ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

স্কুটি চালিয়ে খালেদার অফিস

প্রকাশিত : ০৭:৩৬ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ০৭:৪০ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার

প্রবল ইচ্ছা একাগ্রতা আর আত্ম প্রত্যয় সাফল্যের সিঁড়ি ছুঁয়ে দেয়। এর জলন্ত উদাহরণ খালেদা আক্তার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রয়োজনের তাগিদে পা রাখেন কর্মজীবনে। ইতিমধ্যে পার করেছেন ২০ বছরের কর্মজীবন। কাজের স্বার্থে স্কুটি চালিয়ে প্রতিদিন মহাসড়ক পাড়ি দেন। তার কাছে সংসার আর চাকরি দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে তিনি মিরসরাই এর এনজিও ভার্ক পরিচালিত ভার্ক মা ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক। খালেদা জানালেন ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বড় বোনের এক বন্ধুর মাধ্যমে ভারকের হেলথ মোটিভেটর পদে যোগ দেন। সংস্থাটির সীতাকুণ্ড ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পের আওয়তায় এই কাজে শুরুতে মাইনে ছিলদিল দুই হাজার ৭০০ টাকা। নিজেকে আজকের অবস্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে তার বেতন ২০ হাজার টাকারও বেশি।

 

খালেদার বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর বাঁশবাড়িয়া গ্রামে। বাবা মরহুম মোহাম্মদ ইসহাক এলাকায় মুদি দোকান করতেন। সফলতা ও প্রতিবন্দকতা প্রতিটি বাঁকে মা হোসেনেয়ারা বেগম ছিলেন খালেদার সবচেয়ে বড় সহযোগী। মায়ের উৎসাহে কঠিন এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। পরিবারের পাঁচ বোনের মধ্যে তৃতীয় খালেদা। স্কুল জীবনে মায়ের কাজ থেকে শেখা সেলাই কাজের পাড়ার ছোট ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে সংসার চালাতে সহযোগিতা করতেন। এইচএসসির পর যোগ দেন চাকরিতে। চাকরির পাশাপাশি চালিয়ে যান লেখাপড়া। ২০০৩ সালে তিনি চট্টগ্রামে কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন। ২০০০ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। স্বামী সীতাকুণ্ড পৌর সদরের হাজি পাড়া গ্রামের জহিরুল ইসলাম। পেশায় সাংবাদিক। প্রেসক্লাবের সহসভাপতি। থাকেন পৌর সদরের ভুঁইয়া বাড়িতে। সম্প্রতি মিরসরাইয়ের ভার্ক মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যালয়ে খালেদার সঙ্গে কথা হয়।

 

তিনি বলেন ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গল্প। তখন আমি সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমার বড় বোনের বান্ধুবি এনজিও কর্মী রুমি আপাকে দেখে সখ জাগে চাকরির। প্রথম দিকে বয়স আর গড়নের কারণে কাজ দিতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। শেষে আনসার ভিডিপিতে চাকরি করেন এমন একজন আত্মীয়ের সহায়তায় চাকরিটা জোটে। ভার্ক নামের উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পে হেলথ মোটিভেটর পদে মাত্র দুই হাজার ৭০০ টাকা বেতনে আমি যোগদান করি ওই বছরের সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ। প্রথমে কাজ পড়লো নিজের ইউনিয়ন বাঁশবাড়িয়ায়। সেখানে কাজ করতে গিয়ে নান রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি। একদিন মদ্যপান করা একব্যক্তি রীতিমতো আমাকে হুমকি-ধুমকি করলেন, শাসালেন। এধরনের ঘটনার মুখোমুখি কখনো হয়নি। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম, ভেবেছিলাম আর বোধ হয় চাকরি করা হবে না। পরে পরিবারের সবার সমর্থন নিয়ে আবারও কাজ শুরি করি। যোগ করেন খালেদা।

 

তিনি জানান- চাকরি জীবনে তার পদোন্নতি হয় একবছর পর।  সিনিয়র হেলথ মোটিভেটর পদে মাইনে ধরা হয়  চার হাজার ৪০০ টাকা। ২০০৯ সালে একই  সংস্থার` বুম সেফ মাদার হুড` প্রকল্পে এ্যাসিটেন্ট কো অডিনেটর হিসেবে দ্বিতীয়বার পদোন্নতি পান খালেদা। বেতন বেড়ে হয় ১৫ হাজার টাকা। এখানে তিনি নিরাপদ মাতৃত্ব ও মায়ের অধিকার নিশ্চিত করার কাজ করেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। ২০১৪ সালে যোগ দেন বর্তমান কর্মস্থল একই সংস্থার ভার্ক মা ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক পদে। এবার মাইনে বেড়ে ২০ হাজারের বেশি। কর্মজীবনে স্কুটি চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে খালেদা আক্তার বলেন, চাকরির শুরুর দিকে আমার জন্য একটি স্কুটি বরাদ্দ হয়। প্রথম দিকে অফিসের সিনিয়ররা ভেবেছিলেন আমি চালাতে পারবো না। তবে বিশ্বাস ছিল, ঠিকই পারবো।

অবশ্য সংস্থা থেকে বাইক পাওয়ার সাত দিনের মাথায় একবার সীতাকুণ্ডে মহাসড়কের ওপর ছিটকে পড়েছিলাম। সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি। পরে তেমন সমস্যা হয়নি। এখন তো প্রতিদিন সকালে ২১ কি.মি বিকেলে ২১ কি.মি পথ বাইক নিয়ে ছুটছি। কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভার্ক কাজ করতে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তের জীবনযাপন সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে। কাজের জন্য আমাকে দূর দুরান্ততে যেতে হয় যেমন চট্টগ্রাম, সাভার, ঢাকা। আমাদের প্রতিস্থানের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে যেতে হয়। একসময় নিজেও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করি। কাজ ও সংসার জীবনকে আলাদা করে দেখার অবকাশ নাই বলে জানালেন খালেদা আক্তার। তার মতে সংসার যেমন জীবনের অংশ কাজ ও জীবনের প্রাত্যহিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি থেকে আরেকটি না থাকলে জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করা যাবে না। বাঙালি নারীর বেলায় দুটো একসাথে সামলানো সত্যিই কঠিন এবং দুরুহ তবু আপনি বেশ ভালো ভাবেই সামলে নিচ্ছেন। এটি কীভাবে সম্ভব হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যে সময়টাতে চাকরিতে যোগদান করি সেই সময় আমাদের গ্রামের পরিবেশ নিরাপদ ছিল না। চাকরি করা তো দূরের কথা পারিবারিক জীবনেও নারীকে নানা অবহেলা আর নিপীড়নের শিকার হতে হতো। অবশ্য বারার বাড়িতে থাকতে চাকরি করা তো দূরের কথা পারিবারিক জীবনেও নারীকে নানা অবহেলা আর নিপীড়নের শিকার হতে হতো। অবশ্য বাবার বাড়িতে থাকতে মা পাশে উৎসাহ জোগান। সাংসারিক নানা কাজে সাহায্য করেন। খালেদা আক্তারের কর্মক্ষেএ মিরসরাই ভার্ক মা ও শিসু হাসপাতালের সহকর্মীরা বলেন, তিনি খুব প্রিয় একজন সহকর্মী। সবনসময় হাসি খুশি থাকেন। তিনি আমাদের জন্য অনুকরণীয়।

 

কেআই/এসএইচ