ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

কোটি লোকের কর্মসংস্থানে বাস্তবায়িত হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল

ইয়াসির আরাফাত রিপন

প্রকাশিত : ০৮:০৪ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১১:৪২ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বছরে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের প্রত্যাশা নিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (স্পেশাল ইকোনমিক জোন) প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেছে। এ অঞ্চলগুলো এখন বাস্তব রূপ পাচ্ছে।

বেজা ইতিমধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স প্রদান করেছে। আর ৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। উৎপাদন শুরু হয়েছে চারটি অঞ্চলে। বর্তমানে ১২টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলমান রয়েছে। বেজা আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। যেখানে ১ কোটির লোকের কর্মসংস্থান হবে।

এছাড়া মংলা ও মিরসরাই অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ে ডেভেলপমেন্ট নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং কক্সবাজারের নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের ২১২ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ১ দশমিক ৫বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ৪৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া মীরসরাই ও ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে প্রাপ্ত ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য প্রস্তাব অনুমোদন করেছে বেজা। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বেজার এ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করছেন। তবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলমান রাখা এবং সঠিক সময়ে উৎপাদন শুরু করার বিষয়ে তারা জোর দিয়েছেন।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে ১কোটি লোকের কর্মসংস্থানের টার্গেট নেওয়া হয়েছে। যেখান থেকে আগামী ১৫ বছরে ৪ হাজার কোটি ডলার রফাতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৭৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান চূড়ান্ত হয়েছে। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে ২৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলমান রয়েছে। পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে তা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড, সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক। এখান থেকে দেশ বড় ধরনের বেনিফিট পাব যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখবে। তবে এসব অঞ্চলে সার্বক্ষণিক গ্যাস, বিদ্যুৎ-এর ব্যবস্থা রাখতে হবে বলেও জানান সাবেক এ গর্ভনর।

বেজার প্রকাশিত প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, ৫০ বছরের চুক্তিতে সর্বনিম্ন তিন একর করে জমি বরাদ্দ পাবেন একজন বিনিয়োগকারী। ইজারার মূল্য এককালীন অথবা বছরে বছরে পরিশোধ করতে পারবেন তারা। আর বছরে বছরে পরিশোধের ক্ষেত্রে মূল্য বেশি পড়বে। তবে বেজা এককালীন মূল্য পরিশোধে আগ্রহীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় শিল্প, বিশেষায়িত শিল্প, রপ্তানিমুখী ও আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ জন্য বেজার কাছ থেকে ১২৫ ডলার বা ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ফরম কিনে তা পূরণ করে প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ বেজার কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। বিনিয়োগ করলে ধাপে ধাপে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধার পাশাপাশি নানা ধরনের করের সুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা।

গত ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করা হয়। এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানান, মীরসরাইয়ে এরই মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি জমি নিয়েছে। সবগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন হলে দেশের দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সারাদেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যও বিভিন্ন জেলায় জমি অধিগ্রহণ কাজ শুরু হয়েছে।

মিরসরাই ও ফেনীতে ৩০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। তবে প্রত্যেক জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে মনে করে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।

এ বিষয়ে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ একুশে টেলিভিশনকে জানান, দেশের প্রতিটি জেলাতে অর্থনৈতিক অঞ্চলক করা সম্ভব না। কারণ কোনো কোনো জেলাতে জমি সল্পতা আর ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণে প্রত্যেক জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মত বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে প্রতিটি অঞ্চলে না হলেও জেলাগুলোর কাছাকাছি কোনো স্থানে করা যেতে পারে। যেমন বগুড়াতে করলে দিনাজপুর জেলার পারবর্তীপুরে এটা করার দরকার আছে বলে আমি মনে করিনা। আবার কুষ্টিয়া, খুলনার মতো জায়গাতে এগুলোর দরকার আছে। মূল কথা লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে।  

সাবেক এ গর্ভনর আরও বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল আমাদের দরকার আছে। তবে মনে রাখতে হবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। এখানে দক্ষিণ-উত্তরাঞ্চল বা অন্যান্য অঞ্চলগুলোকেও প্রাধান্য দিতে হবে। এক কথায় বৈষম্য না অর্থনৈতিক উন্নয়নই মুখ্য হতে হবে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী একুশে টেলিভশনকে বলেন, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে ৩০ হাজার একরের। যার মধ্যে ১২ হাজার একর জমি বেজার অধীনে রয়েছে। গত বছরের এপ্রিল মাসে মিরসরাইয়ে জমি বরাদ্দের বিবরণপত্র প্রকাশ করে বেজা। তবে এখন পর্যন্ত জমি বরাদ্দ অথবা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের। এসব প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৬৫০ একর জমি পাবে।

পবন চৌধুরী আরও বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে ১ কোটির লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখন চারটি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যে ১২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

বেজা সূত্র জানায়, মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ১ হাজার একর জমি রাখা হয়েছে। বেপজা সেখানে একটি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল করতে ১ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়েছে। ইজারা দেওয়ার জন্য ৫৫০ একর জমি পেয়েছে বসুন্ধরা-গ্যাসমিন-পাওয়ার প্যাক কনসোর্টিয়াম। এ ছাড়া দেশের পোশাক শিল্পের জন্য ৫০০ একর জমি দেওয়া হবে।

বেজার জনসংযোগ উপদেষ্টা মো. আব্দুল কাদির খান এ বিষয়ে জানান, সরকারিভাবে ৭৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি বেসরকারি। বাকিগুলো সরকারি ও বিদেশী বিনোয়োগে নির্মিত হওয়ার কথা রয়েছে। আর বেসরকারি ২৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ৫টি চূড়ান্ত লাইসেন্স পেয়েছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে ৪টিতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। উৎপাদনে যাওয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে দুটি মেঘনা গ্রুপের, একটি আমানের ও অন্যটি বে-এর।

কোন অর্থনৈতিক অঞ্চল পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বরাদ্দ পাওয়া অঞ্চলের মধ্যে মেঘনা গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চলে টিস্যু পেপার তৈরি হচ্ছে, যা দেশের বাইরে রফতানি হচ্ছে। পাশাপাশি মেঘনা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চলে অত্যাধুনিক রোবট তৈরি হচ্ছে। যা শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হওয়ার কথা রয়েছে।

 

আর/টিকে