স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটঃ পর্ব-৩
কবরের পাশেও তুলতে হবে সেলফি?
শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত : ০৬:২১ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:১৬ পিএম, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার
প্রতিকী ছবি
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা সবাই কমবেশি ছবি তুলে রাখি। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা আর সেলফির কল্যাণে ছবি তোলা এখন আরও সহজ। তবে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের পরিমিত ব্যবহারবোধের অভাব অনেককে মানসিক রোগীতে পরিণত করেছে। ফলে তারা পরিবেশ পরিস্থিতি না বুঝে সেলফি তোলা নিয়ে মেতে উঠছেন।
সেলফি কি?
খুব সহজে বললে, নিজের মুঠোফোনের ক্যামেরা দিয়ে নিজেই নিজের ছবি তোলার বিষয়টিই এখন ‘সেলফি’ নামে পরিচিত। ইংরেজি ‘সেলফ’ শব্দ থেকে ‘সেলফি’ শব্দটির উদ্ভব। ‘সেলফ’ শব্দটির অর্থ “আত্ম” বা “স্ব” বা আরও সহজ করে বললে নিজের সাথে সম্পর্কিত কিছু। সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু মুহুর্তকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতেই সেলফি তুলে থাকি আমরা। শুধু নিজের ছবি না বরং পরিচিতজনদের সঙ্গে নিজেদেরকে একই ফ্রেমে রেখে নিজেরাই তার ছবি তুলে নিতে পারি।
সেলফি যখন মানসিক রোগ
সেলফির ধারণাটা যথেষ্ট ইতিবাচক বিষয় হলেও, এটি এখন হয়ে উঠেছে এক প্রকার মানসিক রোগ। চারপাশের প্রেক্ষাপট যেমনই হোক সেলফি তুলতেই হবে। কয়েকটি ঘটনার দিকে তাকালেও বিষয়টি পরিস্কার হবে।
ঘটনা-১
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। সেসময় কয়েকজন যুবককে কফিনে থাকা মেয়র আনিসুল হকের মরদেহের সঙ্গেও সেলফি তুলতে দেখা যায়।
ঘটনা-২
কক্সবাজারে চলন্ত হেলিকপ্টারের দরজা খুলে সেলফি তুলতে গেলে বিধ্বস্ত হয় কপ্টারটি। ক্রিকেটের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ও বাংলাদেশের গর্ব সাকিব আল হাসানকে নামিয়ে আবার আকাশে উড়েছিল ওই হেলিকপ্টারটি।
ঘটনা-৩
ইদানিং খাবারের রেস্টুরেন্ট আর দোকানগুলোতেও দেখা যায়, টেবিলে খাবার আসার পরেও অনেক সময় নিয়ে তার ছবি তোলা হয়। খাবার খাওয়ার থেকে খাবারের সঙ্গে ছবি তোলার প্রয়োজনই যেন বেশি মনে হয়। রাজধানীর একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টের এক কর্মী মন্তব্য করেন, ‘অনেক গ্রাহকদেরই দেখি যে, খাবার খাওয়ার থেকে তার সঙ্গে সেলফি তুলতেই বেশি আগ্রহী। সেলফি তোলা হয়ে গেলে খাবারের প্রতি আর কোনো আকর্ষণই থাকে না যেন তাদের। মাঝে মাঝে মনে হয় যে, আমরা কিছু খাবার তৈরি করে রাখব। আর সেগুলো সেলফি তোলার জন্য ভাড়া দিব। আমার মনে হয় এতেও অনেক বিক্রি হবে।’
গত ২১ জানুয়ারি ভারতের হায়দ্রাবাদে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি ভিডিও তুলতে গিয়ে গুরুতরভাবে আঘাত পান টি সিলভা নামের এক তরুণ। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
এছাড়া কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে দেখা যায় কয়েকজন যুবক প্রিয়জনকে কবরে শায়িত করার সময়ও সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছেন।
প্রত্যেকটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও, অনেক কিশোর তরুণদের মধ্যে অবস্থা না বুঝে সেলফি তোলার এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা অতিরিক্ত সেলফি তোলা বা স্থান-কাল পাত্র না বুঝে সেলফি তোলার এই প্রবণতাকে মানসিক রোগ বলে বর্ণনা করেছেন।
সম্প্রতি ভারতের একটি গণমাধ্যম জানিয়েছে যে, গত বছর ২০১৭ সালে শুধু অসতর্কভাবে সেলফি তুলতে গিয়েই দেশটিতে নিহত হয়েছে ৭৮ জন। অনেকে আছেন যারা দিনে ২০ থেকে ২৫ বার নিজের সেলফি আপলোড দেন সামাজিক মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
এ বিষয়ে মনবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাই কম বেশি সেলফি তুলি। সামাজিক মেলবন্ধনে এর দরকারও আছে। কিন্তু তা যখন অসচেতন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে করা হয় তখন তা এক ধরনের মানসিক রোগ।
আমেরিকান এসোসিয়েশন অব সাইক্যাট্রিস্ট থেকেও এটিকে একটি মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা বলছে, এ ধরনের মাত্রাতিরিক্ত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সেলফি তোলার রোগের নাম হচ্ছে-স্যালিফাইটিস।
মূলত আমাদের মধ্যে অনেকেই আমরা আত্মপ্রেম বা আত্মতুষ্টিতে ভুগি। আমরা যেখানেই থাকি না কেন সেখানেই নিজেকে বড় করে উপস্থাপন করতে চাই। এতে আশপাশের মানুষেরা কে কী ভাবল অথবা তাদের ওপর কী প্রভাব পরল তা আমলে নেই না। আমরা বুঝে উঠতে পারি না যে কোথায় কখন কী করা যায় আর যায় না। এ ধরনের মানসিকতার যারা আছেন তাদের মধ্যেই এমন সেলফি তোলার প্রবণতা বেশি।
তথ্য-প্রযুক্তিবিদ তানভির হাসান জোহা ইটিভি অনলাইনকে বলেন, এটা এখন খুবই বাস্তব যে, মুঠোফোন-সেলফি এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। একটি মুহুর্তকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে আলোকচিত্রের আবেদন এখনও আমাদের মধ্যে আছে। আর হালের সেলফি তো এই ধারণাটিই পালটে দিয়েছে। তবে আমাদেরকে যে কোন কিছুই দায়িত্ব নিয়ে করা উচিত। মুঠোফোনও তার বাইরে নয়। সেলফিও যদি সেই দায়িত্ববোধ আর প্রয়োজনীয়তা থেকে ব্যবহার করা যায় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
/ এআর /