ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ব্যয় বাড়বে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৬:৩৪ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৯:৩২ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার

বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে ডলারের দামও। এর ফলে আগের লাভজনক অবস্থা থেকে এখন লোকসান করছে বাংলাদশে পেট্রোলিয়াম করপোরশেন (বিপিসি)। অন্যদিকে গ্যাস সংকটের কারণে আসছে গ্রীষ্ম এবং সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে তেলের দাম বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনৈতিতে চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম হওয়ায় গত সাড়ে তিন বছর ধরে মুনাফা করে আসছিলো বাংলাদেশ পেট্রেলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি। কিন্তু দুই মাস ধরে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রবণতার কারণে বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৭০ ডলারে উঠেছে। ফলে গত ডিসেম্বর মাসে বিপিসির লোকসান হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। দেশে তেলের চাহিদা এখন বেশি হওয়াতে বিপিসির লোকসান আরও বাড়বে।


সূত্রমতে, বর্তমানে পেট্রোল ও অকটেনে মুনাফা করলেও প্রতি লিটার ডিজেলে চার টাকার বেশি এবং ফার্নেস তেলে প্রায় ১০ টাকা করে লোকসান দিচ্ছে বিপিসি। কিন্তু পেট্রল ও ডিজেলের ব্যবহার অনেক বেশি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের। লোকসানের আরেকটি কারণ হচ্ছে ডলারের দাম বৃদ্ধি। কারণ তেলের আমদানি মূল্য এবং বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের দামও পরিশোধ করতে হয় ডলারে।

বিপিসি`র জানায়, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দুই বছর ছিল ৩০ থেকে ৫০ ডলারের মধ্যে। এর ফলে ২০১৪-১৫ সালে চার হাজার ২০৮ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ সালে সাত হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ সালে চার হাজার ৫৫১ কোটি টাকা লাভ করে বিপিসি।

২০১৭ সালে দেশে মোট প্রায় ৫৯ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে। এ বছর মোট ৬১ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে ৫০ লাখ টনের বেশি থাকবে ডিজেল ও ফার্নেস তেল। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার বাড়ানোর জন্যই তেলের আমদানি বাড়াতে হচ্ছে বলে বিপিসি সূত্র জানায়।

এদিকে চলতি বছর গ্রীষ্মে ১৩ হাজার ৬৭৫ মেগাওয়াট এবং সেচ মৌসুমে ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চাহিদা ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হলেও এসময়ে ৫ ভাগ প্রাথমিক খরচ এবং ৩ ভাগ সঞ্চালন-ক্ষতি বাদ দিয়ে ১১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করতে হবে। গত বছর সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। গড় উৎপাদন ছিল ৯ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এবার সেচের সংকট সামাল দিতে আরও অতিরিক্ত সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সরকার শেষ সময়ে এসে সংকট সামাল দিতে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করছে। এ বছরের মধ্যে আরও প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর কাজ চলছে। মাস দেড়েকের মধ্যে শুরু হতে যাওয়া সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোই বেশি করে চালাতে হবে। ফলে গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন তেল বেশি আমদানি করতে হবে।


পিডিবি বলছে, তাদের পক্ষে ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য প্রতিদিন এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ দিতে হবে, যা এখন ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত বছর গ্রীষ্মেও এই গ্যাসের সরবরাহ ছিল এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।


চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করার কোনো প্রতিশ্রুতি এখনও দেয়নি পেট্রোবাংলা। তবে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস পাওয়ার আশা করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। সংকট সামাল দিতে পিডিবিকে এনার্জি ব্যালান্সসহ জেনারেশন সিডিউল তৈরি করতে বলা হয়েছে। এই জেনারেশন সিডিউল হচ্ছে কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র কী পরিমাণ উৎপাদন করতে পারবে, তার একটি চিত্র আগে থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের হাতে থাকবে। কোনো কারণে উৎপাদনে থাকা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না নেওয়া হলে তাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে।


পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে সেচ মৌসুমে সার কারখানা বন্ধ রেখে রেশনিং করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এবারও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যতবেশি সম্ভব গ্যাস দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।


জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ সংকট তো লেগেই আছে। এর কোনো সুরাহা হয়নি। তার কারণ হলো সরকার আবার জরুরি ভিত্তিতে উচ্চমূল্যের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে যাচ্ছে। যেটা করা হয়েছিল ২০০৯-১০ সালে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল নামে। বিদ্যুতের দূরাবস্থা মোকাবিলার জন্য ১০ বছর আগেও যা করা হয়েছিল, এখনও তাই করা হচ্ছে।


এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? জবাবে তিনি বলেন, সরকারকে জনবান্ধব হতে হবে। বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন পরিকল্পনা নীতি গণবান্ধব, জনকল্যাণমূলক হতে হবে। সরকার সে জায়গা থেকে সরে গিয়ে এখন ব্যবসায়ীবান্ধব হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে পলিসি তা কারিগরি ভিত্তিক নয়। এ কারণে কিছু ব্যবসায়ীর উত্থান নিশ্চিত করছে। সেখানে মানুষ বিদ্যুৎ পাবে কী না, বা পেলেও সাশ্রয়ী মূল্যে পাবে কী না তা লক্ষ্য নয়। এখানে বিদ্যুৎ একটা উপলক্ষ মাত্র। এর মাধ্যমে কিছু ব্যবসায়ীর মুনাফা নিশ্চিত করা, তাদের ভিত মজবুত করাই মূল লক্ষ্য সরকারের। এরকম থাকলে যা অবস্থা হওয়ার কথা তাই হচ্ছে। এর পরিণতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর তিন লাখ ৬৫ হাজার সেচ পাম্প বিদ্যুতে চালানো হবে। সারাদেশের মোট সেচ পাম্পের মধ্যে ৮০ ভাগ চলে বিদ্যুতে। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে বেশির ভাগ ডিজেলে এবং কিছু চলে সৌর বিদ্যুতে।


এই বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিশ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রাথমিকভাবে বিপিসি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সরকার যদি ‘রিটেইল’ গিয়ে তেলের দাম বৃদ্ধি না করে তাহলে বিদ্যুৎ খতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। এখনও পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে নতুন করে তেলের দাম নির্ধারণ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সুতরাং বিদ্যুৎ খাতে আপাতত কোনো সমস্যা হবে না।


তিনি আরও বলেন, সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে আমরা কী পরিমান গ্যাস পাব, অন্যান্য জ্বালানি দিয়ে কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে, চাহিদা কত হবে? এ সবকিছু বিবেচনা করে পরিকল্পনা করা হয়েছে। ফলে কোনো সংকট তৈরি হবে না।

টিকে