ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

মতামত

প্রচলিত মূল্যায়নই আত্মহত্যার মূল কারণ

মো. রাসেল কবীর

প্রকাশিত : ০৪:৫৮ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০১:৩৫ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

‘জেএসসি/এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেয়ে ছাত্রের আত্মহত্যা’। প্রতিবছরই বোর্ড পরীক্ষার পর এ রকম কিছু সংবাদ গণমাধ্যমে দেখে থাকি। এ সব সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক, টুইটার) ‘কেন আত্মহত্যা করা উচিত না’ এই বিষয়ের ওপর লেখা-লেখিও করেন।  কিন্তু কার্যত তেমন লাভ হয় না বা হচ্ছে না বলা যায়। ঘটনা যা ঘটার তা-ই ঘটে বা ঘটছে। কারণ আমরা আত্মহত্যাকে পরিহার করতে বলি কিন্তু আত্মহত্যা করতে চাওয়ার পিছের কারণগুলোকে এড়িয়ে যাই।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, আমাদের দেশে বোর্ড পরীক্ষার ফল যতটা না ব্যক্তিগত ব্যাপার  হয়ে দাড়িয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পারিবারিক বা সামাজিক মান সন্মানের ব্যাপার হয়েছে। শিক্ষার্থীর পরিবারের পুরো সম্মান যেন জড়িয়ে থাকে "জিপিএ ৫" এর সঙ্গে। বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের জিপিএ-৫ এর জন্য অনেক পরিশ্রমও করেন। যখন কোন ছাত্র বা ছাত্রী জিপিএ-৫ না পায় তখনই পরিবারের সব হতাশা গিয়ে পড়ে ওই ছাত্র বা ছাত্রীর ওপর। অভিভাবকদের দুঃখ লাগে বলেই তারা এমন আচরণ করেন, কিন্ত আমরা এটা ভুলে যাই যে ওই ছাত্র বা ছাত্রীর নিজের মধ্যে যে খারাপ লাগাটা থাকে সেটা সবচেয়ে বেশি। কেউ কখনো শখ করে অকৃতকার্য হয় না বা খারাপ ফল করে না। কাজেই সে যে খারাপ ফল করেছে এই কথা বারবার বলে পরিবারের সদস্যরা ছাত্র-ছাত্রীকে আরও দুর্বল করাটা কি খুব দরকার?

এবার আসি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কথায়। উনারা অবশ্যই ভাল চান বলেই খবর নিতে ফোন করেন, বাসায় চলে আসেন, মিষ্টি খাওয়ার আবদারও করেন। কিন্তু যখনই খারাপ ফল শুনেন তখন এমন কিছু মন্তব্য করেন যা আমাদের অভিভাবক শ্রেণিকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। অনেকে আবার বাবা-মাকে ওই সময়ে এমন কিছু পরামর্শ দেন (যেমন, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন আপা!, ছেলের বন্ধু পরিহার করান ইত্যাদি) যা ছাত্র-ছাত্রীর ওপর ভয়ানক রকমের চাপ ফেলে। অনেক বাবা-মা তো রাগ করে নিজেদের নতুবা ছেলে মেয়ের মরণ-ই চেয়ে বসেন।  

অভিভাবকদের বলছি, আপনারা কেন এটা বুঝেন না যে, যে ছেলে বা মেয়েটা খারাপ করল তার চেয়ে বেশি পরাজিত বোধ ওই মুহূর্তে আর কেউ বোধ করে না, এমনকি আপনারাও না। আপনাদের মধ্যে কাজ করে রাগ আর ওদের মধ্যে কাজ করে একইসঙ্গে খারাপ ফলের দুঃখ, পরিবারের সম্মান নষ্ট করার দুঃখ, মানুষের কটুক্তির কষ্ট আর হতাশা ও বিষাদ তো আছেই। এমন অবস্থায় গালি যদি খেতেই থাকে এবং আপনাদের আপনাদের মনের অবস্থা যদি বেশি খারাপ থাকে তাহলে সে বেঁচে থাকতে চাইবেই বা কেন? তারা এগুলো থেকে পালানোর জন্য আত্মহত্যার থেকে ভাল বা সহজ কোন উপায় আর দেখে না। এটা কি আসলে আত্মহত্যা নাকি খুন? আপনারা ওদেরকে মানসিকভাবে মারেন, আর ওরা নিজেদের শরীরে মারে! খারাপ ফল করলে ছেলে-মেয়েক বকা-ঝকা করার আগে একটু চিন্তা করা উচিৎ যে ফল আগে নাকি আপনার সন্তান আগে?

ছাত্রদেরও এটা মনে রাখতে হবে যে আপনাদের জন্মের পর থেকে বাবা-মা খুবই কষ্ট করেন আপনার মঙ্গলের জন্য। কাজেই আপনার একটা অসফলতায় তারা একটু আধটু প্রতিক্রিয়া করবেন (অনেক বাবা-মা আছেন যারা এই একটু আধটু প্রতিক্রিয়াও করেন না উল্টা আরও উৎসাহ যোগান পরবর্তীতে কিভাবে ভাল করা যায়।) এটাই কি স্বাভাবিক না? সেজন্য গলায় দড়ি দিয়ে (বা অন্যভাবে) মরে যাওয়াটা তো খুব স্বার্থপরের মত কাজ হয়ে যায়। ব্যাপারটা এমন যে বাবা-মার থেকে শুধু নিয়েই গেলাম, আর দেওয়ার বেলায় কিছু না দিয়ে মরে গেলাম। এটা কি ঠিক?

আর যাই হোক, ভালো ফলের জন্য কখনও কারো  জীবন আটকানোর কথা  শুনিনি। পৃথিবীতে এমন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন বা ছিলেন যারা স্কুল বা কলেজ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন কিন্তু পরে জীবনে ঠিকই সফল হয়েছেন। ফেসবুকের কল্যাণে মার্ক জাকারবার্গকে আমরা অনেকেই খুব ভালভাবে চিনি। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং তিনি সেখানে তার পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাই বলে তিনি কিন্তু জীবন থেকে ছিটকে যাননি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথাই ধরুন, যিনি মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। অথচ আজ দেশে ও দেশের বাইরে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার লেখা কবিতা, নাটক ও উপন্যাস পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার নামে কত কত স্থাপনা হয়েছে! আর এর সবই সম্ভব হয়েছে তার জীবনের কল্যাণকর কর্মের জন্য।

সুতরাং, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে বা খারাপ ফল করলে, ‘সবকিছু শেষ’ মনে করে ভেঙ্গে পড়া যাবে না। পরের বার আবার পরীক্ষা দিতে হবে, আর আশানুরূপ ফল  না হলে পরে আবার শিক্ষা জীবনে সেটা পুষিয়ে নিতে হবে। আর সর্বোপরি নিজের হতাশা ও কষ্টকে  নিজের শক্তিতে, জিদে পরিণত করতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, ‘ব্যর্থতা পরাজিতদের হারিয়ে দেয় কিন্তু বিজয়ীদের অনুপ্রাণিত করে”।

লেখক: গ্রীণ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক।

এসএইচ/