ঢাকা, শুক্রবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৫ ১৪৩১

সিরিয়া সংকটের সমাধান কোথায়!

প্রকাশিত : ১২:২৯ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১২:৩৪ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার

মানবসভ্যতার সূচনা যেখানে, সেই মেসোপটেমিয়া বৃহত্তর সিরিয়াকে বলা যেতে পারে সভ্যতার সূতিকাগার। কিন্তু সিরিয়াতে যখন সভ্যতা মুখ লুকায়, ভূমধ্যসাগরে যখন মানবতার ভরাডুবি ঘটে, শান্তির পায়রা উড়বার মতো কোনো আকাশ যখন খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন বুঝতে হবে পরাশক্তিরা চাচ্ছে না—শান্তি আসুক সিরিয়ায়।

প্রায় অর্ধযুগ ব্যাপী সিরিয়া নিরন্তর গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। বিশ্বের পরাশক্তিদের চাঁদমারিতে পরিণত হয়েছে দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী কিছু দেশ এবং বিশ্বের পরাশক্তিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ভয়াবহ টানাপড়েনে পুড়ছে সিরিয়ার মানবতা। রাজায় রাজায় যুদ্ধের বলি হচ্ছে উলুখাগড়া-তুল্য নারী-শিশু ও নিরপরাধ মানুষ। কিন্তু এর সমাধান কোথায়?

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সিরিয়া- তুরস্ক এবং রাশিয়া উভয়ের কাছেই বেশ গুরুত্ব বহন করে। তাই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। তুরস্ক এবং রাশিয়া উভয়েই সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে তৎপর। যদিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্য রয়েছে তুরস্ক সংকটের প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। তুরস্ক এবং সিরিয়া হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর রাশিয়ার অবস্থান ভৌগোলিক মানচিত্রে সিরিয়া থেকে অনেক দূরে। অর্থাৎ সিরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে কোন সীমান্ত সংযোগ নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে রাশিয়ার কাছে সিরিয়ার গুরুত্ব বেশি। তাছাড়া বাসার-আল আসাদের সঙ্গে রাশিয়ার বর্তমান সরকারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভাল হওয়ার কারণে আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়া জটিল এক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আবদ্ধ।

যদিও দেশটির গৃহযুদ্ধে দুই বছর আগে আসাদের পক্ষ হয়ে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। সেই রাশিয়া সম্প্রতি সিরিয়ায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি করতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে এক করতে কাজ করছে। আর তুরস্কসহ বিভিন্ন বিরোধী দলকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার উপায়ও খুঁজছে রাশিয়া।

এর ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী সোচিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কূটনীতিক সংলাপ। সম্মেলনে সিরিয়া, ইরান, তুরস্ক সরকারের প্রতিনিধি, বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধি এবং সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘ দূত অংশ নেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সংলাপেই প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গে মতনৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি বিরোধী পক্ষগুলো। এর জন্য প্রধান দুটি কারণের একটি বাশার আল-আসাদের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা না থাকার ইস্যুটি। আসাদ সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যাপারে একেবারেই অনাগ্রহী। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে আলোচনার টেবিলে শান্তি আলোচনা কিংবা যুদ্ধবিরতির আহবান জানানো হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।

সোচি সম্মেলনের কয়েক দিন আগে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি বিষয়ক আলোচনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবরুদ্ধ অনেক অঞ্চলে রকেট হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, বাশার-আল আসাদ সরকারই এই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে। এসব কারণে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সোচিতে সিরিয়ার শান্তি প্রচেষ্টায় আয়োজিত সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা দেশটিতে সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠনে একমত হলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধীরা।

সোচি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা সাংবিধানিক কমিটি গঠনের রূপরেখা উপস্থাপন করেছে। ১৫০ সদস্যের এই কমিটিতে সরকার ও বিরোধী কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও চূড়ান্ত চুক্তি হবে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। তবে সিরিয়ার প্রধান বিরোধী গোষ্ঠী সিরিয়ান নেগোশিয়েশন কমিশন (এসএনসি) অভিযোগ করেছে, সিরিয়ার প্রধান বিরোধী গোষ্ঠী আসাদ বাহিনী সত্যিকার সমঝোতার পথ তৈরি করতে মোটেও আন্তরিক নয়। শান্তি আলোচনার আহবান জানালেও আসাদ বাহিনী ও রাশিয়া সামরিক শক্তি ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় পূর্বাঞ্চলীয় ঘৌওতায় যে যুদ্ধবিরতির আহবান জানানো হয়েছিল তা সরকারি বাহিনী লঙ্ঘন করেছে। তাই কাগজে কলমেও যদি কোনো লিখিত চুক্তি সম্পন্ন হয় তার ওপর কারো আস্থা থাকবে না। কারণ বাস্তব অবস্থা যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে চুক্তি বা যুদ্ধবিরতির আহবান কোনো কাজেই আসবে না।

এসএনসির পক্ষ থেকে সাংবিধানিক কমিশন গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তার পরিবর্তে সরকার এবং বিরোধীদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে সিরিয়ার সব জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সাংবিধানিক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই সাংবিধানিক কমিটিই একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করবে যার মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হবে অবাধ নির্বাচনের।

জাতিসংঘের হিসেব মতে, সিরিয়ায় ২০১১ সালে আসাদ বিরোধী আন্দোলনের মুখে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়েছে আর বাস্তুহারা হয়েছে এক কোটিরও বেশি মানুষ। আর সিরিয়া বিষয়ক শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার দুই বছরে বিশেষ করে রাশিয়ান বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৭৮৩ জন বেসামরিক লোক। সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে এক হাজার ৫৯৬ জন শিশু ও ৯৯২ জন নারী। এছাড়া রাশিয়ান বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হামলায় ২৩ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

তুরস্কভিত্তিক বিরোধী গোষ্ঠী সিরিয়ান কোয়ালিশনের মতে, নতুন সংবিধান নির্ধারণ এবং নির্বাচনের জন্য সিরিয়ায় একটি ‘নিরপেক্ষ ও নিরাপদ পরিবেশ’ দরকার। এখন সেই পরিবেশ নেই। সিরিয়ার রাস্তায় এই মুহূর্তেও ট্যাংক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিরিয়ায় সত্যিকার অর্থে শান্তি ফেরাতে হলে আগে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সিরিয়ার মানবাধিকার সংস্থা এবং পর্যবেক্ষককের মতে, যুদ্ধবিরতি কিংবা শান্তি আলোচনা যে আহবানই জানানো হোক না কেন তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বেসামরিক মানুষ হত্যা বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই।

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ‘কংগ্রেস অব দ্য ন্যাশনাল ডায়লগ’ নামে সোচিতে যে কূটনীতিক সম্মেলন হয়ে গেলো বিশ্লেষকরা তাকে সিরিয়া সরকারের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের এক মহড়া হিসেবে বিবেচনা করছে। সত্যিকার অর্থে সিরিয়ার সংকট উত্তরণে বাশার আল-আসাদের সরে যাওয়া ছাড়া প্রকৃতপক্ষে বিকল্পই নেই। কিন্তু যত যাই ঘটুক না কেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ।

সিরিয়ার এরূপ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটা বার বার আমাদের সামনে উঠে আসে তা হলো-প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাসার-আল আসাদ কি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে?

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, হয়তো পারবেন। কেননা এখনো আসাদকে প্রতিহত করার মতো শক্তির উত্থান সিরিয়াতে হয়নি। সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলো এবং পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাসার-আল আসাদ সরকারের পতন হতে পারে। আসাদের সরকার সিরিয়াতে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি-না তা মূলত চারটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। আর এগুলো হলো বাসার-আল আসাদের সামরিক শক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা, বিরোধী গ্রুপগুলোর দুর্বলতা, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ এই সংকটে বিদেশি শক্তি কর্তৃক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা এবং সবশেষে পশ্চিমা শক্তি ও জাতিসংঘ কর্তৃক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অবরোধ আরোপের প্রভাব।

এসএ/