সালেহ নিহত হওয়ার নেপথ্যে
প্রকাশিত : ১০:২৯ এএম, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার
ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও আলোচনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। সংঘর্ষ আর বিভেদে পর্যুদস্ত রক্তাক্ত ইয়েমেন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ৮৬০০ লোক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। আর সৌদি জোটের অবরোধে দুর্ভিক্ষ কবলিত আছে কয়েক লাখ মানুষ। এক নজরে দেখা নেওয়া যাক- কার কার মধ্যে এই সংঘর্ষ হচ্ছে, কেন এই সংঘর্ষ? কেনই বা নিহত হলেন
২০১৫ সালের মার্চ থেকে গৃহযুদ্ধে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। হুতি বিদ্রোহীদের সৌদি এবং পশ্চিমা সমর্থিত প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি ও তার সরকারকে হঠানোর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনে সংঘর্ষ শুরু হয়। তবে মনসুর হাদি ও তার সরকার বাহিনী হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই আসছিল। সর্বশেষ হুতি বিদ্রোহীরা দেশটি দখল করে এবং নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এতে যোগ দেয়, ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর দল। এ দুই দলের সমন্বয়ে ইয়েমেনে কোয়ালিশন সরকার গড়ে ওঠে। কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন ইরান সমর্থিত শিয়াপন্থী হুতি বিদ্রোহীরা।
কিন্তু অতি সম্প্রতি হুতিদের সঙ্গে সালেহ সমর্থকদের বিরোধ তৈরি হয়। ইয়েমেনের সানাতে হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে ৭দিন ধরে সালেহপন্থীদের যুদ্ধ চলে আসছে বলে জানা গেছে। সালেহ সৌদি জোটের সঙ্গে আঁতাত করছে, এমন সন্দেহে সম্প্রতি এই কোয়ালিশন সরকারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এরইমধ্যে হুতি বিদ্রোহীরা সালেহকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে বলেন, তিনি ইয়েমেনের কোয়ালিশন সরকারের ভেতর ষড়যন্ত্র করছে। এর দুই দিন পরই বোমা হামলায় নিজ বাড়িতে নিহত হন ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ।
কীভাবে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ?
লড়াইয়ের সূচনা ২০১১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বিরোধ থেকে। বর্তমান সৌদি সমর্থিত সরকারের প্রেসিডেন্ট মি হাদি তখনকার প্রেসিডেন্ট মি সালেহ`র ডেপুটি ছিলেন। স্থিতিশীলতার স্বার্থে মীমাংসা অনুযায়ী মি সালেহ মি হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু দক্ষিণে আল কায়দার তৎপরতা থেকে শুরু করে বেকারত্ব এবং সালেহ`র প্রতি কিছু সেনা কর্মকর্তার অব্যাহত আনুগত্যের কারণে মি হাদি ক্ষমতা নিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করেন। সেই দুর্বলতার সুযোগ নেয় ইয়েমেনের সংখ্যালঘু জাইদি শিয়া মুসলিম মিলিশিয়া বাহিনী যারা হুতি নামে পরিচিত। তারা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় সাদা প্রদেশ এবং আশপাশের বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
হাদির সরকারের প্রতি বিরক্ত অনেক সুন্নিও সেসময় হুতিদের সমর্থন দেয়। এরপর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানায় ঢুকে পড়ে। ২০১৫`র জানুয়ারিতে তারা সানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং প্রেসিডেন্ট হাদি এবং তার সরকারের সদস্যদের কার্যত গৃহবন্দী করে ফেলে। প্রেসিডেন্ট হাদি পালিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী এডেনে পালিয়ে যান। এরপর সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহর সমর্থকদের সঙ্গে জোট বেঁধে হুতি মিলিশিয়ারা পুরো ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের মার্চে হাদি দেশ থেকে পালিয়ে যান।
হুতি বিদ্রোহীরা ইরানের সমর্থনে পরিচালিত হচ্ছে- এই আশঙ্কায় সৌদি আরবসহ সাতটি সুন্নি আরব দেশ হুতিদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে। অস্ত্র এবং গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে তাদের সমর্থন যোগায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স।
তখন যা হয়েছিল
২০১৫`র মার্চ থেকে চলতে থাকে লড়াই। তখন থেকে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তির তিন দফা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।
সৌদি বিমান হামলার ছত্রছায়ায় পলাতক প্রেসিডেন্ট হাদির অনুগত সৈন্যরা সুন্নি উপজাতীয় যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে এডেনের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সমর্থ হয়, কিন্তু দীর্ঘ সেই লড়াইতে শত শত লোকের মৃত্যু হয়।
সৌদি নেতৃত্বে কোয়ালিশনের স্থল সৈন্যরাও এডেনে এসে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এবং এখন পর্যন্ত এই বন্দর শহর এবং দেশের সিংহভাগ দক্ষিণাঞ্চল হুতিদের আওতামুক্ত রাখতে পেরেছে।
এডেনে প্রেসিডেন্ট হাদির সরকারও রয়েছে যদিও সেই সরকারের অধিকাংশ সদস্য দেশছাড়া।
সানা এখনও হুতিদের নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তায়েজও তাদের হাতে অবরুদ্ধ এবং মাঝেমধ্যেই তারা সৌদি আরবের ভেতরে মর্টার এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে।
নভেম্বরে রিয়াদ বিমানবন্দর লক্ষ্য করে একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর সৌদি আরব ইয়েমেনের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে।
যে কারণে বিদ্রোহীদের মধ্যে বিরোধ
বেশ কমাস ধরে শোনা যাচ্ছে সালেহর সমর্থক যোদ্ধাদের সঙ্গে হুতি বিদ্রোহীদের সম্পর্ক চটে যাচ্ছে।
২৯ নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের সানায় দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক দফা লড়াই হয়। দোসরা ডিসেম্বর মি সালেহ টিভিতে হাজির হয়ে বলেন সৌদিদের সাথে `নতুন সম্পর্ক` রচনায় তিনি প্রস্তুত। এর দুদিন পর সোমবার তার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
একথা অনস্বীকার্য যে মি সালেহ একসময় সৌদিদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং হুতিরা একসময় তার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছিল।
পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ
পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে ইয়েমেন ভিত্তিক একিউএপি আল কায়দার সবচেয়ে ভয়ানক শাখা এবং ইয়েমেনের অস্থিতিশীলতা এই গোষ্ঠীকে সাহায্য করছে।
এছাড়া হুতি বিদ্রোহী এবং হাদি সরকারের মধ্যে লড়াইকে অনেকেই দেখছেন মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং সৌদি আরবের প্রভাব বিস্তারেরএকটি লড়াই হিসাবে।
এছাড়া ইয়েমেনের অবস্থানও কৌশলগত-ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাব আল-মান্দাব প্রণালি ইয়েমেনের লাগোয়া। সরু এই জলপথটি লোহিত সাগর এবং গাল্ফ অব এডেনকে সংযুক্ত করেছে। বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রধান একটি রুট এই জলপথ।
সূত্র: বিবিসি
এমজে/ এআর