস্বচ্ছতার জন্য শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষই দায়ী। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, স্বর্ণের বাজারে কাগজে-কলমে অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতা বেশি। যারা এগুলো দেখার দায়িত্বে আছেন তারাও বেশ স্পর্শকাতর। এই অস্বচ্ছতা, অষ্পষ্টতা দূর করার জন্য সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শুল্ক ও গোয়েন্দাদের অভিযান চালানো উচিত।

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশের স্বর্ণের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতের স্বর্ণালংকারের চাহিদা মেটাতেও দুবাই, মালয়েশিয়া, ওমান, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে সোনার বার আনা হয়। এসব বার পরে বেনাপোল স্থলবন্দর ও ভোমরা স্থলসীমান্ত দিয়েও পাচার করা হয়। চোরাচালান চক্রগুলোর মধ্যে দেশে অবস্থান করা চক্রগুলো সরাসরি জড়িত থেকে মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে, মানি চেঞ্জারের ব্যবসার আড়ালেও স্বর্ণ চোরাচালান করছে।

তাছাড়া প্রশ্ন রয়েছে উদ্ধার করা স্বর্ণের বিষয়েও। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে যে স্বর্ণ আটক করে সেগুলো ঢাকা কাস্টমস হাউজের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি জিরো নম্বরের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়। ঢাকা কাস্টমস হাউজ উদ্ধার করা ওই স্বর্ণের নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে। উদ্ধার করা স্বর্ণের মালিকানা দাবি করে, কেউ যদি ওই স্বর্ণ নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করে তাহলে তারা তা নিয়ে যেতে পারে। তবে কেউ যদি দাবি না করে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ওই স্বর্ণ নিলাম করে। এরপর বাংলাদেশে জুয়েলারি ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা ওই স্বর্ণ নিলামে কিনে বিক্রি করেন। আর নিলামে বিক্রি করা ওই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া হয়। তবে কি পরিমাণ স্বর্ণ নিলাম হয়, তার কোনো হিসাব নেই তাদের কাছে।

 

/ডিডি/