ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘বছরে বাজেট পরিমাণ অর্থ আসতে পারে সমুদ্র থেকে’

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৩:২৫ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:৩৭ পিএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরণের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠারও অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।

এ বিপুল সমুদ্র সম্পদকে ঘিরে বাংলাদেশের এ অসীম সম্ভাবনার বিষয়ে সম্প্রতি কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও ইন্টারন্যাশন্যাল সেন্টার ফর অসিয়ান গভর্নে্ন্সের (আইসিওজি) পরিচালক অধ্যাপক ড. কাওসার আহমেদ এর সঙ্গে। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের সামুদ্রিক অঞ্চলে লিভিং ও নন-লিভিং রিসোর্স ছাড়াও বিপুল পরিমাণ ইকোসিস্টেম আছে। যেগুলো কাজে লাগাতে পারলে প্রতি বছরে-ই আমাদের বাজেট পরিমান অর্থ আসতে পারে শুধু সমুদ্র থেকেই। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। 

 একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কেমন আছেন?

কাওসার আহমেদ: হ্যাঁ, ভালো।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আপনার জায়গা থেকে সে সম্ভাবনাটা আসলে কতটুকু?

কাওসার আহমেদ: সমুদ্র বিজয়ের পর আমাদের সম্ভাবনাটা অনেক বেড়েছে। কেননা এ অঞ্চলে লিভিং ও নন-লিভিং রিসোর্স ছাড়াও বিপুল পরিমান ইকোসিস্টেম আছে। বর্তমানে গণমাধ্যমের এ যুগে সম্ভাবনার এ জায়গাটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। তবে ধারণা প্রসুত বা পার্শবর্তী দেশগুলোর গবেষণা থেকে এতটুকু বলা যায় যে, আমাদের সমুদ্রে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা কাজে লাগাতে পারলে সরকারকে রাজস্ব ঘাটতি বা রাজস্ব আহরণ নিয়ে এতো বেশি চিন্তা করা লাগবে না। কারণ এখান থেকেই প্রতিবছরে বাজেট পরিমান অর্থ আসতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমুদ্র অঞ্চলে আসলে কী ধরণের সম্পদ বা সম্ভাবনা আছে বলে আপনি মনে করেন?

কাওসার আহমেদ: সমুদ্র ঘিরে দুই ধরণের সম্ভাবনা আছে। একটা হচ্ছে রিসোর্সেস, অন্যটি হচ্ছে ইকো-সিস্টেম সার্ভিস। রিসোর্সকে আবার আমরা দুইভাগে ভাগ করে থাকি। একটা হচ্ছে লিভিং রিসোর্সেস আর একটা হচ্ছে নন-লিভিং রিসোর্সেস। নন-লিভিং রিসোর্সেস এর মধ্যে তেল, গ্যাস, বালু প্রভৃতি। লিভিং রিসোর্সের মধ্যে সমুদ্রে যতগুলো প্রাণী আছে সবগুলোই লিভিং রিসোর্সেস। তবে এসব লিভিং রিসোর্সেস এর মধ্যে আমরা চোখে যেটা দেখতে পায়- সেটা হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি।

এ লিভিং ও নন-লিভিং রিসোর্স ছাড়াও সমুদ্রে বিপুল পরিমান ইকোসিস্টেম আছে। যেমন সমুদ্রে জাহাজ চলাচল করে। জাহাজ চলাচলের বিষয়টি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া সমুদ্রে ব্যাপক ইকোসিস্টেম আছে। যেমন সমুদ্র ব্যাপক কার্বনডাই অক্সাইড শুষে নেয়। আবার সমুদ্রের পানিতে আছে অক্সিজেন। যা জীববৈচিত্র বাঁচতে সাহায্য করে। এছাড়া সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজারসহ সমুদ্রকে ঘিরে পর্যটনের মতো আরও অনেক সম্ভাবনা আছে।

সমুদ্রের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় এখন আমরা গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতে পারবো। যেটা আমরা ধরি না। আমাদের সমুদ্র অঞ্চলে মাছ চাষেরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা সেখানে ঝিনুক, মুক্তা, শৈবাল চাষ করতে পারবো।

এছাড়া সমুদ্র ঢেউ কাজে লাগিয়ে আমরা বিদ্যুৎও তৈরি করতে পারি। সমুদ্রের বাতাস থেকেও আমরা শক্তি তৈরি করতে পারি। অর্থাৎ রিনুয়েবল এনার্জির সিংহভাগই আমরা এখান থেকে পেতে পারি। যেগুলোর জন্য সরকার পরিকল্পনা করছে।

তবে সমুদ্রে কিন্তু এখনও আমরা কোন জরিপ করিনি। জরিপ না করেই যা বলা যায়, সেটা হলো সমুদ্রে তেলের সম্ভাবনার চেয়ে গ্যাসের সম্ভাবনা বেশি। সমুদ্রে আমাদের ২৮টি ব্লকের মধ্যে সম্ভবত একটা ব্লকের মধ্যে স্ট্যাডি হয়েছে। আর সবগুলোই স্ট্যাডি বাকী আছে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি স্ট্যাডি না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি বলতে পারছেন না, যে সমুদ্রে কী পরিমান গ্যাস আছে। তবে আমরা অনুমানের ওপর হয়তো কিছু বলতে পারি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে গ্যাস সংকট অনেক আগে থেকেই, সমুদ্র থেকে পাওয়া গ্যাসে কী আমাদের সে সংকট কাটবে বলে মনে করেন?

কাওসার আহমেদ: আপনি জানেন যে বর্তমানে আমাদের ল্যান্ডে গ্যাস আছে ১০ থেকে ১২ ডিসিএফ। প্রতিবছর আমরা ব্যবহার করি এক ডিসিএফ। তাহলে একটা বাচ্চাও সহজে বলতে পারবে যে আমাদের গ্যাসে আর মাত্র ১২ বছর চলবে। এখন ১২ বছর পর আপনি কী করবেন?

সে জন্য আমি বলি ১২ বছর পর গ্যাসের সংকট মোকাবেলায় যে পরিমান উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। সে পরিমান উদ্যোগ কর্তৃপক্ষ আগে থেকে নেয়নি। তবে বর্তমান সরকার যদি এখনও সমুদ্রে সম্ভাবনাময় গ্যাস কাজে লাগাতে কার্যকরী উদ্যোগ নেই, আমাদের গ্যাস সংকট অনেকটা দূর হতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমুদ্রে এ গ্যাস ও তেল আহরণে আমাদের দেশের সক্ষমতা আছে কী না?

কাওসার আহমেদ: সমুদ্রের এ বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে যে পরিমান জনসম্পদ আমাদের দরকার সে পরিমান দক্ষজনসম্পদও আমাদের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ে সর্বপ্রথম পাঠদান করছি আমরা। পাঁচ বছর আগে থেকেই এ পাঠদান চলছে। তবে এ ক্ষেত্রে এখনও আমাদের কোন গ্রাজুয়েট বের হয়নি। আশা করি এ ক্ষেত্রে অনার্স মাস্টার্স করে আগামী ২০১৮ সালে কিছু গ্রাজুয়েট বের হবে। এর আগে যারা বেরিয়েছে তারা সাধারণ মাস্টার্স পাশ করে বেরিয়ে গেছে। তিনটি ব্যাচে মোট ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো বের হয়েছে। কিন্তু তারা তেমন দক্ষ না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ কোথায় কোথায় আছে?

কাওসার আহমেদ: সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে। তবে সিলেট ও নওয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর থেকে পাঠদান শুরু হয়েছে। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় সবে শুরু করেছে। এদের তেমন এক্সপার্টিজও নেই। এখন এ ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে কিছু দক্ষ জনশক্তি আগামীতে বের হতে পারে।

 

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিষয়ে লেখা-পড়া একেবারেই শুরুর পর্যায়ে বলা যায়। তো এ শুরুর পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে আপনার সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ কতটুকু গুছিয়ে উঠতে পেরেছে?

কাওসার আহমেদ: হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ একেবারেই নতুন বলা যায়। সে জন্য আমাদের কিছু অসম্পূর্ণতাও আছে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পরিমান এক্সপার্টিজ, শিক্ষক, গবেষণাগার, শিক্ষা সহায়ক ইকুয়েপমেনন্ট, সমুদ্রে গিয়ে হাতে কলমে শিক্ষা নেওয়ার জন্য যে পরিমান জাহাজ ও ইকুয়েপমেন্ট দরকার সে পরিমান সহায়তা আমরা পায়নি। তবে সময়ের ব্যবধানে আশা করি তা পাবো এবং সমুদ্র বিষয়ে আমাদের দেশেই তৈরি হবে বড় গবেষক।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সরকার সমুদ্র সম্পদ আহরণের কাজ এগিয়ে নিতে ব্লু ইকোনমি সেল করেছে। এটা দিয়ে আসলে কতটুকু আগানো সম্ভব?

কাওসার আহমেদ: সরকার এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে একটি সেল করেছে। এটা দিয়ে আসলে এ কাজ ওইভাবে আগানো সম্ভব না। আরও শক্তিশালী কিছু করতে হবে। সেটা যদি পৃথক একটা মন্ত্রণালয় হয়, সেটা হবে সবচেয়ে ভালো। আর সেটা যদি নাও হয়, তবে পৃথক একটা অধিদপ্তর থাকতে হবে। সেখানে দক্ষ লোকের হাতে দায়িত্ব দিতে হবে। আর সে দক্ষ লোকের মাধ্যমে আরও দক্ষ লোক তৈরি করে নিতে হবে।

বাংলাদেশে সমুদ্রকে ঘিরে ১২টি মন্ত্রণালয় কাজ করে। এক এক কাজ এক এক মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে। এভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাজের গতি পাওয়া যায় না। তাই সরকার যদি মনে করে অনেক মন্ত্রণালয় হয়ে গেছে আর মন্ত্রণালয় বাড়ানো সম্ভব না। তো আমি মনে করি কোন না কোন মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে একটা অধিদপ্তর করা দরকার। যেটা সমুদ্র অর্থনীতি নিযে কাজ করবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমুদ্র সম্পদ আহরণে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা কী?

কাওসার আহমেদ: ভারতে সমুদ্র বিজ্ঞান নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় আছে। ভারত ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশেই সমুদ্র নিয়ে পৃথক মন্ত্রণালয় সরকারের কাছে অনুরোধ একটা অন্তত ছোট হলেও সমুদ্র বিষয়ে একটা মন্ত্রণালয় খোলা হোক। আর সমুদ্র গবেষণা নিয়ে অন্যদেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমি বলবো- গবেষণায় আমরা পিছিয়ে আছি ঠিক। তবে মনে রাখতে হবে এ বিষয়ে গবেষণার বিষয়টি আমাদের মাথায় এসেছে মিয়ানমার থেকে সমুদ্র জয়ের পর। তো সমুদ্র জয় কিন্তু বেশিদিন হয়নি। সে হিসেবে আমরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। উদ্যোগ নিলে আমরাও এগিয়ে যেতে পারবো। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারবো। কারণ যে দেশগুলো ব্লু ইকোনমি কাজে লাগিযে আজ ধনি, তারা একদিনে এ সুফল পায়নি। অনেক বছর তাদের পার করতে হয়েছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ধন্যবাদ আপনাকে, একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে সময় দেওয়ার জন্য।

কাওসার আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ, একুশে টেলিভিশন পরিবারকে ধন্যবাদ।

এসএইচ/