সাধু যোসেফের স্কুল
পাঁচশ’ টাকায় থাকা-খাওয়ার সুযোগসহ কারিগরি শিক্ষা
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০৭:২৭ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১০:৫৩ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার
শুনে অবাক হলেও সত্য যে, মাসে মাত্র পাচঁশ’ টাকায় মিলছে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা। সঙ্গে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাও। রাজধানীর পুরান ঢাকার নারিন্দার শাহ সাহেব লেনে অবস্থিত সাধু যোসেফের এই বিদ্যালয়টি এই অঞ্চলে কারিগরি শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। বিদ্যালয়টিতে মিলছে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগও। কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি এখানে রয়েছে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ।
সেন্ট যোশেফ কারিগরি বিদ্যালয়টিতে দারিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিতদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। দেশের অল্প শিক্ষিত যুবকদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৪ সালে ১৯ মার্চ ব্রাদার অ্যান্ডু স্টেফাস নারিন্দায় এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৩ বছর ধরে এই বিদ্যালয়টি পাঁচটি বিষয়ে (মেশিন, ফিটিং, কার্পেন্ট্রি, ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক) তিন বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। এসবের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে স্কুলটি।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাতা ব্রাদার অ্যান্ড্রু স্টেফাস। তাঁর জন্ম ১৯০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে, ধর্মে তিনি একজন খ্রীষ্টান। যুক্তরাষ্ট্র খেকে পড়াশুনা শেষ করে ১৯২৬ সালে চলে আসেন বাংলাদেশে। কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকার নবাবগঞ্জের বান্দুরায় হলিক্রস স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে অ্যান্ড্রু স্টেফাস পুরান ঢাকার নারিন্দায় একটি স্কুলে বদলি হয়ে আসেন। ছোট বেলা থেকে তার স্বপ্ন ছিল কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। এছাড়া ঢাকায় আসার পর দেখতে পেলেন অনেক যুবক দাবিদ্রের কারণে পড়াশুনা করতে পারছে না। অনেকেই স্কুলেও যাচ্ছে না। এসব ঝড়ে পড়া কিশোর-তরুণ এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে অ্যান্ড্রু স্টেফাস নারিন্দায় কারিগরি এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা।
গত সোমবার বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, অন্য আট-দশটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে একেরারেই ব্যাতিক্রম বিদ্যালয়টি। ক্যাম্পসে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি মাঝারি আকারের মাঠ। মাঠের পশ্চিম পাশে শিক্ষার্থীদের জন্য পাচঁতলা আবাসিক হল। মাঠের চারপাশেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। একপাশে রয়েছে বিশাল পুকুর। যেখানে শিক্ষার্থীরা গোসল করে। পুকুরের পাশে রয়েছে অফিস। যেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
এসময় কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, এখান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অনেক বিদেশেও কাজ করছেন। আকিব নামের এক শিক্ষার্থী জানান, তার বড় ভাই এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন দেশের প্রতিষ্ঠিত এক বেসরকারি কোম্পানিকে চাকরি করছে।
প্রতিবছর ৫০ শিক্ষার্থী এখান থেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী দেশেই ভালো বেতনে চাকরি করছে।
বছরের শুরুতে ক্লাস চালু করার লক্ষ্যে নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে আবেদনপত্র বিতরণ শুরু হয় স্কুলে। এসএসসি বা অষ্টম শ্রেণি পাস করে নামমাত্র ফি দিয়ে এখানে ভর্তি হওয়া যায়। সব কোর্সই তিন বছর মেয়াদি। এখানে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়। বছরে ভর্তি করা হয় ৫০ থেকে ৬০ জন। এ পর্যন্ত পাস করে বেরিয়েছেন সাড়ে ৪ হাজারের মতো শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ব্রাদার লিনুস ডি রোজারিও একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, অনেক প্রতিকূল পরিবেশ থাকা স্বত্ত্বেও আমরা শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। দেশের কোনো মানুষ যাতে বেকার না থেকে সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবি; কাতার ও কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করছে বহু তরুণ।
প্রতিষ্ঠানটি ব্রাদারস অব হলিক্রস ক্যাথলিক মিশনের একটি অংশ। মাত্র ৫০০টাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এতে। হোস্টেলে খাবার মেন্যুতে রয়েছে সকালে রুটির সঙ্গে চা, দুপুরে নিরামিষ, এক দিন পরপর মাছ, রাতে ভাতের সঙ্গে ডালসহ নানা ধরনের সবজি। যারা আবাসিক ছাত্র না তারা মাসে তিনশ’ টাকা বেতনে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসে ৫শ’ টাকা নিয়ে কীভাবে তাদের থাকা খাওয়া ব্যবস্থা করেন জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ ব্রাদার লিনুস ডি রোজারিও বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আমাদের স্টাফদের সঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের উৎপদেনের কাজ করে থাকে। এর মাধ্যমে কিছু আয় হয়। এভাবে চলে যায় কোনো মতে। সরকারি-বেসকারি কোনো সংস্থা থেকে কোন ধরনের আর্থিক সহযোগিতা পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি বেসরকারি এমনকি বিদেশে থেকেও আমাদের কোনো সহযোগিতা আসবে না। আমরা নিজেরা তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকি। এখানে যেকোনো ধর্মের লোক প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন কিন্তু আবাসিক হলে শুধু খ্রিষ্টান শিক্ষার্থীরা থাকেন।
আবাসিক হোস্টেলে থাকতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। ক্যাম্পাসের ভিতর ধূমপান একেবারেই নিষেধ। ডিসেম্বরে ইলেকট্রিক্যালে তিন বছরের কোর্স শেষ করেন বরিশালের গৌরনদীর তপন হালদার। এই জানুয়ারিতে তিনি এই বিদ্যালয়ে পেয়েছেন প্রশিক্ষকের চাকরি। ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় তপন হালদার বলছিলেন, এখানে কারিগরি শিক্ষা যেমন মেলে, নৈতিক শিক্ষাটাও দেওয়া হয়। সাধু যোশেফের স্কুলটি দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে।
/ এআর /