সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামাজিক অপরাধ
সোলায়মান শাওন
প্রকাশিত : ০৬:৩৮ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৫:২৭ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রবিবার
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবার পরিজন-বন্ধুমহলের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা মুহূর্ত আমরা সামাজিক মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিই।
পাশাপাশি শিক্ষা এবং ব্যবসায়িক কাজেও ব্যাপকভাবে আমরা এগুলোর ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। সামাজিক প্রয়োজন এবং জনমত-জনসচেতনতা তৈরিতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে। কিন্তু ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মত এই সামাজিক মাধ্যমগুলোর ব্যবহারেই ঘটছে ভয়ংকর অসামাজিক কাজকর্ম।
সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে সংঘবদ্ধভাবে করা হচ্ছে নানা অপকর্ম। আর এর স্বীকার হচ্ছেন নারী-পুরুষ সবাই। ইটিভি অনলাইনের সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এসব অপকর্মে অনেক সময়ই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয় নারীদের। আবার অনেকক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি জড়িত থাকেন খোদ নারীরাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন অপরাধের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব।
অপরাধের ধরণ
সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিভিন্নভাবে সংঘটিত হচ্ছে নানা সাইবার অপরাধ। ফেসবুক লাইভ ভিডিও, ছবির ট্রল বা বিকৃতকরণ, সাধারণ ভিডিওসহ নানা উপায়ে হেনস্থা করা হচ্ছে ব্যবহারকারীদের। আর ব্ল্যাকমেইলের মত গুরুতর অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে এগুলোর সূত্র ধরে।
ফেসবুক লাইভ
সাধারণত পরিবার পরিজনের সঙ্গে নিজেদের মুহুর্তগুলো ভাগাভাগি করে নিতে লাইভ ফেসবুক ভিডিও অনেক জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এছাড়া ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও ইদানিং বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে ফেসবুকের এ লাইভ সুবিধা। এমনকি সরকারি বেসরকারি নানান গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে সরাসরি দেখানো হয়।
অন্যদিকে ফেসবুক লাইভকে পুঁজি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু প্রতারক চক্র।
কেস স্টাডি-১
জীবিকার তাগিদে পাঁচ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান রাসেল (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর তাই দেশের মধ্যে পাত্রী খোঁজা শুরু করেন রাসেল ও তার পরিবার। ফেসবুকে ‘এম’ আদ্যাক্ষরের এক গ্রুপের মাধ্যমে নীলা (ছদ্মনাম) নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় রাসেলের। শুরু হয় ফেসবুকে আলাপচারিতা।
ফেসবুকে চ্যাট আর লাইভ ভিডিও-তে ফোনালাপের মধ্যেই গভীর হয়ে ওঠে দু’জনের সম্পর্ক। একপর্যায়ে নীলা নিজের মুখমণ্ডল গোপন রেখে নিজের শরীরের আবেদনময়ী কিছু অংশ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে রাসেলকে। রাসেলও তখন নিজের সম্ভাব্য সহধর্মিনীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ভিডিও শেয়ার করেন। এর কিছুদিন পরেই সেই ভিডিওর সূত্র ধরে রাসেলকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করেন নীলা।
রাসেলের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়। হুমকি দেওয়া হয় টাকা না দিলে রাসেলের সেই আপত্তিকর গোপন ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে ইন্টারনেটে। দেওয়া হবে রাসেলের আত্মীয়-স্বজনের কাছেও।
মান সম্মানের ভয়ে বাধ্য হয়েই নীলার দাবি করা টাকা দিতে বাধ্য হয় রাসেল।
ছবি ট্রল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মানুষদের হয়রানি করার আরেক হাতিয়ার ছবি ট্রল করা। সহজভাবে বলতে গেলে, একজন মানুষের ছবি বিকৃত করে অথবা তার ছবির সঙ্গে আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে দিয়ে তা প্রকাশ করাই হল ছবি ট্রল। ফেসবুকে ট্রল এখন অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আর এর মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা।
কেস স্টাডি-২
ঝিনাইদহের দুই কলেজ ছাত্রী নাদিয়া এবং ত্রিনা’র (ছদ্মনাম) একটি সেলফি’কে আপত্তিকজনকভাবে একটি গ্রুপে শেয়ার করা হয়। সেখান থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পরে ছবিটি। সামাজিকভাবে হেনস্তার স্বীকার মেয়ে দুইটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেন।
ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি-ভিডিও
ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা যুগলদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং ব্যক্তিগত মুহুর্তের ছবি-ভিডিও শেয়ার করার ঘটনা নতুন নয়। পরবর্তীতে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলে তা দিয়ে ব্ল্যাকমেইলের অনেক ঘটনার কথাও আমরা জানি। তবে এ ধরনের ক্ষেত্রে আগে শুধু নারীরাই হয়রানির স্বীকার হলেও এখন নারীদের পাশাপাশি পুরুষেরাও এর স্বীকার হচ্ছেন। আর পুরুষদের ব্ল্যাকমেইল করতে নারীদের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে কিছু সংঘবদ্ধ চক্র। আবার মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে সেই মেয়েকেই ফেলা হচ্ছে ফাঁদে।
কেস স্টাডি-৩
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাবিলা (ছদ্মনাম) একদিন মাকসুদা (ছদ্মনাম) নামের এক মেয়ের কাছ থেকে ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ পান। মেয়ে আইডি থেকে আমন্ত্রণ আসায় সাতপাঁচ না ভেবেই বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে নেয় নাবিলা।
সপ্তাহ খানেক চ্যাট হওয়ার পর নাবিলাকে বাসায় আমন্ত্রণ করে মাকসুদা। নিজের জন্মদিনে কাছের সব বান্ধবীদের দাওয়াত করেছে বলেও জানায় মাকসুদা। কিন্তু মাকসুদার ফ্ল্যাটে গিয়ে একেবারেই অন্য চিত্র দেখেন নাবিলা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে দড়ি দিয়ে হাত-পা মোড়া অবস্থায় আবিষ্কার করেন তিনি।
এরপর কয়েক ঘণ্টা ধরে তার ওপর চলে যৌন নির্যাতন। আর পুরো বিষয়টিই নিজ মোবাইলে ধারণ করে মাকসুদা নামধারী সেই নারী। এরপর থেকেই নাবিলাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে ওই চক্র। মোটা অংকের টাকা না দিলে সেদিনের সব ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখান তারা। বাধ্য হয়েই টাকা দিতে বাধ্য হন নাবিলা।
এরকম আরও নানা উপায়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিদিন হয়রানির স্বীকার হন অসংখ্য তরুণ-তরুণী।
ভয়াবহতা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ঘটে যাওয়া এসব অপরাধের তদন্তের দায়িত্ব থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের আওতাধীন সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ইউনিটের প্রধান উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান ইটিভি অনলাইনকে জানান, গত বছর ২০১৭-তে শধু এক ঢাকা মহানগরীতেই আইসিটি অ্যাক্ট এবং পর্ণোগ্রাফি অ্যাক্টের আওতায় মামলা হয়েছে প্রায় ২৪৬টি। এদের মধ্যে সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশনের কাছে ৭৬টি মামলার তদন্তভার আসে। চার্জশিট এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মধ্যে মোট ২৪টি মামলার তদন্ত কাজ শেষ করে পুলিশের এ বিশেষায়িত এ বিভাগ।
তবে বাস্তবে সাইবার অপরাধের সংখ্যা আরও অনেক বেশি যার বেশিরভাগই আইনী আওতার বাইরে থেকে যায়। উপ-কমিশনার আলিমুজ্জামান বলেন, ‘যেহেতু এ বিষয়গুলো অনেক স্পর্শকাতর তাই অনেক সময়ই ভুক্তভোগী থানা-পুলিশে যেতে চান না। আবার অনেকে প্রাথমিক পর্যায়ে আইনের সাহায্য নিলেও পরবর্তীতে তার থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া যায় না। যে কারণে তথ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক সময়ই তদন্তের ফলাফল আসামির দিকে যায়”।
অন্যদিকে ঢাকা এবং দেশের বাইরে থেকে সংঘটিত অনেক সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে নেয়া যায় না কোন আইনী পদক্ষেপ। ডিএমপি’র সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশনের এ ধরনের অপরাধ তদন্তের কিছু সক্ষমতা থাকলেও ঢাকার বাইরের পুলিশের তেমন একটা দক্ষতা নেই এ ধরনের মামলার তদন্ত করে আসামিকে আইনের আওতায় আনার। অন্যদিকে দেশের বাইরে থাকা অপরাধীকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করা এক লম্বা এবং জটিল প্রক্রিয়া। আর আইনের এমন মারপ্যাঁচের সুযোগ নিয়ে অপরাধ করে যাচ্ছে এসব ‘ডিজিটাল সন্ত্রাসীরা’।
বি:দ্র: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ গ্রুপের মুখোশ উন্মোচিত করা হবে আগামী পর্বে। পাশাপাশি থাকছে এ ধরনের অপরাধের শিকার হলে কী কী করণীয়।