রিজার্ভ চুরি
আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে মামলা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রকাশিত : ০৮:৩২ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১০:৩৯ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার
রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পেতে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি)’র বিরুদ্ধে মামলা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী তিন মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের আদালতে এ ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে।
আজ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান এ কথা জানান। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মোহাম্মদ রাজি হাসান আরও বলেন, রিজার্ভের চুরি যাওয়া অনাদায়ী অর্থের মধ্যে চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় যতটুকু আদায় করা সম্ভব হবে তা আমরা করবো। আর বাকি অর্থ ফিলিফিন্সের আরসিবিসি ব্যাংক থেকে আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, রির্জাভ চুরি হয়েছে ১০১ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলারের কোন হদিস নেই। আর ৩৫ মিলিয়ন ডলার আমরা এরই মধ্যে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি ৬৭ মিলিয়ন ডলার ম্যানিলার ব্যাংকে ফ্রিজ করা আছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ফিলিপাইনে সফর করে এসেছেন। যে প্রতিবেদন তারা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মামলার বাদী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফট কর্তৃপক্ষও থাকবে।
ডেপুটি গভর্নর রাজী হাসান বলেন, ঘটনায় আরসিবিসির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অনেকে জড়িত। এ কারণেই আমরা ফৌজদারি মামলা করতে যাচ্ছি। অবশ্য মামলা করার আগে আরসিবিসি কোনো প্রস্তাব নিয়ে এলে বাংলাদেশ তা ভেবে দেখবে বলে জানান তিনি।
এর আগে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মামলার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম থেকে গত ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর প্রথম চারটি অনুরোধে তারা ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের কয়েকটি অ্যাকাউন্টে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর করে। এরপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে ওই টাকার প্রায় অর্ধেক চলে যায় ক্যাসিনোর টেবিলে। পঞ্চম আদেশে শ্রীলংকায় প্যান এশিয়া ব্যাংকিং করপোরেশনে একটি ‘ভুয়া’ এনজিও’র অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলে সন্দেহ জাগায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা আড়াল করে। ফিলিপাইনের একটি গণমাধ্যম সর্বপ্রথম বিষয়টি প্রকাশ করে। এরপর মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেশি গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি প্রচার করার পর সরকারের নজরে আসে। এ ঘটনায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান। অন্য দুই ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেয় সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির অন্যতম মূল হোতা কিম অংয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন এমন দুজনের অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ ডলার জব্দ রয়েছে। ফিলিপাইনের সোলায়ের ক্যাসিনোর অ্যাকাউন্টে জব্দ থাকা ২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি নিজ থেকে ২২ লাখ ডলার ফেরত দিতে রাজি হয়েছে। বিষয়টি দেশটির আদালতে বিচারাধীন। মামলাগুলোর শুনানি শেষ হয়েছে। এ ছাড়া চুরির অর্থ ভাঙিয়ে দেওয়ার অপরাধে লাইসেন্স বাতিল হওয়া মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের অ্যাকাউন্টে জব্দ করা হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই অর্থ বাংলাদেশের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ফিলিপাইনের আইন মন্ত্রণালয় একটি ফৌজদারি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঘটনার জেরে তৎকালীন গভর্নরের পদত্যাগ
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এরপর অব্যাহতি দেওয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেমকে। চুরির ঘটনার ধাক্কায় ওএসডি হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম।
ফিলিপাইনে পদত্যাগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লরেঞ্জো তান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংকের নিয়মনীতি না মানার তথ্য-প্রমাণ উঠে আসে। এর আগে রিজাল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ম্যানেজার মায়া দেগুইতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব খোলা ও রিজার্ভের অর্থ স্থানান্তরের সঙ্গে লরেঞ্জো তানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলেন। ব্যবসায়ী কিম উং-ও একই ধরনের অভিযোগ তোলেন তানের বিরুদ্ধে। তবে তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দেগুইতির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন। পরবর্তীতে দেগুতো পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
মামলা
রিজার্ভ চুরি ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। পাশাপাশি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের গচ্ছিত ওই অর্থ কীভাবে লোপাট হল, তা খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি করে সরকার। সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে ওই তদন্ত কমিটি করা হয়। যদিও আজও পর্যন্ত সে তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। কয়েকবার প্রকাশের দিন ধার্য করেও শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ হয়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, আগে থেকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করলে ফিলিপাইনের যে দেড় কোটি ডলার ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা নাও পেতে পারি। তাই ফিলিপাইনের অর্থ ফেরত পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আরকে/টিকে