ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

পর্ব-২

গোয়েন্দাদের স্বর্ণ উদ্ধার কাহিনি

ড. মইনুল খান

প্রকাশিত : ০১:৪৫ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০১:৪৯ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রবিবার

ড. মইনুল খান। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সোনা চোরাচালানকারীদের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। জল, স্থল ও আকাশ পথে সোনা চোরাচালান রোধে অভিযান চালিয়ে বেশ আলোচিত তিনি। সোনা চোরাচালানের অভিযানের পেছনের একটি কাহিনী তুলে ধরেছেন এই লেখায়। লেখার দ্বিতীয় পর্বটি পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

ইমাম হাতের মোবাইলটি গ্রিন চ্যানেলে কেড়ে নিয়েছিলো। টিপস অনুযায়ী টার্গেট সন্দেহ হলে হাতের মোবাইল সারিয়ে ফেলতে হবে। কথা বলার সুযোগ দেয়া যাবে না। একা করে রাখতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। অসঙ্গতি আছে কিনা দেখতে হবে। জড়তা পেয়ে বসেছে কি না। ইমামের প্রশ্নে জবাব কড়া হলেও শরীফ চক্ষু সংযোগ করেনি। অন্যদিকে তাকিয়ে কড়া কথা শুনাচ্ছে। ইমামের বুঝার বাকি রইলো না শরীফ কিছু একটা আড়াল করছে। সন্দেহ অমূলক নয়। বিধান এসে আরো নিশ্চিত হলো। খাওয়ার প্রতি অনীহা কেন?  একগ্লাস পানিও না। মুখ শুকনা। বুঝা যায় সারাদিন খায়নি। প্লেনের খাবারটিও না। হাতে করে নিয়ে এসছে। প্লেনের খাবার হাতে আনার রহস্য কী? মিলিয়ে দেখার চেষ্টা । শরীরে ক্লান্তির ছাপ। চোখের বাইরে কালো দাগ। চোখের পাপড়ি ঘন ঘন পড়ছে। চোখের পানি শূন্য। আই কন্টাক্ট নেই। এদিক সেদিক চোখ । চোখ দেখাতে চাইছে না। কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা। সম্মানিত ব্যবসায়ী কেন এমন করবেন?  যার আত্মীয় এতো বড় কর্তা তিনি কেন এই আচরণ করবেন ? সাদেক টেলিফোনে সদর দপ্তর জানালো। কথামতো আবার প্রশ্ন। আরো জানার চেষ্টা করছে অসংলগ্ন উত্তরগুলোর।

অনুমান ভুল হওয়ার কথা নয়। সাদেক আগেরবারও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। ওর উপর অগাধ বিশ্বাস। দুটো তথ্য। নেটওয়ার্ক থেকে এসেছে। করাচি থেকে শান্তি আলম নামের যাত্রী আসবে। দুবাই আসবে। প্লেন অবতরণ করেছে। সময় কম। যাচাই করা হয়নি। পণ্য জাল রুপি। বাংলাদেশে ঢুকবে। এরপর পাশের দেশে যাবে। এর আগেও আরো আটক হয়েছে। সবচেয়ে বড়টি হয়েছে ৬ কোটি রুপি। ৪ টি কার্টন ভর্তি ১২০ কেজি ওজন। খোলার পর থরে থরে রুপি। ১০০০ ও ৫০০ রুরির নোট। নতুন। দেখতে হুবহু এক। নকল টাকা আসলের মতো। সাদেকের কাছে তথ্য গেছে। নিশ্চিত সর্বোচ্চ  চেষ্টা হবে। টার্গেটের নামটিও অস্পষ্ট। সাদেক প্যাসেঞ্জার লিস্ট নিলো। শন্তি আলম বলে কেউ নেই। বিশ মিনিটের মধ্যে প্লেন ল্যান্ড করবে। মি. আলম দিয়ে দেখলো। তিনজন আছে। এস আলম নেই। তবুও বের করতে হবে। ইমিগ্রেশনে গিয়ে তিনজন আলমকে বের করলেন। একজন মহিলা । নিলা আলম। আরেকজন আমেরিকা থাকেন। বয়স ৬৭। পেশা ডাক্তার । ড. কুদরাত আলম। অন্যজন বাচ্চা। বয়স ১১। বাবা-মা সাথে। কানাডা থেকে এসেছে। সাদেক হতাশ হলো না। লাগেজ বেল্টে ২৩০ জন যাত্রী অপেক্ষা করছে। এদরে ভেতর থেকে বের করতে হবে। কীভাবে? চ্যালেঞ্জ। আবারো টেলিফোনে মেসেজ দেয়া হলো এই ফ্লাইটে এসেছে। বের করতে হবে। স্ক্যানিও  মেশিনে ধরা পড়বে না। কেমিকেল মিশিয়ে আনে। কালো ও মোটা টেপ দিয়ে মুড়িয়ে আনে। এক্সরে ইমেজে স্পষ্ট নয়। ম্যানুয়াল পরীক্ষা আরো নির্ভরযোগ্য । স্ক্যানিং মেশিনের পরে দুটো গোয়েন্দা স্তর সাজানো হলো । গ্রিন চ্যানেলে অপেক্ষা করছে গোয়েন্দারা । সাদেক দ্রুত এয়ারলাইন্স থেকে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে নামলো। তিনজন যাত্রী করাচি থেকে দুবাই ট্রানজিট নিয়ে ঢাকায় এসেছে। এই তিনজনকে শনাক্ত করলো। দুজন প্রফেসর। লেকচার দিতে করাচি গিয়েছেন। অন্যজন সন্দেহজনক হলো। তাকে আলাদা করে ব্যাগ তল্লাশি করে ১.৯০ কোটি রুপি ধরা পড়লো। ক্লুলেস তথ্যে সাদেক বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়েছে। আজকের অভিযানটি আরো বিশ্বাসযোগ্য । শনাক্তও হয়েছে। সন্দেহের কারণও স্পষ্ট।

সাদেক এবার ভিন্ন কৌশল নিলো। শরীর তল্লাশি করেও কিছু পাওয়া গেলো না। আজকের তথ্য সোনা চোরাচালানের। হাতের ব্যাগটিও তন্ন তন্ন করে দেখেছে গোয়েন্দারা। স্ক্যানিং মেশিনেও দেয়া হলো । কোন ফল নেই। সাদেক হতাশ হলো না। বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলেও তা কাজে লাগাতে হবে। শরীফকে যেতে দেয়া হলো । বুদ্ধি আসলো। পেটে স্বর্ণ থাকলে হাঁটায় অস্বাভাবিকতা থাকবে। সহজভাবে বলে দিলো, তুমি এখন যাও । তুমি মুক্ত। শরীফ খুশি হয়ে ধন্যবাদ দিলো। মাফ চেয়ে নিলো রাগারাগির জন্য । অন্যায় হয়েছে। বুঝতে পারিনি। টার্গেটে হাঁটছে । কাস্টমস হলে হাঁটছে। পেছনে সাদেকের গোয়েন্দারা তীহ্ম দৃষ্টি। চলাফেরায় অস্বস্তি আছে কি না। স্বাভাবিক । চেহারায় অসংলগ্নতা থাকলেও কথায়, হাটাচলায় জড়তা নেই। রাগারাগির জ্ঞানটা টনটনে। হাঁটছে ধীরে গতিতে। মিলছে না। আগের চালানটি ধরা পড়েছে হাঁটার ভঙ্গি দেখে। গ্রিন চ্যানেলে চ্যালেঞ্জ করতেই মঞ্জু  হক ধরা পড়েন গোয়েন্দার জালে। সেক্টাম থেকে ৮ পিস স্বর্ণবার উদ্ধার হয়। এই স্বর্ণ সাদেকের টিম উদ্ধার করে । হাঁটতে পারছিলো না যাত্রী। আগে থেকে তথ্য ছিলো। চোখে দাগ ছিলো। তবে যাত্রী ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল। সহসাই স্বীকার করলো, ভাই আমাকে শ্রীঘ্রই  বাথরুমে নিয়ে চলেন। আমার ভেতর ৮ টি বার আছে। নিজেই বের করে আনলেন। জিজ্ঞাসাবাদে মঞ্জু জানায়, অনেকক্ষণ হরো রেক্টমে স্বর্ণ ঢোকানো হয়েছে।

পেইনকিলার দেয়া হয়েছিলো। কুয়ালালামপুরে এই ঔষধ দিয়ে প্লেনে উঠেছি। ৫ ঘন্টা থাকে এর মেয়াদ। প্লেন চাড়তে দুই ঘন্টা দেরি হওয়াতে পেইন উঠে গেছে। ব্যাথা সইতে পারছে না। নিজে বের করে আরামবোধ করছে মঞ্জু । সাদেক এই যাত্রীর বেলায় মিলিয়ে দেখছে। সন্দেহমুক্ত থাকতে চায়। গ্রিন চ্যানেল পর্যন্ত দেখলো। বাইরের দৃশ্য মনিটরে ভেসে উঠছে। কোন অস্বাভাবিকতা নেই। নিরাশ হলো না সাদেক ।

* স্যার, ৩৬০ ডিগ্রি তল্লাশি হয়েছে। হাঁটা স্বাভাবিক।

* তুমি কি সন্দেহ করছো?

* জ্বি স্যার। তার চোখ ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলছে সামথিং ইজ রং । স্যার টার্গেট পানি পর্যন্ত খায়নি। চোখের নিচে কালো দাগ। এটি আরো সন্দেহজনক । প্লেনের খাবার খায়নি। হাতে করে এনেছে। দুদিন গেছে, ছোট হ্যান্ড লাগেজ এনেছে। চেকড েইন লাগেজ নেই। দ্রুত কেটে পড়ার ইচ্ছা ।

* তোমার সন্দেহের যুক্তি আছে। কথামতো বাকি কাজগুলো করো।

আবার শরীফকে ডেকে আনা হলো । ইমাম পেছনে পাহারায়। বিধান মেসেজ পেয়ে ফেরত নিয়ে আনলো। স্যার, জানতাম ওকে ফিরিয়ে আনবেন। বিধান আরো বললো, স্যার মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে কাজ হচ্ছে না । আর্চওয়েতে নিতে হবে। কাস্টমাসের আর্চওয়েতে ঘুরিযে আনার অনুমতি চােইরো। আর্চওয়ের লাইট জ্বলছে। ভেতর দিয়ে হাঁটারো তিনবার । কোন শ্বদ নেই। হাতে মেটালের ঘড়ি। তবুও শব্দ নেই। বিধান ভরসা পেলো না । ভিআইপি গেটের আর্চওয়ে নতুন। তিন বছর হরো বসানো হয়েছে। অনেক টাকা খরচ হলো। এখন পর্যন্ত তেমন কোন উদ্ধার হয়নি। তবে আর্চওয়ের উপস্থিতি একধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিধান ভিআইপি আর্চওয়েতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো। সাদেক অনুমতি দিলো । কাস্টসম হলের বাইরে। ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের পথে এই আর্চওয়ে । এটি অপেক্ষাকৃত নতুন। এখানে চারবার আসা –যাওয়া। শরীফ ক্লান্ত। যেভাবে বলছে সেভাবেই পোশাক খুলছে। একবার অল্প শব্দ হলেও বাকি তিনবার হয়নি। আবার আনা হলো শিফট ইন চার্জের রুমে। শরীফ কিছুতেই স্বীকার করছে না। পেটে স্বর্ণ থাকার প্রশ্নই আসে না। আবার আনা হলো শিফট ইন চার্জের রুমে। শরীফ কিছুতেই স্বীকার করছে না । পেটে স্বর্ণ থাকার প্রশ্নই আসে না। হয়রনির অফিযোগ। শরীফের কন্ঠ উচ্চ। সাদেক নিরাশ হলো না। সাদেক মানসিক চাপ প্রয়োগের আশ্রয় নিলো। নানাভাবে প্রলোভন । বলা হলো, নিজে থেকে বের করে দিলে ছেড়ে দেয়া হবে। সাজা যাতে কম হয় সেই ব্যবস্থা করবে। শরীফকে রাজী করানো গেলো না ।

 ৩-৩০ টা । গভীর রাত। কাস্টমস হল খালি। কাস্টমস হলে কোন যাত্রী নেই। লাগেজ সংগ্রহ করে আরো ঘন্টখানেক আগে বের হয়ে গেছে। বাইরেও ভিড় নেই। মনিটরে দেখছে সাদেক । রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভারদের দেখা যায় না। এতোক্ষণ ছিলো। কাস্টমার না থাকায় এরাও চলে গেছে। ভোরে আবার আসবে। সকালে অনেকগুলো ফ্লাইটের শিডিউল আছে । মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইট। দুবাই ফ্লাইট বেশি। ভালোভাবে দেখতে হবে। প্রস্তুতি নেয়া দরকার। মনিটরেও ইটিএ দেখাচ্ছে সকাল ৭ টা। ইকে ৫৮৪ । বহির্গমন লাউঞ্জে কিছু ভিড় আছে। ভোরে বেশ কিছু ফ্লাইট ছাড়বে। এখনি যাত্রী আসা শুরু হয়েছে। দোতরায় গাড়ি যাচ্ছে। বহির্গমন যাত্রীরা সকালের ফ্লাইটের জন্য এখনি আসা শরু করেছে। সাদেক ভাবছে, অনেকক্ষণ হলো। সাথে চেষ্টাও । অবয়বে চোরাচালানরি চাপ স্পষ্ট । তবুও বের হচ্ছে না। সাদেক ব্যর্থ হওয়ার না।

*আপনাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু খাবার আনবো?

*না স্যার । পেটে ক্ষুধা নেই।

* জুস খান ।

* স্যার জুস আমি খাই না।

* আপনার হাতের খাবারটি খান।

* স্যার খেতে ইচ্ছা  হচ্ছে না।

(বাকি অংশ পড়ুন তৃতীয় পর্বে)

/এম / এআর