ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

ধূমপান ও আপনার বিবেক

শামসুল হক

প্রকাশিত : ০৪:২১ পিএম, ২২ জানুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৪:৫৯ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এরকম কথা ছোট বেলা থেকেই শোনে আসছি। এ কথাকে কতজন গুরুত্ব দেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সময় নষ্ট করার জো নেই। কতজন এ কথাকে গুরুত্ব দিয়ে ধূমপান ছেড়েছেন তাও বলা কঠিন। বা অন্যকে ধূমপানে নিরৎসায়িত করেছেন-এর পরিসংখ্যান জানা নেই। তর্কের কারণে অনেকেই হয়তো বলতে পারেন আমার টাকায় আমি ধূমপান করি আপনার মাথা ব্যথা কেন। হ্যাঁ মাথা ব্যথা এ কারণে আপনি আপনার টাকায় আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবেন।  এ নিয়ে তেমন বলার নেই। তবে আপনি অন্যের ক্ষতি করতে পারেন না। আপনার ধূমপানের কারণে আপনার পাশের ব্যক্তির ক্ষতি হচ্ছে। সমাজ, রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি করার অধিকার আপনার নেই। আপনি যখন রাস্তায়, পার্কে, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা স্কুল-কলেজে বা পাবলিক কোনো প্লেসে ধূমপান করছেন তখন সেটা অন্যায় কি না। আপনার বিবেককে একবার প্রশ্ন করুন। আপনার প্রিয় সন্তানের সামনে যখন অনায়েসে ধূমপান করছেন। তার প্রতি কি আপনি বাবা বা মা হিসেবে সঠিক কাজ করছেন? আপনার সন্তান বড় হয়ে যখন বুঝতে পারবে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর সেই ক্ষতিকর কাজটি আপনি আপনার সন্তানের সঙ্গে করেছেন। তখন আপনার সন্তান আপনার জন্য কী ভাববেন। একবারও কি আপনার এমন চিন্তা মনে জাগে না।

এই ধূমপান সমাজের একটা বড় সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। অনেকে এটা প্যাশন হিসেবে পান করে থাকেন। আর অনেকেই আবার নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানো মনে করেন। তবে কিভাবে এটা প্যাশন বা স্ট্যাটাস হয় তা আমার মতো হয়তো অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। আর এই প্যাশন করতে গিয়ে অন্যায় কাজ করে যাচ্ছেন। আর এ অন্যায় কাজের জন্য অনুশোচনাবোধও দেখি না অনেক সময়। অনেক বন্ধু বা কাছের আত্মীয় ধূমপানে অভ্যস্থ। তারাও অনায়সে ধূমপান করে থাকেন।  

আজ থেকে ১৮ বছর আগের কথা ঈদ-উল-আজহার আগে, কুরবানির গরু কেনার জন্য বাবার সঙ্গে হাটে গিয়েছি। সাধারণত সব বাবা-মা তার সন্তান ভালো পোশাক পড়ে ঘুরুক এমনটায় চায়। ঈদের আগে সুন্দর একটি নতুন শার্ট পড়ে  সেদিন হাটে গিয়েছিলাম। বড় বড় গরু দেখছি আনন্দের সঙ্গে। আর হাঁটছি বাবার পেছনে পেছনে। মনের অজান্তেই এক লোক জ্বলন্ত বিড়ি হাতে নিয়ে আনমনে হয়তো হাঁটছিলেন আমার পেছনে। তোর সেই জ্বলন্ত বিড়ি আমার সুন্দর নতুন সেই শার্টটির একটি অংশ পুড়িয়ে ফেলে। মনে অনেক বড় কষ্ট পেয়েছিলাম সেই দিন। মনের কষ্টে আর ওই শার্টটি পড়ে কোথাও ঘুরতে পারি নাই। সেই দিন ওই ভদ্র মানুষের ওপর এমন  রাগ হয়েছিল যেন আঘাত করি। কিন্তু লোকটির বয়স আমার বাবার চেয়েও বেশি। তাকে আঘাত না করতে পারলেও মনে মনে অনেক ঘৃণা করেছি। ধিক্কার জানিয়েছি ওই ভদ্রলোকটিকে। তবে লোকটি সরি বলে ক্ষমা চেয়েছিল আমার কাছে। সেই দিনের স্মৃতি এখনও মাঝে মাঝে চোখে ভাসে যখন রাজধানীর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলি আর সুট-বুট পড়া কোনো লোক যখন সামনে বা পেছনে ধূমপান করেন। তখন মনের অজান্তেই তাদের প্রতি একটা রাগ চলে আসে। মনে মনে বলি আরে ভাই তুমি তোমার টাকায় তুমি ধূমপান করবে সেটার তোমার বাসায়। রাস্তায় বা ফুটপাতে কেনো? বা স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কেনো। অনেক সহকর্মী বা বন্ধু ধূমপান করেন তাতেও আমার তেমন মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা তখনই যখন আপনি কারো ক্ষতি করছেন।

ধূমপান নিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতিবছর এক লাখ মানুষ তামাকের কারণে মৃত্যুবরণ করে। ‘বিষ বাতাস’ নামের একটি টিভি স্পট (বিজ্ঞাপনচিত্র) উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর বিষয় জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতেই এই টিভি স্পটটি তৈরি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

জাহিদ মালেক বলেন, ২০১৫-১৬ সালে সরকার তামাক খাত থেকে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। তবে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সরকারের ব্যয় হয়েছে এর দ্বিগুণ।

পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ভাইটাল স্ট্র্যাটেজি ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে নির্মিত এ টিভি স্পটটির দৈর্ঘ্য ৩০ সেকেন্ড।

ওই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, বাংলাদেশে ১৫-৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৩ ভাগ বা ৪ কোটি ৩০ লক্ষাধিক মানুষ তামাক সেবন করে থাকে। এ হার পুরুষের মধ্যে ৫৮ ভাগ এবং নারীদের মধ্যে ২৯ ভাগ। ৪৫ ভাগ অধূমপায়ী মানুষ জনসমাগমস্থলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী।

তামাকের ভয়াবহতা থেকে মানুষের জীবন রক্ষা ও ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে ধূমপানমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এই প্রচার অভিযান চালানো হচ্ছে।

ধূমপান না কমার পেছনে বেশ কিছু কারণও আছে বলেই মনে হয়। এর মধ্যে বিজ্ঞাপন, সিনেমা, নাটকও দায়ি বলা যায়। অনেক দিন আগে অভিনেতা জাহিদ হাসান একটি সিগারেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন করে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। এর পর থেকে টিভির পর্দায় বা অন্য কোনো প্রচারমাধ্যমে ধূমপানের ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ কোনো বিজ্ঞাপন দেখা যায় না। কিন্তু ধূমপান নিয়ে আমরা আগের তুলনায় অনেক সচেতন হলেও এর ব্যবহারের চিত্র সিনেমা, নাটকে অহরহ ঘটছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতীয় টেলিভিশন বা সিনেমা ধূমপানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে সিনেমার শুরুতেই ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা ক্যানসারের কারণ’ জাতীয় কথা তুলে ধরছে।

কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের পদক্ষেপ এখনো আশানুরূপ পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশের সিনেমা, নাটকে আগের মতো এখনো ধূমপানের চিত্রগুলো ধারণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি মুক্তিপাপ্ত একটি ছবি জটিল প্রেম-এ ধূমপানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বড় কথা হলো, এই ছবির একটি গানের দৃশ্যে নায়ক ধূমপানকে ফ্যাশন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ দর্শকই উঠতি বয়সী তরুণ প্রজন্ম। এ ধরনের দৃশ্য দেখে দর্শককে ফ্যাশনপ্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে।

ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইন পাস হয়েছে আট বছর আগে। সম্প্রতি আইনে সংশোধনীও আনা হয়েছে। প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ৩০০ টাকা করা হয়েছে। দোকানদার, ব্যবস্থাপকদেরও জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে এই আইন কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

ধূমপান আইন করে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা জানি না। তবে ধূমপান যে কতটা ক্ষতি করছে সমাজের তা অনুমেয়। দিনের পর দিন ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় হতাশার কারণ আমাদের তরুণ সমাজ এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে এখন নারীরাও এখন এর নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে। ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে গণমাধ্যমে বেশি করে প্রচার করা উচিৎ। ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যমকে বাধ্য করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এছাড়াও ধূমপানের উপকরণের ওপর আরও বেশি কর আরোপ করা যায় কি না তাও নিয়ে ভাবা যেতে পারে। পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তির পরিমান বাড়ানো যায় কি এটাও আরেকবার ভাবা যেতে পারে। সবশেষ একটি কথা না বললেই নয়। ধূমপান আপনার ক্ষতি করে জেনেই আপনি তা করেন। কিন্তু আপনি জানেন না, আপনার সন্তানের ক্ষতি হচ্ছে এই ধূমপানের ফলে। আপনার বিবেককে একবার প্রশ্ন করুন।

 লেখক: সাংবাদিক।