গ্রন্থ-পর্যালোচনা
মীর হুমায়ূন কবীরের গবেষণাগ্রন্থ “আনিস চৌধুরীর নাটক:জীবন ও শিল্প”
রায়হান আরিফুর রহমান
প্রকাশিত : ১১:২০ পিএম, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১২:১৪ এএম, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার
ছবি : রায়হান আরিফুর রহমান
আনিস চৌধুরী (১৯২৯-১৯৯০) বাংলাদেশের বাংলাসাহিত্যের একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। আটাশিটি ছোটগল্প ও দশটি উপন্যাসের সফল রচয়িতা হলেও নাট্যকার হিসেবেই তিনি অর্জন করেছেন সমধিক খ্যাতি। এমনকি বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও লাভ করেছেন তিনি। তবে দুঃজনক হলেও সত্য যে, এই দীর্ঘ সময় পর্বে আনিস চৌধুরীর সমগ্র নাট্যবিষয় নিয়ে মূল্যায়নধর্মী কোনো গবেষণাগ্রন্থ তো নয়-ই, কোনো গবেষণা-প্রবন্ধও রচিত হয়নি। যাকে বাংলা নাটক গবেষণার দৈন্যতা হিসেবেও চিহ্নিত করা চলে। যা-ই হোক, নাট্যকারের মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর পর এই দৈন্যদশার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন বিশিষ্ট গবেষক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক, মীর হুমায়ূন কবীর (জন্ম : ৩০ অক্টোবর ১৯৮৬)। সম্প্রতি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮-কে সামনে রেখে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ “আনিস চৌধুরীর নাটক : জীবন ও শিল্প”। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। মূল্য ৩৬০ টাকা।
“আনিস চৌধুরীর নাটক : জীবন ও শিল্প” মূলত মীর হুমায়ূন কবীর-এর এমফিল অভিসন্দর্ভের (২০১৫) পরিমার্জিত গ্রন্থরূপ। গবেষক প্রধানত তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করে এই গবেষণাকর্মটি সম্পাদন করেছেন। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন ‘আনিস চৌধুরীর জীবন ও মানসগঠন’। এ অংশে তিনি নাট্যকার আনিস চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠার সূত্রধরে পারিবারিক ঐতিহ্য, অধ্যয়ন-সূত্র, কর্ম-পরসর, সংসার-পর্ব, সাহিত্য-সাধনা ও রাজনৈতিক সচেতনা চিহ্নিতকরণ সহ সামগ্রিক জীবন-পরিসর তুলে ধরেছেন। সাবলীল ভাষায় গ্রন্থবদ্ধ করেছেন নাট্যকারের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের তথ্য-নির্ভর উপস্থাপনা। জীবন-পরিক্রমা ও মানসবিকাশের সূত্রে শিশু ‘আনিসুজ্জামান কামরুদ্দীন’ কীভাবে হয়ে উঠলেন নাট্যকার ‘আনিস চৌধুরী’, তা বিশদ ব্যাখ্যা ও গভীর বিশ্লেষণ সহযোগে গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করেছেন এই গ্রন্থের লেখক।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায় বিন্যস্ত করা হয়েছে ‘বাংলা নাট্যধারায় আনিস চৌধুরীর অবস্থান’ শিরোনামে। এ অধ্যায়ে গবেষক প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্রের নাট্যব্যাখ্যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করে বাংলা নাটকের পথযাত্রার ইতিবৃত্ত, আনিস চৌধুরীর পূর্ববর্তী ও তাঁর সমসাময়িক বিশিষ্ট নাট্যকারদের নাটক ও নাট্যপ্রবণতা, নাটকে জীবন-উপস্থাপনের কলাকৌশল ও রীতি-পদ্ধতির অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করেছেন; এবং দেশ-কাল-প্রতিবেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা নাট্যচেতনার রূপান্তরের একটি পরিপ্রেক্ষিত-পরিক্রমা উপস্থাপন করে চিহ্নিত করেছেন বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারায় আনিস চৌধুরীর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। বাংলা নাট্যধারার বিশিষ্ট নাট্যকারদের নাটক ও নাট্যপ্রবণতার সারবক্তব্য উপস্থাপন করে আনিস চৌধুরীর নাট্যপ্রবণতা সম্পর্কে যে মন্তব্য গবেষক উপস্থাপন করেছেন, তা এখানে উল্লেখকরণের দাবি রাখে :
“বাংলা নাটকে আনিস চৌধুরীর স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, সমকালীন অন্য নাট্যকারদের মতো ইতিহাস, পুরাণ কিংবা হৃত-ঐতিহ্যের ধূসর জগতে বিচরণ করেননি তিনি; বরং তাঁর সমস্ত নাট্যকর্ম জুড়েই বাংলার নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত জনশ্রেণির জীবন-যন্ত্রণার বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে তাঁর শিল্পদৃষ্টি প্রখর প্রতিবাদী না-হলেও এ শ্রেণির প্রতি তাঁর সমবেদনা প্রকাশ পেয়েছে যথেষ্ট।”
‘আনিস চৌধুরীর নাটকে উপস্থাপিত জীবনের স্বরূপবৈশিষ্ট্য’ শিরোনামে গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়টি সাজিয়েছেন লেখক। অধ্যায়টি শুরু করা হয়েছে এভাবে
“আনিস চৌধুরীর নাট্যভাবনা মূলত আবর্তিত হয়েছে সমকালকে কেন্দ্র করে। বিভাগোত্তর পর্যায়ে পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে নবীন সমাজের গোড়াপত্তন হয়, যে ভাঙাগড়াময় জীবনবৃত্তে তিনি বিচরণ করেছেন, সেই জীবন ও সমাজের ঘনিষ্ঠ রূপকার তিনি। নাটকের কাহিনি নির্বাচনে তিনি ইতিহাসের দ্বারস্থ হননি, দূর কিংবা নিকট অতীতকে গ্রহণ করেননি, বরং সমকালীন। ... বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রারম্ভে মধ্যবিত্ত সমাজে যে নাগরিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে তারই বাস্তব চিত্র রূপায়িত হয়েছে তাঁর নাটকে। মধ্যবিত্ত জনজীবনের বিচিত্র আশা-আকাক্সক্ষা, দুঃখ-দাহ, হতাশা-বেদনা, নৈরাশ্য-যন্ত্রণার রূপচিত্রাঙ্কনে তাঁর পারদর্শিতা বিস্ময়কর। গ্রামীণ ভূস্বামী, শাহরিক ব্যবসায়ী, শিক্ষক, শ্রমজীবী নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা রূপায়ণে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর নাটকের মজিদ মাস্টার, ইনাম, কবির, আলিম, কলিম, কাইউম, রাশিদা, কিংবা মিনু সকলেরই বিচরণ মধ্যবিত্ত পরিবৃত্তে। দারিদ্র্যের কঠিন নিপীড়ন এবং উত্তরণের আকাক্সক্ষায় তারা সংগ্রামলিপ্ত। এ সংগ্রামে কেউ বিজয়ী হয়েছে, কেউ জীবনযুদ্ধে পরাজয় বরণ করে তলিয়ে গেছে অতল গহ্বরে।”
এমনিভাবে আনিস চৌধুরীর নাটকের চারিত্র্য, নাট্যনির্মাণের কলাকৌশল ও রীতিপ্রকৃতি, বিভিন্ন নাটকে উপস্থাপিত প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রসমূহের সৃজনকৌশল, জীবন-বৃত্তান্ত ও জীবনপ্রবণতা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে নাট্যকারের সামগ্রিক প্রবণতার বিশদব্যাখ্যা একের পর এক তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তির মালা গেঁথে উপস্থাপন করেছেন গবেষক মীর হুমায়ূন কবীর। অতঃপর তিনি একটি একটি করে নাটক ধরে ধরে প্রতিটি নাটকের চুলচেরা পর্যালোচনা করেছেন। পর্যালোচনার এই প্রক্রিয়ায় স্থান-দেয়া বারোটি নাটককে সাজানো হয়েছে দুটো পৃথক পরিচ্ছেদে। ‘বিভাগোত্তরকালের নাটক’ শিরোনামের প্রথম পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে দেশ-বিভাগের পরে এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে রচিত পাঁচটি নাটক : ‘মানচিত্র’ (১৯৬৩), ‘এ্যালবাম’ (১৯৬৫), ‘প্রত্যাশা’ (১৯৬৭), ‘ছায়াহরিণ’ (১৯৬৮) এবং ‘যখন সুরভী’ (১৯৬৯)। অন্যদিকে ‘স্বাধীনতা-উত্তরকালের নাটক’ শিরোনামের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বিশ্লেষিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রচিত ‘যেখানে সূর্য’ (১৯৭৪), ‘চেহারা’ (১৯৭৯), ‘তবু অনন্য’, ‘নীলকমল’ (১৯৮৬), ‘তারা ঝরার দিন’, ‘বলাকা অনেক দূরে’ এবং ‘রজনী’ শীর্ষক সাতটি নাটক।
প্রতিটি নাটক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নাটক রচনায় নাট্যকারের প্রবণতা ও স্বাতন্ত্র্য, উপস্থাপিত নাট্যকাহিনির প্লট-বিন্যাস ও ঘটনা-পরিপ্রেক্ষিত, চরিত্র-পরিচয় এবং চরিত্র-সৃজনের যৌক্তিকতা সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা, চরিত্রানুগ সংলাপ তৈরির কারিশমা, ভাষা-শৈলী ও অলংকার উপস্থাপনের অভিনবত্ব অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, অথচ সুগভীর বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে পর্যালোচনা করেছেন গবেষক। এ-গ্রন্থ সম্পর্কে গ্রন্থের ‘প্রস্তাবনা’ অংশে গবেষণাকর্মটির তত্ত্বাবধায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর গিয়াস শামীম যথার্থই বলেছেন
“... এ-গ্রন্থে আনিস চৌধুরীর জীবনের বিভিন্ন পর্যায় সনিষ্ঠ আন্তরিকতায় বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। বিশেষত পারিবারিক ঐতিহ্য, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, আকাঙ্ক্ষিত কর্মপরিসর এবং অনুকূল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেশ তাঁর জীবন ও মানস গঠনে কতটুকু কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়েছে তা তথ্যপ্ রমাণযোগে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। সর্বমোট বারোটি নাটকের পর্যালোচনাসূত্রে তিনি দেখিয়েছেন, আনিস চৌধুরী মূলত মধ্যবিত্ত জীবনের নিপুণ রূপকার এবং সমকাল-পরিসরে তিনি ছিলেন দলছুট ও স্বতন্ত্র।
প্রকৃতপক্ষে আনিস চৌধুরীর নাট্যবিষয়ে প্রণীত এ-গ্রন্থ বাংলাদেশের গবেষণা-সাহিত্যে একেবারেই অভিনব। ইতঃপূর্বে তাঁর সমগ্র নাট্যবিষয়ে মূল্যায়নধর্মী একটি প্রবন্ধও রচিত হয়নি। সেই বিবেচনায় এই গবেষণাকর্ম নিঃসন্দেহে তাৎপর্যবহ। গবেষণা-অভিসন্দর্ভ প্রণয়নে লেখক তাঁর সর্বোচ্চ অভিনিবেশ প্রয়োগ করেছেন; প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তযোগে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। বক্তব্যবিন্যাসে ও বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন পূর্বাপর তথ্যনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী। আমার বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যবিষয়ক ‘গবেষণায় আনিস চৌধুরীর নাকট : জীবন ও শিল্প’ একটি প্রশংসনীয় কাজ।”
অধ্যাপক ডক্টর গিয়াস শামীম-এর সাথে সহমত প্রকাশ করে বলা যায়, গবেষক মীর হুমায়ূন কবীর-এর “আনিস চৌধুরীর নাটক : জীবন ও শিল্প” প্রকৃতবিচারেই বাংলা সাহিত্যবিষয়ক গবেষণায় একটি প্রশংসনীয় কাজ। নাট্যকার আনিস চৌধুরীর জীবন-পরিসর, নাট্যদৃষ্টি ও নাট্যকর্ম বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গবেষকের স্বতন্ত্র অনুসন্ধিৎসু শ্যেনচক্ষু সর্বত্রই সজাগ থেকেছে।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গবেষণা পত্রিকা (বাংলা ও ইংরেজি)
e-mail: arif.du.bd11@gmail.com