ঢাকা, শুক্রবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৫ ১৪৩১

না ঘুমিয়ে যেভাবে বিশ্বরেকর্ড করলেন স্কুল বালক

প্রকাশিত : ১০:১১ এএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১০:১৩ এএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার

১৯৬৪ সালের ৮ই জানুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্ণিয়ার স্যান ডিয়েগোর সতের বছরের র‍্যান্ডি গার্ডনার নামে এক স্কুল বালক বিরাট হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলো। একটানা এগারো দিন না ঘুমানোর বিশ্ব রেকর্ড করেন তিনি। এই রেকর্ড এখনও কেউ ভাঙ্গতে পারেনি।

পুরো ঘটনাটি শুরু হয়েছিল স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় কী করা যায়, সেরকম একটি ভাবনা থেকে। র‍্যান্ডি এবং তার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা মানুষের ঘুম নিয়ে কোন একটা পরীক্ষা চালাবে। সেই বন্ধুদের একজন ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলেন, আমরা ছিলাম খুবই সৃষ্টিশীল কিছু তরুণ। বিজ্ঞান মেলায় দেখানোর জন্য আমরা কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম। আমরা প্রথমত দেখতে চেয়েছিলাম মানুষ যদি না ঘুমায়, তাহলে এর ফলে তার কোন আধিভৌতিক ক্ষমতা তৈরি হয় কীনা।

ব্রুস এবং তাঁর বন্ধু র‍্যান্ডি গার্ডনার সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা একটানা জেগে থাকার যে বিশ্ব রেকর্ড, সেটা ভাঙ্গবেন। তখন এক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ডটি ছিল হনলুলুর এক ডিস্ক জকি বা ডিজে`র। একটানা ২৬০ ঘন্টা অর্থাৎ এগারো দিনের একটু কম সময় জেগে ছিলেন তিনি।

উইলিয়াম ডিমেন্ট তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক। তিনি বলেন, আমি এ ঘটনার কথা প্রথম পড়ি সংবাদপত্রে। সান ডিয়েগোর পত্রিকায় এই ছেলেটাকে নিয়ে একটা খবর বেরিয়েছিল। সে নাকি না ঘুমিয়ে একটানা জেগে থাকার একটা নতুন রেকর্ড করতে চায়। কাজেই আমি সাথে সাথে ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উইলিয়াম ডিমেন্ট এখন ক্যালিফোর্ণিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক। বিশ্বে ঘুম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তাকে পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়।

র‍্যান্ডি গার্ডনার এবং তার বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার এবং অন্যরা মিলে ঘুম নিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন।

উইলিয়াম ডিমেন্ট বলছিলেন, সেসময় গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত আমিই একমাত্র গবেষক। র‍্যান্ডির বাবা-মা খুব হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন যে আমি এই কাজে যুক্ত হয়েছি। এই একটানা না ঘুমানোর ফলে র‍্যান্ডির কোন ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছিল তার বাবা-মা। মানুষ যদি একটানা দীর্ঘ সময় না ঘুমায়, তাহলে এর ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে কিনা, সেই প্রশ্নের কোন মীমাংসা তখনও হয়নি।

ঘুম নিয়ে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল সান ডিয়েগো ব্রুসের বাবা-মার বাড়িতে। উইলিয়াম ডেমেন্ট যখন সেখানে পৌঁছালেন, র‍্যান্ডিকে তখনও বেশ উজ্জীবীত দেখাচ্ছিল। র‍্যান্ডির ওপর তখন নানা রকম পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্রুস ম্যাকলিস্টার এবং তার বন্ধুরা। ঘুম নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে, কিন্তু র‍্যান্ডি গার্ডনারের রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি

উইলিয়াম ডেমেন্ট বলেন, রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে সেরকম বড় কোন শারীরিক অসুবিধা হয়নি র‍্যান্ডির। র‌্যান্ডি শারীরিকভাবে খুবই ভালো ছিল। কাজেই আমরা তাকে বাস্কেটবল খেলতে নিয়ে যেতাম, বোলিংয়ে নিয়ে যেতাম। যদি তখন সে চোখ বন্ধ করতো, তাহলে কিন্তু সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়তো। ও যখন চোখ বন্ধ করতো, আমি বলতাম, র‍্যান্ডি চোখ খোল। ও যখন চোখ খুলতো না, আমি তখন তাকে খোঁচা দিতাম। তবে তাকে এভাবে খোঁচা দেয়ায় সে বিরক্ত হয়েছে আমি সেটা দেখিনি বলেন ডেমেন্ট।

সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এটি নিয়ে এত বেশি মাতামাতি হচ্ছিল যে, জন এফ কেনেডির হত্যাকান্ড এবং পপ ব্যান্ড বিটলসের সফরের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচিত সংবাদ। কিন্তু যারা ঘুম নিয়ে এই পরীক্ষা চালাচ্ছিল, তাদের জন্য তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেজ্ঞ র‍্যান্ডিকে কিভাবে সজাগ রাখা যায়।

১১ দিনের এই দীর্ঘ পরীক্ষা শেষে র‍্যান্ডি এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে একজন প্রশ্ন করেন, এই পুরো পরীক্ষার অর্থটা কী দাঁড়ালো। র‍্যান্ডি জবাব দিয়েছিল, এর মাধ্যমে প্রমাণ হলো, মানুষের শরীরের চাইতে মন অনেক বেশি শক্তিশালী।

পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকেই তার এই রেকর্ড ভাঙ্গার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গিনেজ বুক অব রেকর্ড এখন আর এ ধরণের চেষ্টা কেউ করলে সেটাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। কারণ তারা মনে করে এভাবে দীর্ঘদিন একটানা না ঘুমিয়ে অনেকে তাদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।

ব্রুস ম্যাকালিস্টার র‍্যান্ডির এই পরীক্ষা অবশ্য ঘুম নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের জন্য অনেক মূল্যবান তথ্য যুগিয়েছিল। তিনি বলেন, এই গবেষণা থেকে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমরা জানতে পেরেছি তা হলো, এই পরীক্ষার সময় আসলে র‍্যান্ডির মস্তিস্কের কোন কোন অংশ ঘুমাচ্ছিল। আরিজোনার একটি সুপারকম্পিউটার এই গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই উপসংহারে পৌঁছেছিল। অর্থাৎ র‍্যান্ডির মস্তিস্কের একটি অংশ ঘুমাচ্ছিল, অন্য অংশ সজাগ ছিল। আবার হয়তো সজাগ অংশ ঘুমে চলে যাচ্ছিল। আর ঘুমিয়ে থাকা অংশ জেগে উঠছিল। আমরা যদি আমাদের বিবর্তনের প্রক্রিয়ার কথা ভাবি, এটা বোঝা খুব কঠিন নয়। অর্থাৎ আমাদের মস্তিস্ক-কে এভাবে খাপ খাইয়ে নেয়া সম্ভব, মস্তিস্কের একটি অংশ যখন ঘুমাবে, অন্য অংশ জেগে থাকবে। এ কারণেই হয়তো এই পরীক্ষার সময় খুব খারাপ কিছু ঘটেনি।

সূত্র: বিবিসি

একে/টিকে