মুক্তিযোদ্ধারা যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন না : সোহেল রানা
প্রকাশিত : ০৯:৩৪ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ১১:৩৪ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ শনিবার
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিত্রনায়ক সোহেল রানা অভিযোগের সুরে বলেন, আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। আমরা একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা তা পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এখন তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। আজ শুক্রবার ইটিভির কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
সোহেল রানার প্রকৃত নাম মাসুদ পারভেজ। তিনি একাধারে একজন মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক ও রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ‘সোহেল রানা’ নাম ধারণ করে ‘মাসুদ রানা’ ছবির নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা লাভ করেছেন। মহান বিজয় দিবস ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের সিনিয়র সহ-সম্পাদক দীপংকর দীপক
ইটিভি অনলাইন : আপনাকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা?
সোহেল রানা : আগামীকাল বিজয় দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করেছি। বিজয়ের ৪৬ বছর পূর্তি উৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে নিজেকে নিয়ে খুবই গর্ব হচ্ছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে আমার সব ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পাঠকদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাই।
ইটিভি অনলাইন : সবার আগে আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। কার অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন?
সোহেল রানা : ১৯৬১ সালে আমি ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করি। তখন থেকেই বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলে থাকাকালে স্বাধীনতা অন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর পাকসেনাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমরা টানা ৯ মাস হানাদারদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনও গায়ের রোম শিউরে উঠে।
ইটিভি অনলাইন : স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেছেন আপনি? এ ছবিটি প্রসঙ্গে জানতে চাই-
সোহেল রানা : ‘ওরা ১১ জন’ মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। একে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলা যাবে না। কারণ, এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনের নানা বাঁক, উত্থান-পতন, প্রেম-বিরহ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা কথা উঠে এসেছে। তাই আমি একে অন্য দশটির মতো ছবি বলতে চাই। ‘ওরা ১১ জন’ ওই সময় খুবই ব্যবসা সফল হয়েছিল। এ ছবির লভ্যাংশ হিসেবে ৬ লাখ টাকা পেয়েছিলাম, যা এখনকার ৬ কোটি টাকার সমান।
ইটিভি অনলাইন : এখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে না বললেই চলে। এর কারণ কি?
সোহেল রানা : সঠিক ইতিহাসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র খুব বেশি নির্মিত হয়নি। কিছু কিছু ছবিকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলে দাবী করলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। ওইসব ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে ততটা শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। তাছাড়া এখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যুদ্ধের সময়কার সরঞ্জাম পাওয়া যাবে না। এ কারণে শতভাগ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
ইটিভি অনলাইন : বর্তমানে চলচ্চিত্রে নানা সংকট চলছে। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় কী?
সোহেল রানা : সংকট নিজেদেরকেই মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের চলচ্চিত্রের একটি নিজস্ব ধারা আছে। এ সময়ের নির্মাতারা সেই ধারা ধরে রাখতে পারছেন না। বিদেশি ছবি নকল করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এখন মৌলিক গল্পের ছবি নেই বললেই চলে। তাই নির্মাতাদের দেশিয় ছবির ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হবে। এছাড়া চলচ্চিত্রের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ইটিভি অনলাইন : একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কী কোনো অভিযোগ কিংবা অভিমান আছে?
সোহেল রানা : আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। আমরা একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা তা পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এখন তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। আমি মনে করি, ‘মুক্তিযুদ্ধ ভাতা’ দিয়ে তাদের আপমানিত করা হচ্ছে। তারা কেন ‘ভাতা’ নেবে। ‘ভাতা’ দেওয়া হয় তো দুঃস্থদের। আমাদের দিতে হবে সম্মান তথা সম্মানী।
ইটিভি অনলাইন : বিজয় দিবস উপলক্ষে তরুণ প্রজন্মকে কী পরমর্শ দিবেন?
সোহেল রানা : তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই স্বাধীনতার ভুল ইতিহাস জানে। সবার আগে তাদের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। স্বাধীনতার মর্মার্থ বুঝতে হবে। স্বাধীনতার মানে কি তা জানতে হবে। আমরা স্বাধীন জাতি- এটি আমাদের জন্য অনেক বড়প্রাপ্তি। স্বাধীনতা আমাদের অহংকার। তাই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। এর জন্য তাদের আরও বেশি বেশি বই পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখতে হবে। তবেই সুখী-সমৃদ্ধি দেশ গড়ে উঠবে।
[১৯৪৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন সোহেল রানা। তার পৈতৃক বাড়ি বরিশালে। তার স্ত্রী ডা. জিনাত পারভেজ। একমাত্র পুত্রসন্তান মাশরুর পারভেজ জীবরান। তিন ভাইয়ের অন্য দুই ভাই কামাল পারভেজ ও মাসুম পারভেজ রুবেল। ১৯৬১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন সোহেল রানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকাকালে তিনি স্বাধীনতা অন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটি প্রযোজনা করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে ‘মাসুদ রানা’ ছবি দিয়ে তার নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে। সোহেল রানার জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বীরপুরুষ’, ‘বজ্রমুষ্ঠি’, ‘কমান্ডার’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘অদৃশ্য শত্রু’ প্রভৃতি। তিনি একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন।]