ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

চট্টগ্রামবাসী অভিভাবক হারালো

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৫:৫৯ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ১২:৪৯ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সোমবার

চট্টগ্রামের কিংবদন্তী রাজনীতিক ও অভিভাবক, তিনবারের নির্বাচিত সাবেক সফল সিটিমেয়র বর্ষীয়ান জননেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সব রাজনৈতিক সতীর্থসহ চট্টগ্রামবাসীকে কাঁদিয়ে, শোকসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চিরবিদায় নিলেন। দেশ-বিদেশের উন্নতচিকিৎসা শেষে ১৫ ডিসেম্বর শেষরাতে নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন। চট্টগ্রামের বিজয়মেলা’র স্বপ্নদ্রষ্টা যার অনুসরণে সারা দেশে বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন চৌধুরীকে এবারের বিজয়মঞ্চে আর দেখা যাবে না। চট্টগ্রাম অঞ্চলের খেটে খাওয়া দিন মজুর থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মেহনতি জনগণ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা, দুর্দিনের কাণ্ডারি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে হতবিহবল ও নির্বাক। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিকে হারিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা  দিশেহারা ও চরমভাবে শোকাহত। তাকে বিদায় জানাতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের আকাশ-বাতাস শোকে মুহ্যমান।

চট্টগ্রামের রাজনৈতিক আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র খসে পড়ায় চট্টলবাসীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল- যা সহজে পূরণ হবে না। ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতির ভ্যানগার্ড সংগঠক, বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ, স্বাধীন-বাংলাদেশের সূর্যসন্তান ও গরীব-দুঃখী ভাগ্যাহত সাধারণ মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রয়াণে আমরা চট্টগ্রামবাসী গভীরভাবে শোকাহত। প্রয়াত এ নেতার শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক সমবেদনা। আমরা মহান এ নেতার বিদেহী পরমাত্মার প্রশান্তি কামনা করছি।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে রয়েছে আমার এক স্মৃতিময় ঘটনা । ২০০১ সালের আগস্টের প্রথমার্ধে চাটগাঁর বাণী’র পত্রিকার ডিক্লেরেশন পেয়েছি। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মেয়র। ওইসময়ে যুবলীগনেতা মামুন কর্তৃক  পূর্বকোণ অফিসে অনাকাক্ষিত ঘটনায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর সওঙ্গ গণমাধ্যমের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এসময়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে নতুন একটি দৈনিক পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন। আমি তখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের চিফ একাউন্টস অফিসার নারায়ণচন্দ্র পালের অফিসকক্ষে যেতাম। চাটগাঁর বাণী’র ডিক্লেরেশনের কথা নারায়ণ বাবু-ও জানতেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি একদিন চাটগাঁর বাণী’র ডিক্লেরেশন এর কথা মেয়র মহিউদ্দিনকে জানান। চাটগাঁর বাণী নামটি শোনে তিনি বেশ খুশি হন এবং আমাকে তার অফিসে দেখা করতে বলেন। আমি একদিন মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেয়র কার্যালয়ে যাই। চাটগাঁইয়া ভাষায় তার মূলকথা ছিল এরকম- “ চাটগাঁর বাণী নামটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমি পত্রিকাটিকে দৈনিক-এ রূপান্তর করে চালাতে চাই। তবে তোমরা কেউ সম্পাদক থাকতে পারবে না। আমি নামকরা সম্পাদক দিয়ে পত্রিকাটি পরিচালনা করবো। তুমিও এখানে কাজ করতে পারবে তবে সম্পাদক হিসেবে নয়। কত টাকা দিতে হবে বলো।”

চট্টগ্রামের উদ্ভূত পরিস্থির কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সেদিনের প্রস্তাব আমি সসম্মানে পরিহার করেছিলাম। চট্টগ্রাম এর সব পত্রিকা ও সাংবাদিকেরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতে একটি  পত্রিকার ডিক্লেরেশন এনে এভাবে বিক্রি করে দেওয়াকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারিনি। পরে অবশ্য মহিউদ্দিন চৌধুরী তৎকালীন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সীতাকুণ্ডের কৃতিসন্তান আক্তার উন নবীকে সম্পাদক করে দৈনিক নয়বাংলা পত্রিকা কিছুদিন চালিয়েছিলেন।

এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে আরেকটি ঘটনা। চাটগাঁর বাণী প্রকাশনা শুরুর পর ২০০১ সালের নভেম্বরের দিকে সীতাকুণ্ড তথা চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুণকে নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অফিসে গিয়েছিলাম। সালাউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে মেয়র মহিউদ্দিনের ‘তুইতাক্কারি’ সম্পর্ক ছিল। মেয়রের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, চাটগাঁর বাণী’র জন্যে সিটি কর্পোরেশনের নিয়মিত বিজ্ঞাপন নেওয়া। মেয়র বললেন, “ এগিন গিল্লাই গরদদে,  আঁরাও একসময়  সাপ্তাহিক পত্রিকা বাইর গৈরতাম, কনো লাভ নাই। সালাউদ্দিনেরে লই আইসো, হেইল্লাই বিজ্ঞাপন ওগগা দিইজ্জে।”

পরিস্কার কথা, সাফ কথা, কোনো লুকিচুরি নেই-যা বলার সামনেই বলতেন  তিনি। তার মধ্যে কোনো চলচাতুরী, শঠতা ও ভণ্ডামি ছিল না। তিনি যা ভাবতেন, মনেপ্রাণে যা ধারণ করতেন তাই খোলামেলাই বলতেন। চট্টগ্রামবাসীর যেকোনো দাবী-দাওয়া আদায়ে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তার মতো সাহসী নেতা চট্টগ্রামে নেই বললে চলে। চট্টগ্রামের একে খান গেট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত যে সংকীর্ণ রাস্তাটি ছিল তা যেভাবে প্রশস্ত করা হয়েছে, মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো সাহসী নেতা না হলে তা কোনোদিন অন্যকারো পক্ষে এতো সহজে করা সম্ভব হতো না।
চট্টগ্রামের স্বার্থে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন আপোসহীন নেতা। সব প্রকার শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সত্যকথা বলতে তিনি কাউকে ভয় করতেন না। এমনকি তার নিজ দল আওয়ামী লীগ ও সরকারের কোনো নীতি যদি চট্টগ্রামের স্বার্থের পরিপন্থী হতো তাতেও তিনি জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলতেন। তাই সরকারিভাবে চট্টগ্রাম নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় নীতিনির্ধারকেরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা সর্বদা মাথায় রাখতেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি সরকারের আমলেও চট্টগ্রাম নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাথাব্যথার কারণ ছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীই। সাংগঠনিক ক্যারিসমার কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরী আঞ্চলিক নেতা হলেও কেন্দ্রীয়নেতার চেয়ে তার গুরুত্ব কোনো অংশে কম ছিল না । চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিকল্প ছিলেন মহিউদ্দিন নিজেই।

লেখক- প্রধানসম্পাদক, চাটগাঁর বাণী

এসএইচ/