ঢাকা, শুক্রবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৪ ১৪৩১

হাসপাতালে বাচ্চা বদল

সিনেমাকে হার মানায় যে কাহিনী

প্রকাশিত : ১০:১৭ এএম, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ বুধবার

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দুটো শিশুর জন্ম হয় এবং হাসপাতালে থাকতেই এই দুটো শিশু দুর্ঘটনাবশত বদলাবদলি হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, পরের ঘটনাটি সিনেমার কাহিনির মতো। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে।

একেবারেই ভিন্ন রকমের দুটো পরিবারে তাদের জন্ম। একটি শিশু উপজাতি এক হিন্দু পরিবারে আর অন্যটি মুসলিম। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করে যে পরিবারে তাদের জন্ম তাদেরকে শনাক্ত করা হয়।

পরে ওই দুটো দম্পতি আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং নিশ্চিত করেন যে তারা একে অপরের সন্তানকে লালন পালন করবেন।

শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি তার স্ত্রী সালমা পারভীনকে মঙ্গলদাই হাসপাতালে নিয়ে যান ২০১৫ সালের ১১ই মার্চ সকাল ৬টার সময় এবং তার এক ঘণ্টা পরেই তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পরের দিনই তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে।

তিনি বলেন, এক সপ্তাহ পর আমার স্ত্রী বললো এই বাচ্চা আমাদের না। আমি বললাম, কি বলছো তুমি? একটি নিষ্পাপ শিশুর ব্যাপারে তোমার এভাবে কথা বলা ঠিক না। আমার স্ত্রী বললো প্রসূতি কক্ষে নাকি একজন মহিলা ছিলো এবং তার মনে হচ্ছে ওই মহিলার বাচ্চার সঙ্গে আমাদের বাচ্চা বদল হয়ে গেছে। আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু দিনের পর দিন সে এই কথাটা আমাকে বলতেই থাকলো।

শাহাবুদ্দিন তখন হাসপাতালে ছুটে যান এবং সেখানকার এক কর্মকর্তাকে তার স্ত্রীর সন্দেহের কথা জানান। তখন ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন যে, তার স্ত্রী মানসিকভাবে সুস্থ নন। তার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি তখন তথ্য জানার অধিকার সংক্রান্ত একটি পিটিশন দায়ের করেন। সেদিন সকাল সাতটা থেকে যতো শিশুর জন্ম হয়েছিলো তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চান তিনি। তার এক মাস পর তিনি সাতজন নারীর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেন। কাগজপত্র দেখার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন একটি উপজাতি মহিলার ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ খবর নেওয়ার। কারণ ওই মহিলার সন্তান জন্মদানের সঙ্গে তাদের সন্তানের জন্ম হওয়ার সময় ও ঘটনার মধ্যে তিনি অনেক মিল দেখতে পেয়েছেন।

এরপর ওই মহিলার খোঁজে তিনি দু`বার তার গ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে যাওয়ার সাহস পান নি।

শাহাবুদ্দিন বলেন, তখন আমি তাদেরকে একটি চিঠি লিখি। আমি বলি যে আমার স্ত্রী সন্দেহ করছে তাদের বাচ্চার সঙ্গে আমাদের বাচ্চা বদল হয়ে গেছে এবং এবিষয়ে তাদের কোনো সন্দেহ আছে কীনা। চিঠির নিচে আমি আমার ফোন নম্বর দিয়ে দেই। আহমেদের চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই বোড়ো দম্পতির সন্দেহ হয় নি যে তাদের সন্তান অন্য কোনো শিশুর সঙ্গে বদল হয়ে গেছে। এরকম কিছু হতে পারে বলে তারা কেউই সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু পুরো ঘটনাটিই বদলে যায় যখন এই দুটো পরিবার একসঙ্গে মিলিত হয়।

"যখন আমি অন্য শিশুটিকে প্রথম দেখলাম তখনই মনে হলো যে আমার স্বামীর সঙ্গে তার চেহারার বেশ মিল। আমার তখন এতো খারাপ লাগছিলো যে আমি কতোক্ষণ কাঁদলাম। আমরা বোড়োরা দেখতে অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমাদের নাক চোখ দেখতে মুসলমানদের মতো নয়," বলেন শেওয়ালি বোড়ো

সালমা পারভীন বলেন, প্রথমবার দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রইয়ানই তাদের বাচ্চা। সেই মুহূর্তেই তিনি বাচ্চা দুটোকে আবার বদলে নিতে চেয়েছিলেন। তবে বোড়ো নারী তাতে রাজি হননি।

পরে আহমেদের অনুরোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে তদন্ত করতে শুরু করে। হাসপাতালের প্রসূতি কক্ষে সেদিন যেসব নার্স ছিলেন তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা হয়। তাদের কাজে কোনো ধরনের ভুল ভ্রান্তি হওয়ার কথা তারা অস্বীকার করেন।

এতেও ক্ষান্ত হননি আহমেদ। তিনি তখন তার স্ত্রী ও শিশুর রক্তের নমুনা পাঠান ডিএনএ টেস্টের জন্যে। পরীক্ষার ফলাফল যখন তার হাতে আসে তিনি তার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যান। সেখানে দেখা যায় শিশু জুনায়েতের সাথে সালমা পারভীনের জিনগত কোন মিল পাওয়া যায় নি।

হাসপাতাল থেকে তখন আহমেদের পরিবারকে জানানো হয় যে আইনের কাছে এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়। তখন তিনি পরের বছরের ডিসেম্বর মাসে পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।

পরে তিনি ওই দুটো দম্পতি ও দুটো শিশুর রক্তের নমুনা নিয়ে কলকাতায় যান পরীক্ষার জন্যে। তবে ফর্মে কিছু ত্রুটি থাকায় ফরেনসিক ল্যাবরেটরি এই পরীক্ষা করাতে রাজি হননি। পরে দ্বিতীয়বারের মতো নমুনা সংগ্রহ করে রাজধানী গৌহাটিতে ফরেনসিক ল্যাবে টেস্ট করা হয়। ওই পরীক্ষায় প্রমাণ হয় যে আসলেই বাচ্চা দুটো জন্মের সময় বদলা বদলি হয়ে গেছে।

পুলিশ কর্মকর্তা তখন আহমেদকে পরামর্শ দেন বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার জন্যে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তিনি আবেদন করেন দুটো বাচ্চাকে আবার বদল করার জন্যে। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে বাচ্চা দুটোকে যার যার আসল পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হবে। এজন্যে দুটো পরিবার আদালতেও হাজির হয়। কিন্তু বাদ সাধে দুটো শিশু। যে পরিবারে তারা বেড়ে উঠেছে সেই পরিবার ছেড়ে যেতে তারা আর রাজি হয়নি।

সালমা পারভীন বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের বলেন, চাইলে আমরা আমাদের বাচ্চা দুটো বদলাবদলি করে নিতে পারি। কিন্তু আমরা তখন বলি যে না, আমরা সেটা করবো না। কারণ গত তিন বছর ধরে আমরা তাদেরকে বড় করেছি। হঠাৎ করেই আমরা তো আর তাদেরকে অন্যের কাছে দিয়ে দিতে পারি না।

অনিল বোড়ো বলেন, এখন যদি তাদেরকে বদল করা হয় তাহলে তারা মানসিকভাবে কষ্ট পেতে পারে। তারা এতো ছোট্ট যে কি ঘটছে তার কিছুই তারা বুঝতে পারছে না। তারপর থেকে ওই দুটো শিশু আগের মতোই ভিন্ন পরিবারে আদর যত্ন আর ভালোবাসায় বেড়ে উঠছে।

তবে তারা বলছেন, বাচ্চা দুটো বড়ো হওয়ার পর তারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে তারা আসলে কোন পরিবারের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী। এখন এই দুটো পরিবার যেটা চেষ্টা করছে তা হলো- তাদের মধ্যে যাতে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং শিশু দুটোর সাথে যাতে তাদের আসল পরিবারের একটা সম্পর্ক বজায় থাকে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

সূত্র: বিবিসি

একে// এআর