ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ পর্ব-০১

জাফর ইমাম বীর বিক্রম

প্রকাশিত : ০৪:৪২ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৩৩ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮ শনিবার

জাফর ইমাম বীর বিক্রম

জাফর ইমাম বীর বিক্রম

আমি ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। ১৯৭০ সালে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় অফিসার হিসেবে ৯ম এফ এফ পদাতিক রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলাম।তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত।৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুস্থানসহ ’৭০ এর নির্বাচনকে ঘিরে তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) সর্বত্র চলছিল নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা। আমরা সেদিন পাকিস্তানের বৃহত্তম সেনানিবাস লাহোর ও পিন্ডির মাঝামাঝি খারিয়ান সেনানিবাসে অনেক বাঙালি অফিসার ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় নির্মিত এ্ই সেনানিবাসে আমি যে ব্লকে থাকতাম সেখানে অনেকের মধ্যে আমরা ৪-৫ জন বাঙালি অফিসার এক সাতে থাকতাম । তারা হলেন- ক্যাপ্টেন সালেক (বীর উত্তম)ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন( বীর প্রতীক), ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও আমি নিজে। আমরা যখন প্রায়ই একত্রিত হতাম, তখন আমরা বঙ্গবন্ধুর নের্তৃত্বে পরিচালিত বাঙালিদের অন্দোলনের স্বপক্ষে আলাপ-আলোচনা করতাম ।ঐ সেনানিবাসসহ পাকিস্তানের অন্যান্য সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি অফিসাররা / সৈনিকরা আমাদের প্রতি পাকিস্তানিদের বৈষম্য সম্পর্কে আলোচনা করে তৎকালীন চলমান আন্দোলনের পক্ষে কথা বলত। তবে এই আলাপ-আলোচনা ছিল খুব ঘরোয়া পরিবেশে সীমাবদ্ধ । তার পরেও পাকস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের অনেকের ব্যাপারে গোপনীয় প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন আকবর ও ক্যাপ্টেন সালেকসহ আমরা যখন ঘরোয়াভাবে গোপনীয়ভাবে আলোচনা করতাম তখন তাঁরা পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। আমরা তিন জন তখন থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশে বদলি হয়ে আসার জন্য সনস্থির করে কৌশলে নানা ধরনের চেষ্টা তদরিব শুরু করেছিলাম। আমার ইউনিটের অধিনায়ক আমার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এ.সি.আর) ঐ বছরে রিপোর্ট উল্লেখ করেছিলেন- “ This officer has got a trend of provincialism in his mind. He can slip off the track any time if not guieded properly.”

আমার সি.ও একজন পাঠান ছিলেন । পাঞ্জাবিদেরকে খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না । আর আমার এ.সি. আর রিপোর্টটি যদি সামরিক হেডকোয়ার্টার পিন্ডোতে পাঠাত তহলে আমার চাকরি থাকত না । আমার সি.ও আসলে একজন বড় মনের লোক ছিলেন । আমি তাকে অনকটা কাকুতি-মিনতি করে বুঝিয়ে বললাম- এ রিপোর্টের পরিণতি । তিনি এক পর্যায়ে আমাকে কিছু উপদেশ দিলেন যে সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায়া যেন কোনো রাজনীতি না করি অর্থাৎ কোনো পক্ষ বিপক্ষ না নিই এবং অহেতুক কোনো আলোচনা –সমালোচনায় জড়িত না হই । তিনি আমার এ.সি. আর এর ভাষা পরিবর্তন করে নতুন এ.সি. আর দিলেন আমার স্বাক্ষরের জন্য । সেদিন আমি তাকে অনুরোধ করে এসেছিলাম অমাকে যেন পূর্ব পাকিস্তানে বদলির জন্য তিনি সুপারিশ করেন।’৭০-এর শেষের দিকে আমরা সবাই পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়ে আসলাম। আমার পোস্টিং ছিল কুমিল্লায় । ’৭০-এর শেষ থেকে নিয়ে ’৭১ এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আমাদের প্রতি তথা বাঙ্গালিদের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল । আমরা এও লক্ষ করলাম সেনাবাহিনীতেও ভেতরে ভেতরে তারা গোপনীয়ভাবে একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । তারা বাঙালি অফিসারদেরকে তখন থেকে বাঁকা চোখে দেখছিল এবং কড়া গোয়েন্দা নজরদারিও চালিয়ে যাচ্ছিল । পুরো মার্চ মাস ব্যাপী আমরা দেখেছি তারা যেন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুরো মার্চ মাস ব্যাপী অমাদের বাঙালি  অফিসার ছিলেন । তার মধ্যে ক্যাপ্টেন মাহবুব (বীর উত্তম) মার্চের মাঝামাঝি ছুটিতে গিয়ে আর ফিরে না এসে প্রথমে দিনাজপুর পরে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। কানাইঘাটে যেখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। সে স্থানের নাম রাখা হয় মাহবুবনগর । আমি পাকিস্তান আর্মির ২৫ ক্রেক ডাউনের কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা পুরান এয়ারপোর্ট থেকে পালিয়ে ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন সালেক, আমিনুল হকসহ আমরা ৪ জন পাদাতিক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি ।আমার এ বইয়ের “রণাঙ্গনের এক প্রান্তর” অধ্যায়ে বিস্তারিত রয়েছে।

যখনই চেতনার কথা চিন্তায় আসে, তখনই স্মৃতির পাতায় ভেসে আসে সেই যুদ্ধকালীন দিনগুলো । সেদিন বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ ঝঁপিয়ে পড়েছিল । আর আমি তাদের সাথে কাধেঁ কাধঁ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি।, রণাঙ্গন তাদের নের্তৃত্ব দিয়েছি।

লক্ষ্য একটাই দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করব।তাই এ যুদ্ধ ছিল আমাদের গর্ব ও অহংকারের। আমরা চেয়েছিলাম নিজেদের হাতে দেশকে গড়ে তুলব। যেখানে থাকবে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি দলমত বির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল(স্বাধিীনতা বিরোধীরা ছাড়া) । বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, শত্রুর মোকাবেলায় পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে । এই মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে তাঁর নের্তৃত্বে একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ ছিল। তারই অনুপ্রেরণায় যুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা হাজারো মায়ের কান্না, শিশুর আর্তনাদ ও বোনের হাহাকারের শোধ নিতে শত্রুর মোকাবেলা করেছিলাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতা ইতিহাসখ্যাত চিঙ্গিস খানের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল । যে কারণে মুক্তিযুদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের সংকল্প আরও তীব্রতা লাভ করেছিল। গোটা বাংলাদেশই তখন ছিল রণাঙ্গন । আমরা গেরিলারা যথন শত্রু নিধনে ছড়িয়ে পড়েছিলাম, তখন পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের নিরীহ বাঙালির উপর চালানো আত্যাচারের চিত্র মুক্তিযোদ্ধারদের শত্রু আক্রমণে আরও বেপরোয়া করে তুলত। আরও শণিত করত আমাদের যুদ্ধজয়ের চেতনা।

সেদিন আমারা বাংলার মাঠে-ঘাটে, নদীতে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি নীরিহ বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী-বৃদ্ধ ও শিশুর অগণিত পরিত্যক্ত লাশ। এ ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মম নির্যাতনের এক বেদনাদায়ক চিত্র। দেখেছি স্বজনহারাদের অসহায় আর্তনাদ ও আহাজারি । মা-বোনের চোখে দেখেছি নির্বাক অশ্রু। এর মধ্যেই এরাই মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিল খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয় ও সহায়তা। সেদিন মা-বোনেরা জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে দোয়া ও নিভৃত অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন। একটা অপারেশন শেষ করার কিছু দিন পর আমরা যখন ওই এলাকায় যেতাম, তখন খবর নিয়ে জানতে পারতাম, পাক হানাদার বাহিনী ও তাদরে এ দেশীয় দোসররা ওই  এলাকায় কারো বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছি, কোথাও মা-বোনদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, কোথাও বা উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাদের । এর পাশাপাশি চালিয়েছিল গণহত্যা । এটা ছিল তখন গোটা বাংলাদেশ তাদের নিত্যনৈমিত্যিক অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার দৃশ্য । তাই কত বীরের রক্তধারা, কত মায়ের অশ্রু, হাজারও বোনের হাহাকার, শিশুর আর্তনাদ আর এতিমের ঝাপসা দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন এই ত্যাগের সংগ্রামী ঐতিহ্য।

প্রতিরোধ যু্দ্ধ কিন্তু ২৫ মার্চ রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ , আনাসার ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা, ছাত্র জনতা, কৃষক , শ্রমিক তথা সর্বস্তরের জনগণ একাকার হয়ে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই নিজ নিজ এলাকয় দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল প্রেরণার মূল উৎস।এ প্রতিরোধ যুদ্ধের  ধারাবাহিকতায় প্রায় দু’সপ্তাহ সময়কালের মধ্যে একই উদ্দীপনা ও বুক ভরা সাহস ও শপথ নিৃয়ে পদার্পণ করল পরিকল্পিত স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল পর্বে ।

 গেরিলা কায়দায় অ্যামবুশ, রেইড, গ্রেনেড অ্যাকশন, অনেক সময় সম্মুখ আক্রমণ সংঘবদ্ধভাবে বেড়েই চলছিল। আমার নের্তৃত্বে বৃহত্তম নোয়াখালীর(ফেনী,নোয়াখালী, লহ্মীপুর) গেলিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের কিছু বিবরণ এ বইয়ের রণাঙ্গনে এক প্রান্তর অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে।

রণাঙ্গনে সকল শহিদদের আমি এখনও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি । শহিদদের স্বপ্নসাধ এখনও বাংলাদেশে পুরো বাস্তাবয়িত হয়নি। আমরা সহযোদ্ধারা এখনও তাদের অর্তনাদ শুনতে পাই । তারা সেদিন আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছিল “ আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করলাম, তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য- ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে এখথা শুণাবে ।” এই শহিদদেরও একটি ভবিষ্যৎ ছিল । তাদেরও পরিবার-পরিজনকে নিয়ে সুখী সমৃদ্ধ জীবন-যাপনে একটি লালিত বাসনা ছিল। তারা দেশকেও ভালোবাসত, নিজের হাতে নিজের দেশকে স্বপ্নের মতো গড়ে তুলবে-এটাই ছিল তাদের তাদরে প্রত্যাশা । মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি ”-এই ছিল তাদরে দৃপ্ত শপথ । আজ তারা আমাদের মাছে নেই, তাই স্বাভাবিভাবে প্রশ্ন জাগে, আমাদের নিজের বিবেকের কাছে এই শহিদদের অর্পিত দায়িত ও তাদের স্বপ্নসাধ আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। সামাদ ছিল একজন ছাত্র। তার নের্তৃত্বে প্রশিক্ষিত ৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অক্টো/নভেম্বরের দিকে বিলোনিয়া রণাঙ্গণে আমার নিকট রিপোর্ট করে । আমি তাদরকে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলে রেজিমেন্টের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ,  আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ  মিলে প্রায় ২ হাজার যোদ্ধা ছিল । আমার অদিনায়কত্বে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পাইনোওনিয়ার প্লাটুনসহ শত শত গণযোদ্ধা ছিল । সেদিন আমি সামাদকে দেখেছি সব সময় হাসিখুসি থাকতে, তাবে দায়িত্ব পালনে সে ছিল নির্ভীক এক সাহসী দুর্ধর্ষ যোদ্ধা । আমি যখন কোনো শত্রুর অবস্থান রেকির জন্য যেতাম অনেকের মধ্যে আমি সামাদকেও নিয়ে যেতাম। প্রায়ই অবসরে তার সাতে কুশল বিনিময় করতাম। একদিন সে অমাকে বলেছিল- বাড়িতে তার বাবা-মায়ের সাথে এক ছোট বোন ও এক ভাই আছে। বাড়ি তার সেনবাগ ।

তার আশা ছিল যুদ্ধ শেষে সে ফিরে যাবে তার বাবা-মা ও আদরের ছোট ছোট বোনের কাছে। যুদ্ধে যোগদানের জন্য মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার সময় তারা তাকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করেছিল এবং বাড়ি ছেড়ে আসার প্রাক্কালে তার ছোট ভাই-বোনেরা তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল ।রণাঙ্গনে আলাপকালে সেদিন সে অমাকে অগ্রিম দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল এবং আবদার করে অনেক আগ্রহ সহকারে বলেছিল, স্যার-যুদ্ধ শেষে আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। তার কিছু দিন পরে আমাদের দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে কয়েকজন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও গণযোদ্ধাদের সাথে সামাদকে পশুরাম ও চিতোলিয়ার শত্রুর অবস্থান রেকি / পরিদর্শন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। শত্রুর অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই এ রেকি দলচি শত্রুর পক্ষের এ্যাম্বুসে পড়ে । শুরু হয় চারদিক থেকে গোলাগুলি। সামাদ তার দলের বাকি সদস্যদেরকে বাঁচানোর জন্য তার নিজে অবস্তান থেকে  কাভারিং ফায়ার দিচ্ছিল । অ্যাম্বুস শত্রু পক্ষের অনেকেই হতাহত হয়েছিল। সামাদের অসাধারণ সাহসী ভূমিকায় আমাদের রেকি দলের বাকি সদস্যরা কাভারিং ফায়ারের বদৌলতে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। তখন বাকিরা কিছুটা কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করে শত্রু পক্ষকে সম্পূর্ণভাবে ঘায়েল করতে সক্ষম হয়েছিল। শত্রু পক্ষের আশাপাশির ঘাঁটি থেকে আগত আরেকটি দলের আক্রমণের মুখে পড়ে । সামাদ তাদেরকেও প্রতিহত করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছিল এবং বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শেষ বিদায় নিল। সামাদের আর ফিরে যাওয়া  হলো না মা-বাবার কোলে, চিরতরের জন্য বঞ্চিত হলো তার ভাই-বোন তার আদর থেকে।

আসলে যুদ্ধের সময়কালে প্রায় রণাঙ্গনে আমাদের অনেক সংরক্ষিত রেকর্ড ধ্বংস বা হরিয়ে গিয়েছিল। যে করণে আমি অনেক খুঁজেও তার সন্ধান পাইনি। প্রায় তিন যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরে সামাদের এক চাচার সাথে আমার পরিচয় হয়, সে সুবাদে তিনি আমার মুখ থেকে যুদ্ধে নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক শহিদদের বিবরণ মন দিয়ে শুনেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি আমাকে খুব মৃদুস্বর জিজ্ঞেস করলেন- স্যার আপনি সেনবাগের সামাদকে চিনতেন? জবাবে আমি বললাম- আপনি কি করে তাকে চিনেন ! (তিনি সামরিক বাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্মকার্তা ছিলেন) তিনি অমার থেকে সামাদ সম্পর্কে বিস্তরিত শুনে বললেন-স্যার, এ সেই আপনার সামাদ । তিনি আরো বললেন-এখন তার বাবা-মা কেউ বেচেঁ নেই । তারা অনেকদিন ধরে তার পথ চেয়ে আসার অপেক্ষায় ছিল । দু:খিনী মা-বাবা তাকে না দেখেই চলে গেলেন। তার ছোট ভাই-বোন এখনও জীবিত আছেন । সামাদের ছবিটি অঁকড়ে ধরে এখনো তারা নিভৃতে কাঁদে । হয়তো যে কোনো মুহূর্তে তাদের ভাই বাড়ির আঙিনায় এস তাদের নাম ধরে ডাকবে । এ আশা বুকে নিয়ে তারা এখনও আমরা দেখা করতে গেলে তারা অশ্রুজল নয়নে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । তার চাচা আমকে বলল- স্যার সামাদের নামে তার নিজ এলাকায় একটি লাইব্রেরি / একটি স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণ করা যায় না ? সামাদ ছিল অবিবাহিত যুবক । পুরো বাংলাদেশে এ ধরণের হাজার হাজার গণযোদ্ধা শহিদ সামাদ রয়েছে। এদের মধ্যে শহিদের খাতায় অনেকের নাম উঠেছে, অনেকের নাম এখনও তালিকাভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এদের মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশই ছিল গণযোদ্ধা । এদেরকে এখন যদি শহিদ ভাতা দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে তা ভোগ করার কাজে কেউ নেই । তাই এদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তাদের নিজ নিজ এলাকায় স্মৃতিস্তম্ভ বা অন্য কোনো মহতী উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে এখনও আমাদের করণীয় রয়েছে।

শহিদ হাবিলদার নুরুল ইসলাম  (বীর বিক্রম)

ফেনীর মুন্সিরহাট যুদ্ধে মুক্তারবাড়ি পুকুর পাড়ে আমার বাঙ্কারের পাশে আরেকটি বাঙ্গারে ছিলেন হাবিলদার নুরুল ইসলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে একজন চৌকস সেনাসদস্য ছিলেন। এ যুদ্ধে আমরা ফেনী শহরের উপকন্ঠে শহরের দিকে মুখ করে পরিখা খনন করে ৩-৪ মাইল দীর্ঘ নিজস্ব ডিফেন্স গড়ে তুলেছিলাম। আমাদের লম্বা এই ডিফেন্সের সামনের দিকে ৮০০ গজ পর্যন্ত ঘন মাইন্ড ফিল্ড গড়ে তুলেছিলাম। প্রায় দু’মাসের ও অধিককালে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। এ যুদ্ধে পাকিস্তান তাদের ট্যাংকবহর অর্টিলারি থেকে নিয়ে অমাদের অনেক পিছনে হেলিকপ্টার থেকে কমান্ডো অবতরণসহ অনেক রণ-কৌশল ব্যবহার করেছিল তারা এ সময়ের মধ্যে ৯-১০ বার আমাদেরকে ট্যাংকসহ সম্মুখ অক্রমণ করেছিল। তারা যখন সম্মুখ আক্রমণে আমাদের মাইন্ডফিল্ডে ঢুকে পড়ত তখনেই মাইনগুওল খৈইয়ের মতো ফুটত। আমাদের সম্মুখে ৩-৪ মাইল ডিফেন্স থেকে তখন অন্যান্য অস্ত্রের সাথে গর্জে উঠত এলএমজিও এসএমজি। আমার বাঙ্গার থেকে অদূরে পুকুরের এক কোনায় ছিল সমান্তরাল রেখা বরাবর হাবিলদার নুরুল ইসলাম এর এলএমজির পোস্ট এবং পাশে ছিল সার্জেন্ট সাহাবউদ্দিনের আরেকটি এলএমজি পোস্ট । দু’পক্ষে থেকে আবার চলত কাউন্টার আর্টিলারি ফায়ার । এ দু’সাসের অধিককাল সমেয়ে এই আক্রমণগুলোতে পাকিস্তানের ৩০০শোর অধিক হতাহত হয়েছিল। হাবিলদার নুরুল ইসলাম যখনই সময় পেতেন এবং দু’পক্ষের আক্রমণ ও ফায়ারিং বন্ধ থাকত তখন তিনি ডিফেন্সের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন আর সবার খোঁজ-খবর নিতে এবং সাহস যোগাতেন । একদিন পাকিস্তানিদের তীব্র ও সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে আমাদের পাল্টা আক্রমণ প্রায় প্রতিহত ও পর্যদস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক ঐ মুহূর্তে শত্রপক্ষ নুলুল ইসলাম ও সহাবউদ্দিনের বাঙ্গার বরাবর অনেক কাছাকাছি চলে আসে তখন নুরুল ইসলাম খুব ক্ষীপ্রতার সাথে তার মোকাবেলা করতে থাকেন। শত্রুপক্ষ পিছনে হটে যেতে বাধ্য হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের বৃষ্টির মতে আর্টিলারি ফায়ার শুরু হয়। এক আর্টিলারি সেলের আঘাতে হাবিলদার নুরুল ইসলামের শরীরের নিচ অংশ ক্ষত- বিক্ষত হয়ে যায় এবং অবিরাম রক্তক্ষরণ হতে থাকে । ঐ দিকে পাশে সার্জেন্ট সাহাবউদ্ধিন তার একটি পা হারান। হাবিলদার নুরুল ইসলামকে আমার বাঙ্কারের নিচে পুকুরের ঘাটে নিয়ে আসা হয় । তার রক্তক্ষরণ সেদিন সেই ছোট পুকুরের পানি লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। নুরুল ইসলাম কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের থেকে চির বিদায় নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি কান্নাজাড়িত কন্ঠে বলে গেলেন স্যার-স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না, আপনারা চালিয়ে যান। একটু দূরে আমাকে মসজিদটির পাশে রাখবেন। জয় বাংলা বলে সর্বশেষে কালেমা পড়ে তিনি আমাদের থেকে বিদায় নিলেন্ আমরা সবাই তাকে বশিকপুর গ্রামের মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করি।

গণযোদ্ধা শহিদ কাচি

হাবিলদার ইউনুছসহ যাচ্ছিল এক অ্যাম্বুস অভিযানে। এই প্লাটুনের কমান্ডার ছিল গণযোদ্ধা শাখি । তারই প্লাটুন হাবিলদার ছিল ইউনুছ। কোম্পানি কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মোখলেছুর রহমান। সেদিন এ প্লাটুনটি ভারতীয় সীমান্তের পাশে বাংলাদেশের সিলোনিয়া নদী অতিক্রম করে ঘোষাইপুর গ্রামে হয়ে ফুলগাজির নিকটবর্তী তাদের টার্গেটে যাওয়ার কথা । এ প্লাটুনে প্রায় বেশিরভাগ ছিল গণযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা মোসলেউদ্দিন কচি ফেনী করেলজের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল । তার সাথে আরো ছিল মুক্তিযোদ্ধা (ছাত্র-মনিক, আজিজ আরো অনেকে) । নদী অতিক্রম করার পরে টার্গেটে পেীঁছার আগেই ফুলগাজির ঘোষাইপুর গ্রামে পাকিস্তানিদের এক অ্যাম্বুসের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে যায় । তখন দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ছিল ফেনীর ছেলে তাই ঐ এলাকা তারা চিতন। এ সংঘর্ষ শুরু হয় মধ্যরাতে এবং চলে ভোর পর্যন্ত । এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা চার ভাগে বিভক্ত ছিল। কচির সাতে যারা ছিল, যেহেতু এলাকার ভৌগলিক  অবস্থান জানা ছিল । কচির সাথে যারা ছিল, যেহেতু এলাকার ভৌগোলিক অবস্থঅন জানা ছিল, তারা রাতে অন্ধকারে ক্রলিং করে সুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর একটা অংশকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। রাত খথন প্রায় শেষ হয়ে আসছিল । কচির গ্রুপটি কৌশলগতভাবে স্থান পরিবর্তন করে তার প্লাটুনের বাকিরা যেন শত্রুর অবরোধ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য কবারিং ফায়ারের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টি করে । ভোরে তার প্লাটুনের বাকি তিন গ্রুপ ভোরের মধ্যে অবরোধ থেকে বেরিয়ে সিলোনিয়া নদী অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে ভাতরীয় গাবতলী এলাকায় চলে আসে। এর মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে শত্রুর ওপর আর্টিলরি ফায়ার শুরু করি যেন কচি গ্রুফ নিরাপদ আসতে পারে। কচি গ্রুপ ও তাদের পক্ষ থেকে ফায়ার করতে করতে নিরাপদ অবস্থানে চলে আসে । তখনও কচি শত্রুর ওপরে তার ফায়ার অব্যাহত রাখে যেন তার সঙ্গীরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করতে পারে। তার বাকি সঙ্গীরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করে ফেলল কিন্তু কচি শেষ মুহূর্তে নদী অতিক্রম করার সময় শত্রু পক্ষের ব্রাশ ফায়ারে চরমভাবে আহত হয়। তার সঙ্গীরা কচিকে আহত অবস্থায় সীমান্তের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় । এ খবর শুণে আমি রণাঙ্গনের অন্য প্রান্ত  থেকে ছুটে আসি তখনও কচি জীবিত ছিল। আমি ‍এসে কচিকে সান্ত্বনা দিলাম এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম । এরই মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরনে কচি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসল এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমাদের থেকে চির বিদায় নিয়ে গেল। পরি আমরা তাকে সীমান্ত সংলগ্ন কালা পীর মাজারের কাছে সমাহিত করি।

শহিদ এয়ার আহম্মদ (বীর বিক্রম)

নভেম্বরের অন্ধকার শীতের রাত। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েছিল। হিমেল হাওয়ায় গাছের পাতায় যেন একটি শরীরী শব্দ সৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সমস্ত রাতটা যেন কোনোকিছুর প্রতীক্ষায় আছে। রাত আনুমনিক ১০-৩০ মিনিট। আমাদের অনুপ্রবেশের কাজ শুরু হলো। আমরা এমন একটা এলাকা ঘেরাও করার অভিযানে নেমেছি যার তিন দিকই ছিল ভারত –সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত । আমরা তাই ভারতের এক প্রান্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম-চিথলিয়ার মাঝে দিয়ে অগ্রসর হয়ে ভারত-সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের এ অবরোধ যদি সফল হয় তবে শত্রুরা সহজেই ফাঁদে আটকা পড়বে।

অবরোধের কাজ শুরু হলো । অন্ধকার রাতে মুহুরী নদী ও ছিলনিয়া নদীর কোথাও বুকপানি, কোথাও কোমরপানি, কোথাওবা পিচ্ছল রাস্তার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি সবাই । সে একবিচিত্র অভিজ্ঞতা! অন্ধকার রাত। সামান্য কাছের লোককেও ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না । কমান্ডার হিসেবে সবাইকে সুশৃঙ্কলভাবে পরিচালিত করে আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যস্থানে পৌঁছানো সত্যই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল । তবুও সব বাঁধাকে তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চললাম এবং সাথে আমি আমার দলের অন্যান্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চললাম। প্রথমে মুহুরী নদী অতিক্রম করলে লে. মিজানুর রহমানের নের্তৃত্বে ‘বি’ কোম্পানি’ ও লে. দীদারের নের্তৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানি। লে. মোখলেসুর সহমান সমর্থনের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই দুই কোম্পানির পরে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টার কোম্পানি ও ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আগত ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদের নের্তৃত্বে আর একটি কোম্পেইনসহ আমি নদী অতিক্রম করে সবাই পূর্বনির্ধারিত এলাকার অবস্থান গ্রহণের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখি। ওই দিকে লে. ইমাম-উজ-জামান-এর নের্তৃত্বে  ‘এ’ কোম্পানি চিথলিয়া ঘাঁটিটি বরাবর রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ও ২য় ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানিরি সঙ্গে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হতে থাকে । নি:শব্দ হয়ে সবাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শত্রুরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না যে ওদেরকে জালে আটক করার জন্য আমরা এগিয়ে আসছি।

শত্রুরা যদি আমাদের এ অনুপ্রবেশ টের পায় তবে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে, করণ যুদ্ধক্ষেত্রে গোপন অনুপ্রবেশ যদি অপরপক্ষে টের পায় তবে পরিকপ্লিত অভিযান সফল করা সম্ভব হয় না। আমরা আরও অনেক পথ এগিয়ে এলাম। তবে অন্ধকার রাতে নির্ভুল পথে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল । এ ছাড়া আরও একটি ভয়ের সম্ভাবনা ছিল । শত্রুপক্ষের রোকেরা রাতে বিভিন্ন জায়গায় পেট্রোলিং-এ ছিল। তাদের খপ্পরে পড়াও বিচিত্র ছিল না। সে ভয় আমাদের অমূলক ছিল না । আমরা যখন রেলওয়ে ও কাঁচা রাস্তার কাছাকাছি এগিয়ে এলাম তখনই দেখলাম শত্রুপক্ষের ডিউটিরত একটি দল রেললাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা সন্তর্পণে লুকিয়ে গেলাম- কেউবা রাস্তার আড়ালে, কেউবা জমিনের আইরে আড়ালে । ওরা কিছুই টের পেল না। নিশ্চিত মনে গল্প করতে করতে চলে গেল, বিপদ কেটে গেল । এদিকে রাত বাড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার কোম্পানি কমান্ডারদের সাথে যোগোযোগ করলাম- ওরা জানাল, সব ছিক আছে। ওরা নিরাপদেই অবরোধের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । ভোর হবার বেশি বাকি নেই। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে হাজির হলাম এবং এর ফলে শত্রুদের পরশুরাম ও বিলোনিয়া ঘাঁটি পুরোপুরি আমাদের অবরোধের মাঝে অটকা পড়ল।

শত্রুদের চিথলিয়া ঘাঁটির দিকে থেকে যাতে কোনো প্রকার আক্রমণ না আসতে পারে তার জন্য আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। ভোর হয়ে আসছিল। আমরা প্রতিরোধের সকল ব্যবস্থাও করতে লাগলাম। পথশ্রমে ও ক্ষুধার তাড়নায় সবাই ক্লান্ত । তবুও বিশ্রামের সময় নেই। ভোরের আলো ফুটবার আগেই প্রতিরোধের কাজ শেষ করতে হবে। তাই প্রাণপণে সবাই কাজ করতে লাগলাম। ভোর হলো । আমরাও সম্পূর্ন প্রস্তুত হয়ে গেলাম । শত্রুরা আমাদের অবরোধের মাঝে। এই সফলতার খবরটা জেনারেল হীরাকে জানাতে ইচ্ছে হলো। ওয়্যারলেসে জেনারেণ হীরাকে জানালাম যে, শত্রুকে আমরা পুরোপুরি জালে আটকিয়েছি। খাবরটা শুনে জেনারেল হীরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন । ধন্যবাদ দেবার সময় খুশিতে তাঁর কথা আটকে যাচ্ছিল । আমি আমার চ্যালেঞ্জে জিতেছি বললে জে. হীরা ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানালেন। এদিকে ভোরের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। ভোরের আলোয় চারদিকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। তারপর বুঝতে চেষ্ট করলাম যে, শত্রুরা আমাদের অনুপ্রবেশ টের পেয়েছে কি না। কিন্তু না, তা বোঝার কোনো উপায় নেই, চারদিক নীরব। কোথাও মানুষের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

বিলোনিয়া থেকে রেললাইনের সাথে সমান্তরালভাবে একটি কাঁচা রাস্তারও চলে এসেছে ফেনী পর্যন্ত । এই রাস্তার পাশেও আমাদের বেশ কিছু বাঙ্কার গড়ে উঠেছে। বাঙ্কারে বসে সবাই সমানের দিকে চেয়ে আছি। বেশ কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎ দূর থেকে একটা ট্রলির আওয়াজ অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। শব্দটা চিথলিয়ার দিকে থেকেই আসছে বলে মনে হলো। রেললাইন ও রোডের কাছের বাঙ্কারে যারা ডিউটিতে ছিল তাদের মধ্যে হাবিলদার এয়ার আহম্মদ ছিল খুবই সাহসী। যুদ্ধের প্রথম থেকেই সে আমাদের সাথে থেকে নির্ভীকভাবে লড়াই করে আসছিল।

ট্রলিটা এগিয়ে আসছে। সবাই প্রতীক্ষায় বসে রইল। আস্তে আস্তে ট্রলির শব্দটা আরও কাছে এগিয়ে আসছে। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম, কয়েকজন সৈন্য বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা নিশ্চিন্ত মনেই আসছে। ওরা বুঝতে পারেনি যে ওদের শত্রু এত কাছে রয়েছে।

এক-দুই-তিন । সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরতে লাগল। ট্রলিটা একেবারে কাছে এসে গেল। এয়ার আোম্মদ ও তার সঙ্গীদের হাতের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। অনবরত ফায়ারিং-এর শব্দে চারদিকে মুখরিত হয়ে উঠল। শত্রুরা অনেকেই পালাতে চাইল, কিন্তু আমরা তা সম্ভব হতে দিলাম না। একজন শত্রুও প্রাণে বাঁচতে পারল না। আনন্দে এয়ার আহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে চিৎকার করে উঠল। উত্তেজনয় ও আনন্দে ওদের সারা শরীর কাঁপছিল । ফায়ারিং-এর শব্দ শুনে চিথলিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটির শত্রুরা মনে করল, তাদের ট্রলিটা হয়তোবা মুক্তিবাহিনীর কোনো গেরিল দলের হাতে পড়েছে। প্রকৃত অবস্থাটা তারা কিন্তু তখনও বুঝতে পারেনি। তখন দু’দিক থেকেই শত্রুরা আক্রমণ শুরু করল।

শত্রুর ফায়ারিং শুরু হওয়ার কিঞ্চিৎ আগেই এয়ার আহাম্মদ আনন্দে বাঙ্কার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল অদূরে পড়ে থাকা শত্রুদের মৃত অফিসারটির কাছে। গোলাগুলির সম্ভাবনার কথা সে যেন মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল। অফিসারটির পকেট থেকে সে পিস্তলটি উঠিয়ে নিল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে আসতে লাগল নিজ বাঙ্কারের দিকে। ঠিক তখনই শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিকে থেকে একটি বুলেট এসে বিধঁল এয়ার আহাম্মদের মাথায় । চোখের সামনেই দেখতে পেলাম ওর জায়ের অনন্দে উদ্দীপ্ত মুখটা। নিজের প্রাণ দিয়ে এয়ার আহাম্মদ শত্রুদের  ঘায়েল করেছে। কিন্তু এর শেষ দেখে যাওয়া তার কপালে রইল না।

৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে ফেনীর মাঝামাঝি স্থানে উত্তরে চিতলিয় ও দক্ষিণে চন্দনার ভেতর দিয়ে আমি ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নৈনিকদের নিযে অনুপ্রবেশ করি । শীতের সে রাতে গভীর বর্ষণ ও বজ্রপাত হচ্ছিল । আমরা চিতলিয়া, গুতুমা, সালিয়া, ধনিকুণ্ডা, চন্দনা এলাকায় একটি অভূতপূর্ব এবং বিস্ময়কর প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করি। একটি প্রতিরক্ষা উত্তর দিকে মুখ করে (যেদিকে পাকিস্তানি ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে রেজিমেন্ট ) অপরটি দাক্ষিণ দিকে অর্থাৎ ফেনীর দিকে মুখ করে ( যেদিকে ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট)। পাকিস্তানিরা সকল অর্থেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরাজয় ছাড়া তাদের আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ১০ নভেম্বর ১৬ বালুচের একজন ক্যাপ্টেন ৭২ জন সৈন্যসহ আত্মসমর্পন করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল তখন শিখরে। এখন দক্ষিণে ‍ফুলগাজি, মুন্সিরহাট, বন্দুয়া হয়ে ফেনী দখল করা । আমাদের হারুন সব সময়, সব কিছুতেই সিরিয়াস।লেখাপড়া, নামজে-কালামে তার বিশেষ মনোযোগ । মন্দ কিছুর জন্য তার জন্মই হয়নি। অযথা বেশি ঝুঁকি নিতে মানা করে বন্ধুরা । বলে, মরেই যদি যাস, তবে আরেকটা যুদ্ধ করবি কীভাবে?

ফেনীমুখী অগ্রাভিযানের আগে প্রথম কাজ পাকিস্তানের পুঁতে যাওয়া পথের মাইন অপসারণ করা । হারুন তার কমান্ডার গোলাম মুস্তফাকে বলে, মুতিরহাট হয়ে যখন যাব, তখন একটা মিনিট আমাকে দিয়ো। একটু মাকে দেখে আসব। মুস্তাফা হাসিমুখে সায় দেয়। গ্রামের কচিঁ, খুন্তা দিয়ে মাইন তোলা । প্রায় সবাই পিণ্ড!নন-ডিটেক্টেবল অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন। সেদিনই (১০ নভেম্বর) চিতলিয়া রেলস্টেশনের লাইনের ওপর বিকট শব্দে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়।

রেল লাইনের পাথরগুলো গুলির বেগে ছুটে গিয়ে আহত করে সহযোদ্ধা মুস্তফা, শহিদসহ আরও অনেককে । তারা রক্তাক্ত হয় । দেখা যায় হারুন ‘মা-রে, অ-মা’ বলে চিৎকার দিয়ে চিতিয়ে পড়ে আছে। ডান পায়ের গোড়ালি ওপর থেকে উড়ে গেছে । পায়ের উপরের অংশের মাংস চিরে ঝুলে আছে। সেদিনই তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ১২ নভেম্বর তাকে স্থানান্তরিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মিত হাসপাতাল বিশ্রামগঞ্জের বাংলাদেশ হাসপাতালে। হারুনের পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়।

হারুনের নিয়তিতে মায়ের শেষ দর্শন ছিল না। হারুন মারা যায় বহু কষ্টভোগের পর । কবে, আমরা জানি না।  

লেখক: জাফর ইমাম, বীর বিক্রম

** লেখকের দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা বই থেকে নেওয়া।

 / এম /