পাকিস্তান ডিমেনসিয়ায় ভুগছে:তুরিন আফরোজ
প্রকাশিত : ০৬:৫৫ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৬:২১ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার
২০১৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্থানের ইসলামাবাদে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর ১৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় কাশ্মির অঞ্চলের উরিতে পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার প্রতিবাদে সার্কের সদস্য রাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানের ওই সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে আফগানিস্তান, ভুটান, বাংলাদেশও ওই সম্মেলনে যোগ দানে বিরত থাকলে সার্কের সভাপতি রাষ্ট্র নেপাল সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করে। সবশেষে শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপও সম্মেলন বর্জন করে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের ব্যাপারে পাকিস্তানের অসন্তোষকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে বলে মন্তব্য করে সম্মেলনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। উল্লেখ্য, সার্কের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো সদস্য কোনো একটি দেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় বাংলাদেশকে দোষারোপ করে। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের বিষয়ে পাকিসস্তান অসন্তোষ প্রকাশ করলে দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এই অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের করণীয় কী হতে পারে তা নিয়ে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন না হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অভিযুক্ত করেছেন। আপনি কী মনে করেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: পাকিস্তান `ডিমেনসিয়ায়` ভুগছে। `ডিমেনসিয়া` একটি মানসিক অসুস্থ্যতা। যার অর্থ হলো `স্মৃতিভ্রম`। এখন খাজা আসিফ এ অভিযোগ করছেন। কিন্তু আপনারা জানেন, ২০১৬ সালে যখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ইসমলামাবাদে অনুষ্ঠিত হলো না, তখন কিন্তু তারা দোষ দিয়েছিলেন ভারতের। সেটা কিন্তু একদম কাগজে-কলমে রেকর্ডে ও বিবৃতিতে রয়েছে। তখন তারা ভারতকে দোষ দিয়েছিলো। আজকে তারা হঠাৎ করে বাংলাদেশকে দোষ দিচ্ছে। এটা কী হাস্যকর ও অযৌক্তিক নয়? সার্কভুক্ত আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে নেপাল সার্কের সভাপতি। বাংলাদেশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেনা, এমন কথা জানানোর আগেই কিন্তু ভারত, ভুটান, আফগানিস্তান সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ৩০ সেপ্টেম্বর সম্মেলন প্রত্যাখ্যান করে শ্রীলঙ্কা। মালদ্বীপ তারও পরে (১ অক্টোবর) সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। এখন আসা যাক, কেন তারা সম্মেলন বর্জন করেছিল। ভারত বলছে, পাকিস্তানের সাথে তাদের `কাস্মীর` ইস্যু নিয়ে সমস্যা আছে। অন্য রাষ্ট্রগুলো বলল, পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়। তাদের ওখানে সার্ক সম্মেলনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ বলছে এখানে দু`টি ইস্যু। এক. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে পাকিস্তান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে। দুই. পাকিস্থান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। কিন্তু এসব অভিযোগকে এড়িয়ে গিয়ে তারা যখন বলে, বাংলাদেশের কারণে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়নি, তখন বুঝতে বাকি থাকেনা যে, পাকিস্থান রাষ্ট্রটির স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। আসলেই পাকিস্থান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তারা বলল, তারা এ বিচার সমর্থন করেনা। তারা এ ব্যাপারে অসন্তোষ। তার মানে তারা গণহত্যাকে সমর্থন করে। কারণ তারা নিজেরাই একটি গণহত্যাকারী রাষ্ট্র।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাকিস্তান বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এ কথার সাথে আপনি কতটুকু একমত?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: পাকিস্তানের এ কথাও প্রমাণ করে তারা ডিমেনসিয়া রোগী। কারণ, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি কোনভাবেই আমাদের উপর বাধ্যতামূলক নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। যা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয়। এসব অপরাধে কেউ কাউকে ক্ষমা করতে পারেনা। এসব অপরাধে কেউ যদি কাউকে মাফ করে তাহলে ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৫৩ অনুযায়ী চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। এই চুক্তি অনুযায়ী ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি একটি বাতিল চুক্তি। এই চুক্তির কোনো কার্যকারিতা আন্তর্জাতিক আইনেও নেই, আমাদের দেশীয় আইনেও নেই। তার প্রমাণ হচ্ছে, আমার দেশের আইনে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি তখনই বাধ্যতামূলক হবে যখন সেটি সংবিধানের ১৪৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমার দেশের সংসদে সেটি পাস হবে। কিন্তু কখনো এই চুক্তি আমাদের সংসদে উত্থাপিত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বলছি পাকিস্তানের স্মৃতিভ্রম ঘটেছে? কারণ হচ্ছে, তারা বলছে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ আজকে আমাদের এখানে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের বিচার আমরা করব না, এমন একটি ওয়াদা নাকি আমরা করেছিলাম। পাকিস্তানের স্মৃতির এমন দেউলিয়াত্ব হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের আল বদর, আল শামস, রাজাকার নিয়ে একটা লাইনও ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে নেই। যদি তারা মনে করে ঐ চুক্তির দোহাই দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমালোচনা তারা করবে, তাহলে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী রাজাকার, আলবদর, আল শামসরা তাদের দেশের নাগরিক। মানে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী। তাহলে তাদের বিচার কী তোমরা চাওনা? এখন এটিতো শুধু বাংলাদেশ পাকিস্তানের ইস্যু না। বরং এটি পুরো মানব সভ্যতার একটি বিষয়। যে কোনো সভ্য রাষ্ট্র অপরাধীর বিচার চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাকিস্তানের ব্যাপারে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত কী হওয়া উচিত?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: পাকিস্তান একটি অসভ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা কোনো আইন মানছে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা সম্প্রীতির প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, সার্কের সকল সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করা। সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্যে বলা আছে, ‘বন্ধুত্ব, আস্থা ও পারষ্পরিক সমঝোতা হবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্কের ভিত্তি। সার্কের আওতাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের কোনো বন্ধু নেই। থাকলে আমরা তা দেখতাম। বাংলাদেশ না হয় অংশগ্রহণ করেনি। অন্যরা তো করতে পারত। কিন্তু অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রও অংশগ্রহণ করেনি। পাকিস্তানের প্রতি আমাদের কারো কোন আস্থা নেই।
পাকিস্তান একটা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। কেউ কাউকে মানছে না। কোনো আইনের প্রয়োগ নেই। যেখানে সেখানে বোমাবাজি হচ্ছে। স্কুলগুলো উড়ে যাচ্ছে, নামায পড়া অবস্থায় মসজিদ উড়ে যাচ্ছে। আর পারষ্পরিক সমঝোতার ব্যাপারে পাকিস্থান কখনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেনি। ৭১-এ এরকম ভয়াবহ গণহত্যা করার পরেও তাদের মধ্যে কোনো প্রকার অনুশোচনা জাগেনি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করল। `শান্তি` ও `নিরাপত্তা` সার্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু শান্তির জন্য সার্ক জোনে পাকিস্তানকে কখনোই পাওয়া যায়না। শান্তি বিঘ্ন ঘটায় পাকিস্তান। আবার নিরাপত্তার জন্য তারা হুমকি। সার্কের চার্টার অনুযায়ী পাকিস্তানের সার্কভুক্ত থাকার কোনো অধিকার নেই। কারণ, তারা সার্কের চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: যুদ্ধাপরাধীদের রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করল পাকিস্তান। পাশাপাশি সার্ক সম্মেলন না হওয়ায় বাংলাদেশকেই দায়ী করল একই রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক আইনের জায়গা থেকে তাদের কোনো শাস্তি কী আমরা দাবি করতে পারি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার চাইতে তাদেরকে বর্জন করা উচিত। শুধু বাংলাদেশ না; আমাদের যদি বিশ্ব মানবতার প্রতি সম্মান থাকে, আধুনিক সুসভ্য রাষ্ট্রগঠনে আমরা যদি আগ্রহী হই তাহলে পাকিস্তানের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: বঙ্গবন্ধুর সময়ের বাস্তবতা আর আমাদের সময়ের বাস্তবতা ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল, কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথেই বন্ধুত্ব। বঙ্গবন্ধু বিশ্ব মানবতার নেতা ছিলেন। তিনি বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করতেন। আমি আজকে শুধু বাংলাদেশের কথা বলছিনা, বলছি বিশ্বের সব সভ্য রাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানের সাথে সকল প্রকার রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ। গণহত্যার জন্য দায়ী একটি রাষ্ট্রের ব্যপারে আমাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আপনার চিন্তা ফলপ্রসূ হোক।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আপনিসহ সকল সাংবাদিক ভাইদের জন্য শুভ কামনা রইলো।
টিকে