ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

‘ইচ্ছে করেই জেনারেল ওসমানীকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে রাখা হয়নি’

প্রকাশিত : ০৭:০৬ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:২৯ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ শনিবার

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে পাক হানাদার বাহিনী। ওই সময় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা বিতর্ক হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লাহও স্বীকার করেন জেনারেল ওসমানীকে ইচ্ছে করেই রাখা হয়নি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। এছাড়া তিনি জানিয়েছেন ওই সময় ভারতীয় বাহিনীর চাওয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অপারগতার কথা, নিজেদের উদাসীনতার কথা। সোলায়মান হোসেন শাওনের নেওয়া তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ দ্বিতীয় পর্ব।  

ইটিভি অনলাইনঃ বাংলাদেশের কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের সময় আপনি সেখানে ছিলেন। সেদিনের ব্যাপারে যদি আমাদেরকে বলেন।

কে এম শফিউল্লাহঃ আমি ১৩ ডিসেম্বর আমার সৈন্য নিয়ে ডেমরা এসে পৌঁছাই। সেখানকার পাক বাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে পরাজিত করি। তারা পরে আত্মসমর্পণ করে আমাদের কাছে। ১৬ তারিখ সকালে ৫৭ মাউন্টেনারি ডিভিশন থেকে আমি একটি বার্তা পেলাম যে, আমাকে সাড়ে তিনটার মধ্যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে থাকতে হবে। সেখানে ভারতের জেনারেল জগজিত সিং অরোরা আসবেন। তাকে রিসিভ করতে হবে আমাকে। তখন অনেক জায়গায়-ই পাক বাহিনীর পরাজয় হলেও ঢাকায় আসাটা সহজ ছিল না।

তখন পাকিস্তান আর্মির ওই ইউনিটের কমান্ডার লে. ক. খিলজীকে নিয়ে তার গাড়িতে করেই ঢাকা আসার উদ্যোগ নিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহ বেগ সিং। ঢাকার কাছাকাছি আসতেই ওই গাড়িতে গুলি করা শুরু করে সেখানে থাকা কিছু পাকিস্তানি সৈন্য। পরে পাকিস্তানিদের কর্ণেল খিলজীকে বললাম সে যেন তাদের থামায়। সে তখন গাড়ি থেকে মুখ বের করে সৈন্যদের নিবৃত করেন। এভাবে জায়গায় জায়গায় বাধার মধ্যে দিয়েই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাই।

ইটিভি অনলাইনঃ কেমন ছিল সেই মুহূর্তগুলো?

কে এম শফিউল্লাহঃ  সেখানে এসে দেখলাম জেনারেল নিয়াজি উপস্থিত আছেন। আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বাকের সিদ্দিকী। পাক আর্মিতে থাকার সময় এরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমার সিনিয়র ছিলেন। জেনারেল বাকের বললেন, ‘কংগ্রাচুলেশন শফিউল্লাহ। ইউ ফট ওয়েল’। আমি বললাম, ‘ইউ টট ওয়েল স্যার’।

ময়দানের মাঝে দেখলাম আগে থেকেই মাঝখানে চেয়ার টেবিল রাখা আছে। জেনারেল অরোরা আর জেনারেল নিয়াজি আসলেন। তারা তাদের নির্ধারিত চেয়ারে বসলেন। আমি নিয়াজি সাহেবের সামনেই কোণাকুণি অবস্থানে দাঁড়ানো ছিলাম।

আমি দেখলাম জেনারেল নিয়াজি তার নাম পুরোপুরি লেখেনি। তিনি লিখেছেন ‘নিয়া’। পুরোটুকু না লিখেই ফাইল সাইন করে পাস করে দেন জেনারেল অরোরা’র দিকে। আমি তখন জেনারেল অরোরাকে বললাম, ‘স্যার হি ডিড নট কমপ্লিট হিস সিগনেচার’। তখন জেনারেল ফাইল খুলেও তা দেখলেন। এরপর ফাইল আবার নিয়াজির কাছে ফেরত দেয়া হলো। তখন সে পাশে ‘জি’ লেখেন। তখন পুরো ‘নিয়াজি’ লেখা হয়।

ইটিভি অনলাইনঃ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল এমএ জি ওসমানি। তার কাছে কেন আত্মসমর্পণ করানো হল না? এমনকি তাকে কেন সাক্ষর অনুষ্ঠানে রাখা হল না?

কে এম শফিউল্লাহঃ জেনারেল ওসমানী তখন ছিলেন কুমিল্লা সার্কিট হাউসে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে উনি যান সিলেট। সিলেট যাওয়ার পথে ওনার হেলিকপ্টারে গুলি করা হয়। ওনার সঙ্গে থাকা কর্ণেল রব গুলিবিদ্ধ হন। অবতরণের পর হেলিকপ্টারটি আর উড্ডয়ন করানো যায়নি।

ইটিভি অনলাইনঃ অনেকেই মনে করেন ইচ্ছে করেই তাকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আনা হয়নি। আপনি কী মনে করেন?

কে এম শফিউল্লাহঃ সত্যি কথা বলতে আমারও মনে হয় ইচ্ছে করেই তাকে আনা হয়নি। আমার এমনটা মনে হবার কারণ হল, অনুষ্ঠানের অনেক আগে অনুষ্ঠানস্থলে কারা কারা থাকবেন তাদের নামের একটি তালিকা আমি দেখি। ৫৭ মাউন্টেনারি ডিভিশন সে তালিকা করে। সে তালিকায় ওসমানী স্যারের নাম ছিল না। এর মানে তারা আগে থেকেই জানত যে, ওসমানী স্যার সেখানে আসবেন না।

আমার মনে হয় ভারতীয়দের সঙ্গে পাকিস্তানিদের বিরোধ অনেক দিনের। পাক বাহিনী যেহেতু ভারতেও আক্রমণ করে তাই তারা চেয়েছিল তাদের কাছেই যেন পাকিস্তানিরা পদত্যাগ করে। এখানে তারা তাদের হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছে।

ইটিভি অনলাইনঃ তো আপনারা যারা উপস্থিত ছিলেন প্রতিবাদ করেননি কেন?

কে এম শফিউল্লাহঃ আমরা আসলে ওই মুহূর্তে হঠাৎ করে বিষয়টির গুরুত্ব এতোটা বুঝে উঠতে পারিনি। তাকে ইচ্ছে করে আনানো হচ্ছে না তা মনেই হয়নি। আমাদের মনে হয়েছে আসলেই হেলিকপ্টারের যান্ত্রিক ত্রুটি। এছাড়া তখন আমরা সবাই স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। আত্মসমর্পণই শুধু মাথায় ছিল। আমাদের কথা ছিল কোনমতে আত্মসমর্পণ হয়ে যাক। সেসময় এত ‘প্রটোকল’ নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম না।

/ এআর /