ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড
কর্মসংস্থান সৃষ্টিই বড় চ্যালেঞ্জ
প্রকাশিত : ০৬:৪৭ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৭:৫০ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক ড. তৈয়বুর রহমান
দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে কমে আসছে শিশু ও বৃদ্ধ তথা নির্ভরশীল মানুষের অনুপাত। কর্মক্ষম জনশক্তির আধিক্য একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য বিভিন্ন দেশে এসে থাকে। এ জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়ে থাকে। এটা ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষজনের আধিক্যকেই বুঝায়। বাংলাদেশ বর্তমানে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল অতিক্রম করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১০ কোটি ৬১ লাখ মানুষ রয়েছে কর্মক্ষম। এর মধ্যে ৬ কোটি ২১ লাখ মানুষ কাজের মধ্যে রয়েছে। কর্মের বাইরে ৪ কোটি ২৪ লাখ। ২৬ লাখ রয়েছে শিক্ষিত বেকার। এ কর্মসক্ষম মানুষগুলোর সঠিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারলে এরাই অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তৈয়বুর রহমান।
সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।
একুশে টিভি অনলাইন : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছে দেশ। এ সুযোগটা আমরা কতটা কাজে লাগতে পারছি বলে আপনি মনে করেন ?
ড. তৈয়বুর রহমান : বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল শুরু হলেও পুরোপুরি প্রবেশ করছে ২০১৪ সাল থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। দেশের ১০ কোটি ৬১ লাখ লোক রয়েছে কর্মক্ষম। এর মধ্যে আমাদের কর্মশক্তি শ্রমিক রয়েছে ৬ কোটি ২১ লাখ। উন্নত এবং উন্নয়নশীল খুব কম দেশই এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী পেয়েছে। এই শ্রমশক্তিকে আমরা বাজার মুখী পড়াশুনা, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারলে এরা দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হবে। আমরা এই সুযোগটা পুরোপরি কাজে লাগতে পারছি না। এর একটা বড় কারণ হলো দেশে ২৭ লাখ জনগোষ্ঠী বেকার। তাদের আমরা এখন কোনো কর্ম নিশ্চিত করতে পারি নি। গত তিন চার বছর ধরে আমাদের দেশে জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ছে না। এমনকি আমাদের পোষাক শিল্পে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়েনি। এ কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল কাজে লাগতে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্ত কিছু সমন্বয়হীনতার কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
একুশে টিভি অনলাইন : কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
ড. তৈয়বুর রহমান : দেশের সমুদয় জনসংখ্যাতে চাকরি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। সেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। যাতে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে কাজ করতে পারে। আমাদের দেশের শ্রমিকরা বিশ্বের ২২টি দেশে কাজ করছে। কিন্তু অধিকাংশই অদক্ষ। আমার বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারছি না। আমাদের তরুণদের বাজারমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না। গণহারে গ্যাজুয়েট বের করছি। এজন্য সরকারের সুনিদ্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখা দরকার। কিন্তু এখনও সরকার কোনো পারিকল্পনা নেয়নি। দেশে কর্মক্ষম মানুষ বাড়লে দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি পায়। দেশে বহু লোক আছেন যাদের সঠিকভাবে কাজ দিতে পারছি না। অনেকেই আবার বছরের কিছু সময় কাজ করে সারা বছর বসে থাকে। এজন্য কাজ থাকলেও সমন্বয় না থাকার কারণে আমার বিপুল জনগোষ্ঠীকে কাজ দিতে পারছি না। এজন্য সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। শিক্ষিত যুবকরা উদ্যোক্তা হয়ে গ্রামের যুবকদের কাজে কাজে লাগাতে পারে। এটা করলে একদিকে যেমন নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে অন্যদিকে বহু বেকারেরও কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ উদ্যোগ নিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে পারে। তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রণোদনাও দিতে পারে। মোটকথা তরুণ সমাজকে বেকার রাখা যাবে না। তাদের কাজে লাগাতে হবে।
একুশে টিভি অনলাইন : বিশ্বে আর কোন কোন দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছে। ওইসব দেশ কিভাবে এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে?
ড. তৈয়বুর রহমান: চীন, থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করেছে। অনেকেই এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। ভারত তথ্য-প্রযুক্তিতে বিপুল জনশক্তির কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। অন্যান্য দেশগুলো কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আগে ‘মাষ্টারপ্ল্যান করেছে। সেই অনুযায়ী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই নেই।
একুশে টিভি অনলাইন : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) সুযোগ কাজে লাগাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো যে সব কৌশল নিয়েছে আমরা সেগুলো অনুস্মরণ করতে পারি কি না ?
ড. তৈয়বুর রহমান : বিশ্ববাজারে চাকরির চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিপুল কর্মক্ষম মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাকে বাজার মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণেরর ব্যবস্থা শ্রমশক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য দেশ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে আমরাও যাচাই বাছাই সেগুলো অনুস্মরণ করতে পারি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : দেশে প্রচুর কর্মক্ষম মানুষ। তারা কাজ পাচ্ছে না। এদের দক্ষ করে কাজে লাগাতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে ?
ড. তৈয়বুর রহমান: বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিশ্বের ২২টি দেশে কর্মরত রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় আমাদের শ্রমিকরা অনেক কম বেতননে কাজ করে। এর একটি মাত্র কারণ আমাদের দেশের শ্রমিকরা তেমন দক্ষ নয়। একারণে কর্মক্ষম মানুষদের দক্ষ করে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষা ও বাজার মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কর্মক্ষম যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হলে দেশের চাকরির বাজারের চাহিদা কী আছে, অন্যান্য দেশে কী চাহিদা আছে, সব চাহিদাগুলো সামনে রেখে একটি সমন্বিত মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। এখানে সরকারি বেসরকারি সংস্থাকে সস্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্বের দূতাবাসগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে।
একুশে টিভি অনলাইন : অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী ২০৩৪ সালের মধ্যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। কিভাবে আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারি-একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে আপনার মতামত …
ড. তৈয়বুর রহমান : প্রত্যেক দেশে বিভিন্ন সময় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (কর্মক্ষম বা জনসংখ্যা) সুযোগ আসে। বাংলাদেশেও ২০০৭ সালে আসলেও পুরোপরি এসেছে ২০১৪ সালে। ইতোমধ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সবার সম্মিলিতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব। দেশ-বিদেশের কাজের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলতে হবে। তাদের কাজে লাগাতে না পারলে এই সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হবো।
একুশে টিভি অনলাইন : কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুষ্ঠু মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটা প্রশ্ন চলে আসে। আমরা সঠিকভাবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে পারছি কি না?
ড. তৈয়বুর রহমান : আমি আগেই বলেছি বাজার মুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমার বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠাচ্ছি কিন্তু তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে পারচ্ছি না। সরকারি চাকরিতেও তেমন প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। নিয়োগের পর প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গণহারে গ্রাজুয়েট বের না করে কর্মমুখী গ্রাজুয়েট বের করতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে অনেক বিশেষজ্ঞ বোঝা মনে করেন, আপনিও তাই মনে করেন কি না?
ড. তৈয়বুর রহমান : আমি বোঝা বলতে রাজি নয়। কারণ আমি যদি সঠিকভাবে জনসংখ্যাকে ব্যবহার করতে তাহলে সম্পদ। এটা নির্ভর করবে আমাদের উপর। আমার জনসংখ্যার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এরা সম্পদে পরিণত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে কাজে লাগতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চীন, রাশিয়া, জাপান। তারা পারলে আমরা কেন পারবো না?
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি দেশে থাকে ৩৫ থেকে ৪০ বছর। এটাকে মাথায় রেখে যদি আমার সুনিদ্দিষ্ট পরিকল্পনা নিই তবেই আমরা সফল হবো। কর্মক্ষম মানুষদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারলেই বিপুল জনশক্তি বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: মূলবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. তৈয়বুর রহমান: একুশে টিভি পরিবারকেও ধন্যবাদ।
‘‘ড. তৈয়ুবর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন অধ্যাপক। তিনি ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ বিভাগের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২0১১ সালের জানুয়ারী থেকে ২0১৪ সালের জুন পর্যন্ত কাজাখস্তান ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিকস, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ (কেআইএমএইপপি বিশ্ববিদ্যালয়) এ এসোসিয়েট প্রফেসর এবং পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদে তিনি কাজ করেছেন। তার পিএইচডি হংকংয়ের সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’’
/ এআর /