ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

দেশে স্টিল বিল্ডিংয়ের চাহিদা বাড়ছে : আবু নোমান হাওলাদার

প্রকাশিত : ০১:১৬ পিএম, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার

দেশে ক্রমেই বাড়ছে স্টিল বিল্ডিংয়ের চাহিদা। এরইমধ্যে দেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে স্টিলের ব্যবহার শুরু হয়েছে। পদ্মাসেতু থেকে শুরু করে রেলস্টেশনসহ বড় বড় স্থাপনা ও সেতু স্টিলে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। হোটেল সেরিনা, নাসা বিল্ডিং, গুলশানের মিউচুয়ার ট্রাস্ট ব্যাংক ভবনসহ বহু বড় বড় স্থাপনা স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যদিও উন্নত বিশ্বে স্টিলের ব্যবহার শুরু হয়েছে আরও আগে। যেমন মালয় টুইন টাওয়ার, বুর্জ খলিফা ছাড়াও চীনের প্রায় সব বিমানবন্দর ও সেতু স্টিল নির্মিত। এর মূল কারণ স্টিলের ভবন তুলনামূলক বেশি টেকসই এবং ভূমিকম্প নিরোধক। এছাড়া আরসিসি ভবনের তুলনায় স্টিল বিল্ডিং নির্মাণের খরচ অনেক কম।

বাংলাদেশে স্টিল বিল্ডিং সেক্টরে কমপক্ষে ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তরুণদের দেশে-বিদেশে ভালো চাকরি করারও সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে স্টিল বিল্ডিং সেক্টরের সম্ভাবনা, এই সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগসহ নানা দিক নিয়ে ইটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমের (বিবিএস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্টিল বিল্ডিং ম্যানুফেকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকৌশলী আবু নোমান হাওলাদার। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে স্টিল বিল্ডিংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক মোহাম্মদ জুয়েল

ইটিভি অনলাইন: বাংলাদেশে স্টিল বিল্ডিং সেক্টরের যাত্রা কখন থেকে? বর্তমানে এর অবস্থা কেমন?

আবু নোমান হাওলাদার: মূলত ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে স্টিল ভবন নির্মাণের যাত্রা শুরু। বিবিএস স্টিল ২০০০ সাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। একসময় দেশের স্টিল বিল্ডিং খাত ছিল সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। তবে বর্তমানে আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে স্টিল জাতীয় পণ্যসামগ্রী বহির্বিশ্বে রফতানি করছি। স্টিল বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্টিল ভবন নির্মাণ করছে। ফ্যাক্টরিগুলোতে স্টিলের চাহিদা বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রতিবছর ২৫-৩০ শতাংশ হারে আমাদের ব্যবসা বাড়ছে। উদাহরণ স্বরুপ আমি বলতে পারি দেশে গ্রামীণ ফোনের হেড অফিস ও বনানীর নাসা অফিসের ভবনও স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

ইটিভি অনলাইন: স্টিল বিল্ডিং নির্মাণে খরচ কেমন? এটি আরসিসি বিল্ডিংয়ের তুলনায় কতটা সাশ্রয়ী ?

আবু নোমান হাওলাদার: স্টিল বিল্ডিং একতলা বা দুইতলা যদি হয়, তাহলে এটি আরসিসি বিল্ডিংয়ের তুলনায় অনেক কম খরচে হয়ে যায়। তবে ছয়তলার যত উপরে উঠা হয়, স্টিল বিল্ডিংয়ে তত খরচ বাড়ে। ছয়তলা পর্যন্ত স্টিল বিল্ডিং আর আরসিসি ভবনের সমান খরচ হয়। সবমিলিয়ে স্টিল ভবন নির্মাণ অনেক সাশ্রয়ী।

পরিবেশের সুরক্ষায় আরসিসি বিল্ডিংয়ের (ইট-সিমেন্টে নির্মিত ভবন) তুলনায় স্টিল বিল্ডিং সহনীয় হওয়ায় বর্তমানে সচেতন মহলে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অন্যদিকে স্টিল বিল্ডিংয়ের ডাক্টাইল অনেক বেশি হওয়ায় তা ভূমিকম্প সহনীয়। ভূমিকম্পের কারণে এটি দুলবে, তবে কখনো ভেঙ্গে পড়বে না। অন্যদিকে আরসিসি বিল্ডিংয়ের রিজিডিটি বেশি হওয়ায় ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা ভেঙ্গে পড়বে। তাই দিন দিন স্টিল বিল্ডিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এছাড়া স্টিল বিল্ডিং যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে ডিজাইন করা যায়। শুধু তাই নয়, ইনটেরিওর ডিজাইনের সুবিধার্থে ভবনের যেকোনো তলা থেকে দেয়াল সরিয়ে নেওয়া যায়। পিলার সরানোর প্রয়োজন হলে সেটিও সরিয়ে নেওয়া যায়। বিপরীতে আরসি বিল্ডিং সরাতে হলে পুরো ভবনটিই ভেঙ্গে ফেলতে হয়। তাই ভবন ভবিষ্যতে সরাতে হতে পারে, এমন আশংকা যারা করছেন, তাদের মধ্যে স্টিল বিল্ডিংয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

ইটিভি অনলাইন: কর্মসংস্থান বা লোকবল কেমন আছে সেক্টরটিতে? কারা এ সেক্টরে চাকরি পান?

আবু নোমান হাওলাদার: এ সেক্টরটিতে কমপক্ষে ১ লাখ লোক কাজ করছে। এখানে মূলত দক্ষ শ্রমিকরাই কাজের সুবিধা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা প্রকৌশল শিক্ষায় শিক্ষিত তারাই এখানে উচ্চ পর্যায়ে চাকরি পেয়ে থাকেন। এছাড়া অর্ধ-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকদেরও এখানে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। দেশে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বর্তমানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছি। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ ভালো চাকরি করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এদিকে ভারী কাজ থেকে চীন, কোরিয়া, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রকৌশলীরা সরে আসছে। সেখানে আমাদের জন্য সুযোগের দরজা খুলে গেছে। সরকার যদি উদ্যোগ নেয়, ব্যাংকগুলো যদি ঋণ দেয় তাহলে এ সেক্টরে কাজের সুযোগ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে।

ইটিভি অনলাইন: আমাদের এ সেক্টরে অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় কী?

আবু নোমান হাওলাদার: দেখুন, আমরা প্রাইভেট সেক্টর ডমিনেট করছি। সেখানে প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ আছে আমাদের দখলে। তবে সরকারি খাতে আমরা অবদান রাখতে পারছি না। সরকারের কিছুটা সদিচ্ছার অভাবে আমরা নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছি না। সরকার টেন্ডার ড্রয়ের ক্ষেত্রে যে পূর্বশর্ত আরোপ করে, তা আমরা পূরণ করতে পারি না। বিশেষ করে, সরকার যে অভিজ্ঞতার কথা বলে তা আমাদের নেই। সরকার ৪০০-৫০০ কোটি টাকার কাজ করেছে- এমন প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার ড্র করার সুযোগ দেয়, যা আমাদের দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। তাই আমাদের দেশের কাজগুলো চলে যায় বিদেশিদের হাতে। এছাড়া আমাদের স্টিল সংক্রান্ত কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারকে ২৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে, যা ‘শুল্কনীতির পরিপন্থী’।

ইটিভি অনলাইন: সরকারের কাছে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনারা কী আশা করেন?

আবু নোমান হাওলাদার: আমাদের দাবি একটাই, সরকার কেবল একবার  আমাদের যাচাই করে দেখুক। আমাদের ফ্যাক্টরিগুলো পরিদর্শন শেষে সরকার যদি মনে করে, আমাদের সামর্থ রয়েছে; তাহলে টেন্ডার ড্রয়ে সুযোগ করে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, দেশের বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আমাদেরকে সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া সরকারের কাছে আরেকটি দাবি থাকবে, যাতে সরকার কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রত্যাহার করে। এতে আমাদের খরচ কমে যাবে এবং স্বল্পমূল্যে আমরা সরকারকে স্টিল বিল্ডিংয়ের ম্যাটারিয়েল দিতে পারবো।

বিভিন্ন সময় দেখা যাচ্ছে সরকার বিদেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করছে। কিন্তু ওইসব প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিচ্ছে। এর ফলে আমাদের কোয়ালিটি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে। কিন্তু আমরা কোয়ালিফাইড হচ্ছি না। এতে কেবল টেন্ডার লাভ করে তারা ব্যবসা করে যাচ্ছে, হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল টাকা। কিন্তু সরকার যদি আমাদের সঙ্গে সরাসরি ডিল করে তাহলে সরকারী প্রকল্পেও খরচ কমবে।

ইটিভি অনলাইন: ১০ বছর পর এ সেক্টরটিকে আপনি কোথায় দেখতে চান?

আবু নোমান হাওলাদার: আগামী ১০ বছর পর আমি দেখতে চাই দেশে ৫০ শতাংশ ভবন পরিবেশবান্ধব হবে, অর্থাৎ অর্ধেক ভবন স্টিল বিল্ডিংয়েতৈরি হবে।

ইটিভি অনলাইন: আমাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আবু নোমান হাওলাদার: ইটিভি অনলাইনকেও ধন্যবাদ। ইটিভি পরিবারের জন্য শুভকামনা রইলো।

/ডিডি/ এআর