‘জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়’
প্রকাশিত : ১২:৫২ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০১:১৬ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার
আজ বেদনার দিন ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস সম্মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
বুদ্ধিজীবী দিবসে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী, স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দ সৈনিক ফকির আলমগীর। তার সঙ্গে কথা বলেছেন- সোহাগ আশরাফ
একুশে টিভি অনলাইন : একুশের টিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন আপনি?
ফকির আলমগীর : একুশে টিভি অনলাইনকে ধন্যবাদ। বিজয়ের এই মাসে, বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য।
একুশে টিভি অনলাইন : আজ তো বুদ্ধিজীবী দিবস, এই দিনটির তাৎপর্য আপনার মুখে শুনতে চাই।
ফকির আলমগীর : আমি প্রথমেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতে চাই। এই মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু একদিনে সংগঠিত হয়নি। সেই ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৬০’র দশকের আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থ্যান, তারপরে কত রক্ত, কত আত্মদান, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সমস্ত মানুষের কতনা অবদান এই বাংলাদেশটির জন্য।
আমাদের এই জাতিকে মেধাশূণ্য করার জন্য সেই যে রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানী হায়নাদের দোসররা সেদিন হিংস্র হয়ে উঠেছিলো তারা কিন্তু আজও ৪৬ বছর পরেও আস্ফালন করে, তারা ফণা তোলে। তারা সেদিন জাতিকে মেধাশূণ্য করার জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলো।
আমি আব্দুল লতিফের কালজয়ী গানটির কথা বলবো। যে গান বারবার স্মরণ করিয়ে দিবে জাতিকে।
‘‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়
দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি, জানা আছে জগৎময়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়
সতেরোশো সাতান্ন সনে, ভাইবা দেখেন পড়বে মনে
দাম দিছি পলাশীর মাঠে, ইতিহাস তার সাক্ষী রয় ...’’
একুশে টিভি অনলাইন : আপনি রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন বলিষ্ঠ শব্দ সৈনিক। একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। অনেক ত্যাগ, রক্ত, প্রাণের পর আমরা যখন বিজয় পেতে যাচ্ছি, সেই সময়টা কেমন ছিলো?
ফকির আলমগীর : আসলে আমরা তো স্বাধীন বাংলায় ছিলাম। একটি থমথমে অবস্থা। চারিদিকে আমরা বিজয়ের বার্তা পাচ্ছি। আমরা সেই সময় গান করেছি, শহীদুল হক খানের লেখায়, সুজেয় শ্যামের সুরে।
‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে
উড়ছে ... উড়ছে ... উড়ছে ...
বাংলার ঘরে ঘরে, মুক্তির আলোয় জ্বলছে
মুক্তির আলোয় জ্বলছে ...
মুক্তির আলোয় জ্বলছে..’
বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। তখনও তিনি ফিরে আসেননি। এক একটি জায়গা মুক্ত হচ্ছে। আমরা বিজয় নিশান উড়াচ্ছি। সবাই একে একে ছুটে আসছে ঢাকার দিকে। ঢাকা মুক্ত হবে। সেই সময় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো। একে তো বঙ্গবন্ধু নেই, সেই জন্য একটি ব্যথা। কত স্বজনকে আমরা হারিয়েছি সেই ব্যথা। অনেক বেদনাদায়ক ছিলো দিনগুলো।
এই বিজয়ের জন্য যারা অকাতরে যারা জীবন দিয়েছে, যে মা বোনেরা ইজ্জত হারিয়েছে তাঁদের আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। স্মরণ করি যে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম।
‘এখানে রাজপথে, দুরন্ত মিছিলে ছুটে আসে কেউ …
রেসকোর্স ময়দানে বর্জ কণ্ঠ ভাসে
বঙ্গবন্ধু যেনো কবিতার ঢেউ/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম …
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম …’
সেই যে রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ-এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেটি জাতির জন্য গর্ব। আজকে আমরা বিভিন্ন, দল, মত থাকতে পারি কিন্তু বঙ্গবন্ধু হচ্ছে সবার উপরে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা এই তিনটি জিনিস যিনি মানেননা তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক নন। একজন শিল্পী হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, স্বাধীনতার এই ৪৬ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি সব কিছুকে বাদ দিয়ে আমরা যদি সেদিনের মত ঐক্যবদ্ধ না হতে পারি, এই তিনটি জিনিস কে শ্রদ্ধা না জানাতে পারি তাহলে মানুষ বলে গণ্য হবো না।
একুশে টিভি অনলাইন : বঙ্গবন্ধু যখন সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি দিচ্ছেলেন আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
ফকির আলমগীর : আমি গর্ব বোধ করি যে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি আমি অতি নিকট থেকে শুনেছি। অসহযোগ আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিতে পেরেছি। তারপর দেখেছি সেই ২৫ মার্চের কালো রাত। সেই বিভৎসতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ঢাকা শহরে। এই ঢাকায় কত ইতিহাস রচনা করেছি। ঢাকায় ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা, এ ঢাকায় মহান মুক্তিযুদ্ধ, এই ঢাকায় পাকিস্তানি হায়নাদের আত্মসমর্পণ সবকিছুই ঢাকায় সংগঠিত হয়েছে।
একুশে টিভি অনলাইন : মুক্তিযুদ্ধে গণসঙ্গীতের ভূমিকা কতটুকু। আপনারা তখন কি কি প্রতিকুলতার মধ্যে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ, সাহস দিয়েছিলেন? সেই গল্পটা শুনতে চাই।
ফকির আলমগীর : যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলো, যখন অবরুদ্ধ হলো বাংলাদেশ, যখন পথে-প্রান্তরে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, আমরা তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হলাম। অসহযোগ আন্দোলনে আমরা সংগ্রাম করলাম। ঠিক ওই সময় আমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম। মুজিব নগর অম্রকাননে বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক করে অস্থায়ি একটি সরকার গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
আপনারা জানেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রস্তুতিকালীন সময় ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’- এই গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাজানো হয়। স্বাধীনতার প্রস্তুতিকালে এধরণের অসংখ্য গান গাওয়া হয়েছে। এরপর থেকে অনেক নতুন নতুন গান স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এসেছে। অবরুদ্ধ দেশে মুক্তিযোদ্ধারা তখন কান পেতে আছে চরমপত্র শোনার জন্য, জাগরণী গান শোনার জন্য। ওই সময় নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, সুকান্তের গান যেমন ছিলো তারপর আমাদের সেই ‘একটি ফুলকে বাাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ এই সমস্ত গান তৈরি হয়। যা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা।
একুশে টিভি অনলাইন : বিজয় দিবসে সবার উদ্দেশ্যে আপনার কি কিছু বলার আছে?
ফকির আলমগীর : একজন স্বাধীন বাংলার শিল্পী হিসেবে আমি বলবো- হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, পরশ্রীকাতরতা নয় আসুন জাতীয় চেতনায় এক থাকবো।
একুশে টিভি অনলাইন : একুশে টিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
ফকির আলমগীর : ধন্যবাদ একুশে টিভি অনলাইনকে। বিজয় দিবসের এই প্রাককালে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলবো মুক্তিযুদ্ধ নিরন্তর। এখনো শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন কায়দা, বিভিন্ন আদলে এসেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এসএ/