বেশি কথা মোবাইলে কান যাবে অকালে
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
প্রকাশিত : ০৬:৪০ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ১২:৫৩ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সোমবার
সুইজারল্যান্ডের জুরিখের একটি স্কুল। বছর চারেক আগে সে স্কুলের শিক্ষার্থীরা হঠাৎ কেমন অ স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করল। শিক্ষকরাও যেনও কিছুটা বদমেজাজি ও খিটখিটে হয়ে উঠলেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।পরবর্তীতে জানা গেল স্কুল সংলগ্ন মোবাইল ফোনের অতিকায় টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশনই এই কারণ, যা মানব মস্তিস্কের সহ্য শক্তির অতীত। মোবাইল কোম্পানির নামে মামলা হল। বিলিয়ন ডলার ক্ষতি পূরণ দিয়ে টাওয়ার সরিয়ে নিতে বাধ্য হল তারা।
আমাদের দেশেও এখন বাছ বিচারহীন ভাবে মোবাইল টাওয়ার বসানো হচ্ছে।জনসংখ্যা-অনুপাতে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোবাইল ব্যবহারকারির দেশ। গাড়ি চালাতে চালাতে বা রেল লাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলছে, এমন দৃশ্য আজকাল অহরহ দেখা যায়। সাথে মরণঘাতী সেলফির হুজুগ তো আছেই। প্রশ্ন হল, মোবাইল ফোন ব্যাবহার কি বিপদজনক? আমি বলবো, এটা আসলে বিপদজনকের বেশি কিছু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী একটি মোবাইল ফোন মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সমপরিমান রেডিয়েশন ছড়িয়ে থাকে।
১৫মিনিট একটানা মোবাইলে কথা বললে মস্তিস্ক রক্ত সঞ্চালন বাড়তে থাকে। ফলে কান সংলগ্ন ত্বক আগুনের মতো লাল হয়ে যায়। কান গরম হয়ে যায়, শুরু হয় মাথা বেথা। এখানেই শেষ নয়। এর সঙ্গে আছে এন্টেনার রেডিয়েশন, যা মস্তিস্কোর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে ১০৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট অবধি। আমরা জানি ১০১ ডিগ্রিতেই শিশুদের খিঁচুনি হয়। তাহলে মস্লিস্কের তাপমাত্রা যখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের প্রভাবে মারাত্নক ক্ষতির শিকার হন ১৬ বছরের কম বয়সী শিশু ও অন্তঃস্বত্তা নারীরা।
বাচ্চা খেতে না চাইলে অনেক মা মোবাইলে কিছু একটা চালু করে দেন। বাচ্চা ওটা একঘন্টা ধরে দেখতে থাকে আর মা খাইয়ে দেন।কিন্তু তিনি খেয়াল করেন না যে,সন্তান এই একঘন্টা ধরে রেডিয়েশনও হজম করছে।অর্থাৎ পুষ্টি যতটুকু নিচ্ছে তার চেয়ে অপুষ্টি নিচ্ছে বরং বেশি।দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্জানীরা বলছেন, বয়স ১৬ হওয়ার আগে কোনো অবস্থাতেই মোবাইল ব্যবহার করা উচিত না।সাম্প্রতিক সময়ে অটিজম - আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বিশ্বজুড়েই বেড়ে যাচ্ছে আশংকাজনকভাবে। ১৯৮০ সালে যা ছিলো প্রতি ৫০০ জনে একজন,এখন সেটা ৬৮ জনে একজন। অটিজমে আক্রান্ত শিসু সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ কোরিয়ায়।
এর অন্যতম কারণ হিসেবে সে দেশের বিজ্জানীরা দায়ী করছেন বেশি বয়সে সন্তানধারণ ঘনঘন আলট্রাসনোগ্রাফি ও মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনকে।মোবাইল ফোনে বহু সময় ধরে কথা বললে আপনি অবসন্ন হয়ে পড়বেন।মাথাব্যথা করবে।অনেকক্ষণ কথা বরে ঘুমাতে গেলেন, ঘুম আসবে না। আর বিরামহীন ভাবে যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তাদের স্মৃতিশক্তিতে ধস নামে এবং কাঁধ,কনুই ও কব্জির জয়েন্ট ক্রমশ অকেজো হয়ে যায়।
মস্তিষ্ক কে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে এর চারপাশে ব্রাড ব্রেন ব্যারিয়ার নামে একটি আবরণ আছে।অল্প কিছু ছাড়া অধিকাংশ ওষধই এই দেয়াল অতিক্রম করতে পারে না।এই দেয়ালের জন্যেই অনেক ওয়েভ ব্রেনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না।কিন্তু অনেক সময় ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলার ফলে মস্তিষ্কেরতাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং েরর রক্তনালী গুলো সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে।রক্তনালীর দেয়ালগুলো তখন উন্মুক্ত হয়ে যায়।আর মোবাইলের মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন সরাসরি এন্ডোথেলিয়াল সেলের প্রোটিন কাঠামোকে বদলে দেয়,সে সুযোগে টক্সিন মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করে।আরেকটি সাধারণ প্রশ্ন হলো,মোবাইলের রেডিয়েশন কি ব্রেন টিউমার সৃষ্টি করতে পারে?টক্সিনের প্রভাবে নার্ভ সেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ডিএনএ-র কর্মকাঠামো বদলে যায়।কোনো ডিএনএ যদি একবার অস্বাভাবিক হয়ে যায় তাহলে সে সবসময় অস্বাভাবিক ডিএনএই রেপ্লিকেট করবে।ফলে ব্রেন টিউমার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।ব্রেন ক্যান্সার সংক্রান্ত বিস্তর গবেষণার আলোকে বিজ্জানীরা দেখিয়েছেন,একজন মানুষ যদি এক থেকে পাঁচ বছর অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন,তাহলে তার ব্রেন টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ১২৫ শতাংশ।পাঁচ থেকে ১০ বছর করলে সম্ভাবনা বাড়বে ২৫০ শতাংশ।
আর যারা ১৫ বছর ধরে ব্যবহার করছেন তাদের সম্ভাবনা বাড়ে ২৭৫ শতাংশ পর্যন্ত।একজন ইএনটি সার্জন হিসেবে আমার অভিজ্জতা হলো,গত কয়েক বছরে কানের পার্শ্ববর্তী ক্যারোটিড ও স্যালাইভা গ্ল্যান্ডের টিউমার বাংলাদেশে বহুগুণ বেড়ে গেছে।এর পেছনেও আছে মোবাইল ফোনের ভূমিকা। তাই আমি বরি,বেশি কথা মোবাইলে, কান যাবে অকালে।এখন করণীয় কী? প্রথমত,মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময়সীমা কমিয়ে দিতে হবে।মোবাইলে কারো সাথে আলাপের আদর্শ সময় হলো ২০ সেকেন্ড।কিন্তু তিন মিনিট কথা বলে ফেলেন তাহলে পরবর্তী ১৫ মিনিটের মধ্যে তার আর ফোন ব্যবহার করা একেবারেই উচিত হবে না।
দ্বিতীয়, হেডসেট বা স্পিকার ব্যবহার করুন।অ্যানালগ বা ল্যান্ডফোন যদি হাতের নাগালে থাকে তাহলে সেলফোন ব্যবহার করবেন না।পারতপক্ষে মোবাইল ফোন শিশুদের নাগালের বাহিরে রাখুন।আবার অনেকে আছেন যারা ঘুমানোর সময় ফোনটি বিছানায় এমনকি মাথার ঠিক কাছেই রাখেন,এটা কখনোই করা যাবে না।তৃতীয়, যেখানে সেখানে মোবাইল ফোনের এন্টেনা বসানো যাবে না।আসলে যেকোন ব্যাপারে ব্যক্তিগত সচেতনতাই সবচেয়ে জরুরি।এটা মেনে নিতেই হবে যে,মোবাইল ও কম্পিউটার আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।অনেক কাজজ আগের চেয়ে বেশ সহজ হয়ে গেছে।আবার এদের আছে অদৃশ্য বিপদ।এই স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোর ব্যাপারে পূর্বসতর্কতা নিলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারবো।
**অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও প্রখ্যাত নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ। গত ১মে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাসিক মুক্ত আলোচনায় এই বক্তব্য দেন।