ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘প্রাণ ফিরে পাচ্ছে দেশের পর্যটন খাত’

প্রকাশিত : ০৬:০৫ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ বুধবার

অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থানের পরই বর্তমানে যে বিষয়টি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, তা হলো পর্যটন। মানুষ সৌন্দর্য পিপাসু। আর মানুষের সেই তৃষ্ণা মেটাতে এবার দেশীয় পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এদিকে দিনও বদলাচ্ছে। উন্নয়নের জোঁয়ারে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন খাত। আর সরকারের আন্তরিকতায় নতুন করে প্রাণ পেতে যাচ্ছে দেশের পর্যটন শিল্প।

সম্প্রতি ইটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমনটিই জানিয়েছেন এফবিসিসিআইএর পরিচালক ও পর্যটন কেন্দ্র ড্রিম হলিডে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রবীর কুমার সাহা। তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলে দেশীয় পর্যটনশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশও একদিন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভূটানের মতো পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইটিভি-অনলাইনের প্রতিবেদক মোহাম্মদ জুয়েল-

ইটিভি অনলাইন: দেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে বলুন?

প্রবীর কুমার সাহা: দেশের পর্যটন শিল্প অনেক এগিয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে দেশের অন্যান্য খাতের মতো পর্যটন শিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। একসময় দেশের পর্যটন পিপাসু মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দেশের বাইরে যেতেন। তবে বর্তমানে সংখ্যাটা অনেকটাই কমে এসেছে। বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র-সৈকত কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের পিকনিক স্পট গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে কেবল কক্সবাজার আর পার্বত্য অঞ্চলেই বিনোদন কেন্দ্র  গড়ে উঠছে না, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত এলাকা-ই নয়, দেশে বর্তমানে কৃত্রিমভাবেও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যা পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মানের।

ইটিভি অনলাইন: দেশে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

প্রবীর কুমার সাহা: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। পৃথিবীতে যতগুলো বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তার সবই গড়ে উঠেছে সমুদ্র-সৈকত, পাহাড়, নদী আর জলাশয়কে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশ পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনাময়। এখানে পদ্মা-মেঘনার মতো নদী আছে। আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র-সৈকত কক্সবাজার। আছে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছরির মতো তিন পার্বত্য জেলা। এছাড়া নয়নাভিরাম সিলেট ও সুন্দরবনতো রয়েছেই। বিশেষ করে পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার, খুলনার ষাট গম্বুজ মসজিদ ও বগুড়ার মহাস্থানগড়ের তো রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। এছাড়া সিলেটের বিছানাকান্দিসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকা আছে যেখানে সরকার উদ্যোগ নিয়ে বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত পর্যটন কেন্দ্র গঠনে সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। মহেশখালীতে কেবল বিদেশিদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র গঠনে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলেও জানান তিনি। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ দেশের পর্যটন শিল্পকে আরও বেগবান করবে । যদি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া যায়, তবে এ খাত সামনের দিনে অর্থনীতির ভিত গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দিবে।

ইটিভি অনলাইন: পর্যটন শিল্পের প্রসারে সরকারের কি উদ্যোগ নেওয়ার আছে?

প্রবীর কুমার সাহা: পর্যটন শিল্পের প্রসারে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলতে উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা যদি আমাদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে কাজ করতে চায়, তাহলে এ শিল্প আরও প্রসারিত হবে। দেশে বর্তমানে ৩৭৫টি বিনোদন কেন্দ্র আছে । এরমধ্যে ৬-৭টি বিনোদন কেন্দ্র আছে, যেগুলো যে কোনো আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্রকে টেক্কা দিতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই আমি মনে করি পর্যটন শিল্পের প্রসারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সৌন্দর্য পিপাসু মানুষদের নিরাপত্তা দান। দু-তিন বছর আগে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে পর্যটন শিল্পে কিছুটা ধস নেমেছিল। তবে বর্তমানে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক সুন্দর। কেবল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই নিরাপত্তা বাড়ালে চলবে না, পাশাপাশি বিনোদন কেন্দ্র গুলোতেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সৌন্দর্য পিপাসু মানুষদের অন্যতম চাহিদা হলো সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে সহজে যাতায়াতের জন্য আলাদা যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে এ শিল্প আরও বেগবান হবে।

ইটিভি অনলাইন : বিনোদন কেন্দ্রগুলিতে কোন ধরণের পর্যটকরা বেশি আসছে?

প্রবীর কুমার সাহা: বিনোদন কেন্দ্রগুলিতে এখন মোটামুটি সব শ্রেণীর মানুষই আসছে। বিশেষ করে মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। আগে মানুষ স্বাবলম্বী ছিল না। তবে বর্তমানে মানুষ স্বাবলম্বী। তাই মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্তানের পরই যেটি চলে এসেছে সেটি হলো বিনোদন। তাই দেশের মানুষ বিনোদনের দিকে ঝুঁকছে। এই মানুষগুলো দেশে ধরে রাখতে হলে যেটি করতে হবে, তা হলো দেশে আরও আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র গড়তে প্রথম সমস্য হলো ধর্মীয় বাধা। তবে আনন্দের বিষয় হলো মানুষের ধারণা পাল্টাচ্ছে। তাই দেশের মানুষের জন্য দেশীয় চাহিদার আলোকে অন্যদিকে বিদেশিদের জন্য তাদের চাহিদা আলোকে বিনোদন কেন্দ্রগুলো গড়ে তুলতে পারলে আমরা আরও বেশি পর্যটক পাব।

ইটিভি অনলাইন: এখন তো পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। এ বছর আপনারা কেমন  পর্যটক আশা করছেন ?

প্রবীর কুমার সাহা: বাংলাদেশে মূলত পর্যটন মৌসুম শুরু হয় নভেম্বরের শেষের দিক থেকে। আর এটা চলতে থাকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত মানুষের যে সাড়া পাচ্ছি, তা নিঃসন্দেহে সন্তোষজনক। তবে পর্যটন কেন্দ্রে মানুষের প্রবাহ চলতি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে বেড়েছে বলে যোগ করেন তিনি। এ সময়টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস বন্ধ থাকে। তাই মানুষ পরিবার, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে আসছে। 

ইটিভি অনলাইন: ড্রিম হলিডে-তে এমন কি আছে, যা অন্য পর্যটন কেন্দ্রে নেই?

প্রবীর কুমার সাহা: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ড্রিম হলিডে পার্ক। প্রায় আড়াইহাজার শতাংশ জমির উপর ২০১১ সালে এ বিনোদন পার্ক গড়ে তুলি। পার্কটিকে অনন্য সাধারণ করে গড়ে তোলার জন্য এতে ২০টি ভূত স্থাপন করা হয়েছে। যা দেখতে অনেকটা জ্যান্ত, কারণ এগুলো কখনও ভয়, কখনও আনন্দে মাতিয়ে রাখে শিশু-কিশোরদের। এছাড়া এখানে রয়েছে ওয়েবপুল। যেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কান পাতলেই শোনা যাবে সমুদ্রের গর্জন। প্রকৃতির এক অপরূপ ছোঁয়ায় মনমাতানো পাহাড়ি ঝর্ণায় আপনি হারিয়ে যেতে পারেন। বেশকটি কটেজ রয়েছে, যেখানে পর্যটকরা থাকতে পারবেন। এছাড়া রয়েছে অত্যাধুনিক সুইমিংপুল, এয়ার বাইসাইকেল, বাম্পারকার, সোয়ানর্বোড, ওয়াটারর্বোড, অত্যাধুনিক রোলার কোস্টার, ডেমুট্রেন,সুইংচেয়ার, স্পিডবোট, বাচ্চাদের অতিপ্রিয় নটিক্যাসেল, জাম্পিংহর্স, বসানো হয়েছে ফারকিংসহ বিভিন্ন রাইড। পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে আইস পাহাড়, যা দেখতে কাশ্মীরের পাহাড়ের মতো মনে হবে।

ইটিভি অনলাইন: পর্যটন খাতে কি পরিমাণ ভ্যাট দিতে হয়? এটি কি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

প্রবীর কুমার সাহা: পর্যটন খাতে বর্তমানে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। তবে দেশীয় পর্যটকদের উপর যে হারে কর আরোপ করা হয়, বিদেশীদের ক্ষেত্রেও তার সমান কর আরোপ করা হয়েছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে পর্যটন কেন্দ্রগুলো একেবারে ফ্রি করে দেওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বে পর্যটন খাতে ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের কোন ধরণের ফি ছাড়াই বিনোদন কেন্দ্র গুলোতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ১০ বছরের কম শিশুদের সেখানে প্রবেশে কোন ধরণের ফি দিতে হয় না। আমাদের দেশেও সরকার যদি এদের ক্ষেত্রে প্রবেশ ফি বাদ দিয়ে দেয় তাহলে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ব্যাপকহারে লোকজন আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

ইটিভি অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।

প্রবীর কুমার সাহা: ইটিভি অনলাইনকেও ধন্যবাদ! ইটিভি অনলাইনের প্রতি শুভ কামনা রইলো।

/ এআর /