ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

এক বিকেলে হাতির ঝিলে

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত : ০৪:১৮ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:১২ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস মহানগরী ঢাকাতে। জীবনের তাগিদে প্রতিদিনই ছুটে চলা এসব মানুষের নেই পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। তবে যানজট, শবদূষণ, খোড়াখুড়ি আর ধূলোবালিতে  ভরপূর যেন ঢাকা। রাজধানীবাসীর  অনেকের কাছেই শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গার নাম হাতিরঝিল।

ঢাকার রামপুর, বাড্ডা, গুলশান, তেজগাঁও, মগবাজার, কারওয়ান বাজার এ অংশগুলোকে এক সুতোয় গেঁথেছে হাতিরঝিল। তাই কর্মমুখী মানুষের কাছে এর গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি ছক বাঁধা জীবনের বাইরে এসে খানিকটা ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রতিদিন হাতিরঝিলে ভিড় করেন কয়েকশ মানুষ। ছুটির দিনগুলোতে সংখ্যাটা হাজার অতিক্রম করে।

বেলা গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতিরঝিলে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। লেকের পাড় ঘেষে বসানো বসার বেদিগুলোতে ভিড় করতে দেখা যায় দর্শনার্থীদের। এছাড়াও নয়নাভিরাম হাতিরঝিলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় এখানকার ব্রিজগুলো থেকে। প্রতিদিনই বিকেল থেকে রাত অবধি এসব ব্রিজে সময় কাটাতে দেখা যায় দর্শনার্থীদের।

রামপুরার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাহমিদা নিশা মাঝে মাঝেই ক্লাস শেষে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে আসেন হাতিরঝিলে। ইটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ভার্সিটি শেষে মাঝে মাঝেই বন্ধুদের নিয়ে এখানে আসি। চা এর সঙ্গে হালকা নাশতা করি। পাশাপাশি আড্ডা দেই কিছুক্ষণ। ভালো লাগে। আশেপাশে আর সময় কাটানোর মতো ভাল জায়গা নেই। তাই হাতিরঝিলেই আসি।

অফিস শেষে স্ত্রীকে নিয়ে হাতিরঝিলে নৌকা ভ্রমণ করতে আসেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে নির্মল বিনোদনের জায়গা খুব একটা নেই। দুই একটি জায়গা যা আছে সেখানেও যানজট, অব্যবস্থাপনা ও খরচ অনেক বেশি। তাই এখানে আমরা ওয়াটার ট্যাক্সিতে ঘুরতে আসলাম। জ্যাম নেই। পানির ওপরে নৌকা ভ্রমণের মত হয়ে গেল। খরচও কম।

হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য ২০১৬ সালে চালু হয় ওয়াটার ট্যাক্সি। দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য এর ব্যবহারকারী ছাড়াও মৌসুমী দর্শনার্থীদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয় এই ওয়াটার ট্যাক্সি। বিভিন্ন প্রান্ত ভেদে ওয়াটার ট্যাক্সিতে জনপ্রতি ভাড়া ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা। এছাড়াও আছে প্যাডেল বোট। ঘণ্টা ৫০ টাকা হিসেবে নিজেই চালাতে পারেন প্যাডেল বোট। হাতিরঝিলে দর্শনার্থীদের সেবা দিতে এখানে আছে ১৩টি বোট। ক্যাপস্যুল, পদ্মা ও সাধারণ ট্রলার বোট। সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পাওয়া যাবে ওয়াটার ট্যাক্সি।

যাদের নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থা নেই তারাও যেন হাতিরঝিলের মধ্যে সহজে চলাচল করতে পারে তার জন্য আছে চক্রাকার বাস। দুইটি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বাসের পাশাপাশি এখানে আছে আরও ১০টি বাস। পুরো হাতিরঝিল এলাকা অনেকটা ‘ট্যুরিস্ট বাসে’র মতে করে ঘুরে দেখা যাবে। আর এর জন্য খরচ হয় জনপ্রতি মাত্র ৩০ টাকা। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পাওয়া যায় এসব বাস।

ঘুরতে ঘুরতে দর্শনার্থীদের  কারও যদি ক্লান্ত লাগে অথবা কিছু খেতে ইচ্ছে হয় তাহলে এখানে আছে বেশ কিছু খাবার দোকান ও রেস্টুরেন্ট। হাতিরঝিলের সোনারগাঁও পয়েন্ট, তেজগাঁও পয়েন্টসহ, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মহানগর ও মধুবাগ পয়েন্টের বিভিন্ন জায়গায় নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপরই পাওয়া যাবে খাবারের দোকান এবং বিশ্রামের জন্য বসার জায়গা। তবে কিছু রেস্টুরেন্টে খাবারের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ করেন কয়েকজন ক্রেতা। রামপুরা পয়েন্টে থাকা এসওএস রেস্টুরেন্টে বাইরের রেস্টুরেন্টগুলোর থেকে খাবারের দাম বেশি বলে মনে করেন এখানে খেতে আসা দর্শনার্থী আবু জাফর। ইটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, “একটি চিকেন ফ্রাই এর দাম বাইরের দোকানগুলোতে ১০০ টাকার মধ্যে। এখানে একটা চিকেন ফ্রাই ১৫০ টাকা। এটা তো অবশ্যই বেশি। এখানকার সব খাবারই বাইরের অন্য যেকোন রেস্টুরেন্টের তুলনায় বেশি।” তবে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি রেস্টুরেন্টের কোন কর্মকর্তা।

তবে কোন রেস্টুরেন্টে না বসেও সময় কাটাতে পারেন লেকের পাড়ে। মিরপুর থেকে হাতিরঝিল বেড়াতে আসা পঞ্চাশোর্ধ ব্যবসায়ী কাওসার হোসেন বলেন, “নদী আর গাছপালা আমার খুবই ভালো লাগে। ঢাকার মধ্যে তো আর পাব না। যেগুলো আছে তাও সব দূষিত। তাই মাঝে মাঝে এখানে আসি। লেকের পাড়ে কোন একটি গাছের নিচে বসে থাকি। এখানকার বাতাস বেশ সতেজ যা মন ভালো করে দেয়”।

সন্ধ্যা নামার পর আরেক রুপে দেখা যায় হাতিরঝিলকে। পরিকল্পিত আলোক সজ্জার কারণে অনেকটা ইউরোপ আমেরিকার মতো দেখা যায় এসময় হাতিরঝিলকে। হাতিরঝিলের সড়কগুলোর পাশাপাশি ব্রিজেও আছে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা। দূর থেকে এসব ব্রিজকে দেখতে তখন লন্ডনের টাইমস ব্রিজ বা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ব্রিজের মতই লাগে! তবে কিছু কিছু জায়গায় সড়ক বাতি বিকল হয়ে যাওয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে সে জায়গাগুলো।

এছাড়াও রাত একটু গভীর হলে উঠতি বয়সী কিছু তরুণ-তরুণীদের বেপরোয়া চলাচলে প্রায়ই বিড়ম্বনার শিকার হন এখানে বেড়াতে আসা সাধারণ দর্শনার্থীরা। কেউ কেউ এখানে বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালায়। রাতের বেলা মধুবাগ ব্রিজে হাটতে আসা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ‘রাতের খাবার খেয়ে এখানে আসি একটু হাটাহাটি করতে। কিন্তু মাঝে মাঝে কয়েকটি দল এখানে খুবই বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালায়। আশেপাশে কারও দিকে খেয়াল করে না এরা। তাই তাদের দেখলে অনেক ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কাউকে দেখি আবার এখানে বসেই মাদক সেবন করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এদিকে আরও নজর দেওয়া। আমরা সবাই যেন এখানে নিরাপদে চলাচল করতে পারি সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো এই জায়গাটুকুও নষ্ট হয়ে যাবে।’

 

এসএইচ/