ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ধুম্রজাল
যথাসময়ে নির্বাচন আশ্বাস ভিসির; শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০৯:৫৮ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৯:২৯ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার
উচ্চ আদালত ৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়ার পরপর সক্রিয় হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসের ছাত্র সংগঠনগুলো। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আদালতের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এদিকে যথা সময় নির্বাচন আয়োজন করতে কার্যত উদ্যোগ দেখা না মিললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক উপাচার্য (ভিসি) আখতারুজ্জামান বলছেন যে, “নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যথাসময়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে”। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
এবিষয়ে ডাকসু’র সাবেক নেতারা বলছেন, ‘যথাসময়’ ‘যথারীতি হবে’ এমন কথা বলে আগের অনেক ভিসি তাদের বলেই দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছেন। এছাড়া অনেকেই কর্তৃপক্ষের দোহাই দিয়ে দায় সাড়া হয়েছে। এদিকে নিজেদের ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ক্ষমতাসীন দলও কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলেরও এ বিষয়ে তেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।
গত ১৭ জানুয়ারি বুধবার আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভিসিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ নির্দেশনা ইতোমধ্যে ঢাবির কর্তৃপক্ষের কাছেও পৌঁছেছে।
কিন্তু এখনও এবিষয়ে তেমন কোন পদক্ষেপ চোখে পরেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনা দেয়ার পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের কর্তৃপক্ষের মনোভাব জানতে চেয়েছেন। আপিল করার বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ ঠিক থাকলে শিক্ষার্থী ও নেতাকর্মীদের সাড়া মিললেই যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সাবেক ও বর্তমান ছাত্র নেতারা মনে করছেন, গত ২৭ বছরে ছয়জন অধ্যাপক উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু কেউই ডাকসুর নির্বাচন দিনে পারেন নি। বর্তমান উপাচার্যও ব্যর্থ হবেন বলেই ধারণা তাদের। হাইকোর্টের বেঁধে দেয়া ছয় মাস সময় শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলার অজুহাতে সময় চাইবেন বলেন মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, “ডাকসু নির্বাচন একটি বিরাট বিষয়। এতোমধ্যে নির্বাচন করতে আদালত সময় বেধে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ ঠিক থাকলে ‘যথাসময়ে যথারীতি নির্বাচন হবে”।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইনামুজ্জামান একুশে টিভি অনলাইকে বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ এ বিষয়টি দেখছে।
তবে আইন বিভাগ বলছে, আমাদের কাজটি রাষ্ট্রীয় আইন কর্মকর্তারাই করছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলরা দেখছেন। বাস্তবায়নের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এদিকে ছাত্র নেতাদের মধ্যে তেমন কোন উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।
এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, বড় দুই দলের ‘দলবাজির’ কারণে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছে না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের কারণে এই নির্বাচন বার বার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদেরকে এই বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটা হচ্ছে না মূলত বড় দুটি দলের দলবাজির কারণে এবং তাদের ‘ক্যাডার-কালচারের’কারণে। নির্বাচন হলে ক্যাডারদের পেশিশক্তি ও আধিপত্য কমে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই শক্তির উপর নির্ভর করেই তাদের প্রশাসন চালায়, তাই তারা নির্বাচন দিতে চায় না। অদাললে নির্দেশ নিয়েছে ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে ঠিক সময় হবে কিনা আমরা আশংকা রয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনের আয়োজনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের আগে বিশ্ববিদ্যাল ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে সবার অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে। সরকার ভিন্ন মতের সুযোগ সঙ্কুচিত করে এমন একটা জায়গায় এসেছে যে ভিন্ন মত প্রকাশের জায়গা একেবারে তারা বন্ধ করে দিতে চায়।
তবে নির্বাচন নিয়ে বেশি তৎপর রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম সংগঠনগুলো। আদাতলের রায়ের পর থেকেই বিভিন্ন ব্যানারে মিছিল করতে দেখা গেছে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর। দেয়াল লিখন, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালন করছে তারা।
এবিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, আদালতের নির্দেশনায় অতিদ্রুতই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। এর আগে সকল ছাত্র সংগঠনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এব্যাপারে ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকা বলেন, ডাকসুসহ সব ছাত্রসংসদ নির্বাচন আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। ইতোমধ্যে আদালত নির্দেশ দিয়েছে। আমরা চাই আদালতের নির্দেশ অনুয়ায়ী যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশের রাষ্ট্রপতি। এরপর আর নির্বাচন হয়নি। গত ২০ বছরে ছয়জন অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন, কথার ফুলঝুড়ি ছুড়লেও কেউই নির্বাচন দেননি।
২০০৫ সালের মে মাসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ওই ঘোষণার পর ছাত্র সংগঠনগুলো নড়েচড়ে বসে। ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার মিছিল সমাবেশ এবং ভিসির কাছে স্মারকলিপিও দেয়। তবে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো এগিয়ে আসেনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দায়িত্ব নেয়ার পরই নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হন।
সর্বশেষ ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থীর করা একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলার যাবতীয় সহায়তা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও নির্দেশ দেন আদালত
//এস এইচ এস//