সুন্দরবনের গহীনে আমরা দুজন (পর্ব ১)
প্রকাশিত : ০৫:০০ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৫:০৩ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার
জীবনকে সংগ্রামী করে তুলেছি সেই বহুদিন। যান্ত্রিক শহরের ধুলা-বলি থেকে সহজে মুক্তি মেলেনা। শুধু বছরের দুটি ঈদ ছাড়া।
২০১৬ সালের কথা। সে বছর কোরবানির ছুটিতে ঢাকা থেকে খুলনায় নিজ গ্রামে আসি প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। ঈদের দু’দিন আগে প্রিয় খুলনা শহরে আমার আগমন। রুপসী রুপসার কোল ঘেষে আমার বাড়ি। ছুটিতে এসে বেশ ভালোই কাটলো দু’টি দিন। এলাকায় এক প্রতিবেশি বড় ভাই আছেন মাকসুম নাম। সিনিয়র এ ভাই আর আমি খুলনায় থাকা অবস্থায় এক সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতাম। পরবর্তিতে জীবনের সন্ধানে আমি চলে আসি ঢাকায়। তিনিও ঢাকায় নতুন চাকুরিতে যোগদেন।
ফটোগ্রাফী আমার ছোট বেলার শখ। সেই যখন প্রথম ক্যামেরা সহ মোবাইল কিনলাম তখন থেকেই একটি ডিজিটাল ক্যামেরা কেনার চেষ্টা শুরু। ঢাকায় এসে অনেক কষ্টে একটি ক্যামেরা কিনে নিলাম। তবে শুধু ডিজিটাল নয়, একেবারে ডিএসেলার। কেমেরা কেনার গল্পটি আরো দীর্ঘ। সে কথা গোপনই থাক।
খুলনায় এসে দেখি মাকসুম ভাইও ডিএসেলার নিয়েছেন। রিতিমতো ক্যামেরার সঙ্গে লেন্সও নিয়েছেন দুটি। আমিতো দেখে অবাক। মাকসুম ভাই আমাকে জানালেন সুন্দরবনের গভীরে দুবলার চরে রাস মেলার কথা।
বললেন, তুমি যদি চাও আমি যেতে পারি।
আমি কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই রাজি হয়ে গেলাম। এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। তারপরে ফটোগ্রাফী জীবনে এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তাই তার কথায় কোনো কিছু না ভেবেই রাজি।
যেমন কথা তেমন কাজ। আমার মাথায় ভ্রমণের ভুত সেই ছোট বেলা থেকেই। সেখানে এমন একজন মজার মানুষ সঙ্গী হিসেবে পাব জানতাম না।
ঈদের দিন কথা হলো পরের দিনই দুজনে দুপুরে রওনা হব। দুবলারচর যেতে কতো টাকা লাগবে আমার জানা নাই। কিভাবে যেতে হবে তাও জানতাম না। এর আগে সুন্দরবন গিয়েছি তবে এতো গভীরে যাওয়া হয়নি কখনো।
ক্যামেরার ব্যাগের মধ্যে সামান্য কিছু কাপড় নিয়ে চলে গেলাম মাকসুম ভাইয়ের বাড়িতে। তিনি তো আগে থেকেই প্রস্তুত। থ্রি-কোয়াটার পড়ে ঘাড়ে ক্যামেরা ব্যাগ ঝুলিয়ে আমার অপেক্ষায় আছেন। আমি যেতেই রিক্স নিয়ে ছুটলেন রূপসা ঘাটে। আমাদের এলাকা থেকে রূপসা ঘাট মানে নদী পাড় হয়ে তবে বাসে করে যেতে হয় মংলা। সেখান থেকে লঞ্চ বা ট্রলারে করে দুবলার চর। যাত্রাটা আমার কাছে সহজ মনে হলো। বাসে উঠব। এরপর লঞ্চে করে সোজা দুবলার চর। রিক্সা ২০ মিনিটে গিয়ে রূপসা ঘাটে হাজির।
রিক্সায় বসে মাকসুম ভাই বললেন, আমি চিনি না। তবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হলেও দুই ভাই দুবলার চরে যাব।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, অবশ্যই। এটাই তো মজা।
রূপসা ঘাটে নৌকায় করে নদী পাড়ি দিয়ে বাসে উঠে বসলাম দুই ভাই। বেশ আনন্দই লাগছে।
মাকসুম ভাই জানালেন, মংলায় যেতে হবে সন্ধ্যার অনেক আগে। কারণ বিকেলে কিছু টুরিস্ট লঞ্চ সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেই লঞ্চে যদি যেতে পারি তবে ভালো হবে।
আমি বললাম ঠিক আছে।
এই প্রথম মংলা যাচ্ছি। খুলনার ছেলে তবে সড়ক পথে মংলা যাওয়া হয়নি। এর আগে সুন্দরবনে নদী পথে রুপসা থেকে যাওয়ার পথে মংলা দেখেছি।
আমাদের গাড়ী বিকেল ৪টায় মংলা পৌছাল।
আমার কাছে ছিল মাত্র ৩ হাজার টাকা। মাকসুম ভাই হয়তো বেশি টাকা নিয়ে ছিলেন। তিনি আমাকে এমনই একটি টাকার ধারণা দিয়ে ছিলেন।
মংলা দেখতে ভালোই। মংলায় ঠিক নদীর কাছে বাস থামলো। নদী তখন বেশ শান্ত। বাস থেকে নেমে দুজন নদীর পাড়ে গেলোম। আমি তো লোভ সামলাতে পারলাম না। ক্যামেরা বের করে ছবি নিতে শুরু করলাম।
মাকসুম ভাই বললেন এখন ছবি তোলার সময় না। আগে আমাদের যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী ঘাটে অনেক নৌকা আর ট্রলার। এপাড় থেকে ওপাড়ে কিছু সময় পর পর নৌকা ছাড়ছে। আমরা এগুলাম।
মাঝিদের কাছে জানতে চাইলাম, দুবলার চর যেতে হলে কিভাবে যেতে হবে?
তারা কিছুটা মুচকি হেসে বললেন, দেরি করে ফেলেছেন। সকালে কিছু টুরিস্ট দুবলার চর গিয়েছে। তাদের সাথে যেতে পারতেন।
আমি বললাম, যা গেছে গেছে। এখন যাবার উপায় কি বলেন।
তারা সবাই একই কথা বলতে লাগলো, এখন যেতে পারবেন না। এখন কেউেই যাবে না। দুবলার চর কি এইখানে যে বললেন আর চলে গেলেন।
তখনই বুঝলাম জায়গাটি অনেক দুরে।
আমি মাকসুম ভাইকে জিজ্ঞাস করলাম, ভাই কতো দুর?
তিনি জানালেন, আমি তো জাইনি। তবে শুনেছি সুন্দরবনের গভীরে।
মাকসুম ভাই বললেন, মজার বিষয় হচ্ছে- এমন একটি চর সমুদ্রের মধ্যে যেখানে মানুষ বসবাস করেনা। কিন্তু এই সময়ে হাজার হাজার মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। বিদেশ থেকেও শত শত পর্যটক আসে।
তিনি বললেন, তুমি দেখে অবাক হবে যে সেখানে কতো ফটোগ্রাফার বড় বড় লেন্স নিয়ে হাজির হয়।
তার কথা শুনে ক্লান্তি আমার দুর হয়ে আরো উৎসাহ পেলাম। কখন আমি চরে যাবে! সেটাই ভাবছি।
কোনো মাঝি আমাদের সন্ধান দিতে পারলো না। কি অদ্ভুৎ। এমন একটি জায়গা যেখানে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হবে অথচ সেখানে যেতে হলে কোনো সহজ উপায় নেই। চিন্তিত হয়ে পড়লাম। পশ্চিম আকাশে সূর্যও লাল হতে শুরু করেছে। আমি কিছুটা হতাশ হলাম।
আমাদের অস্থিরতা দেখে একটি নৌকার মাঝি জানালেন, ওপারে কিছু সাংবাদিক কাল অথবা আজ রাতে দুবলার চর রওনা হবে। আপনারা দেখেন তাদের সঙ্গে যেতে পারেন কিনা। নৌকার মাঝি অল্পবয়সী। আমার মতো বয়স হবে।
আমাদের হাতে ক্যামেরা দেখে সে মনে করেছে সাংবাদিক। মাকসুম ভাই শখের ফটোগ্রাফার। তবে আমি ঢাকাতে পত্রিকার সাথেই যুক্ত। আমি মাকসুম ভাইকে বললাম, এখন আপনিও সাংবাদিক হয়ে যান। আমি যা বলি তাই করবেন।
তিনি হাসলেন।
বললেন, চলো তাইলে ওপাড়ে যাই। নদী পাড়ি দিয়ে আসলাম নতুন জায়গায়। সেই মাঝি নিজে আমাদের সেই সাংবাদকদের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে শুনলাম এটিএন এর মংলা প্রতিনিধি যাবেন সেই বহরে। স্থানিয় আরো বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মিলে একটি ট্রলারে করে দুবলার চরে যাবেন তারা। তবে তাদের কারো দেখা পেলাম না। একজন আমাকে এটিএন এর সেই সাংবাদি ভাই এর ফোন নম্বর দিলো। নম্বর নিয়ে সেই সময়ের এটিএন বাংলার মংলা প্রতিনিধিকে ফোন দিলাম। প্রথমে কুশল বিনিময় তারপর পরিচয়।
বললাম, ভাই আমি ঢাকা থেকে এসেছি। আপনার সাথে একটু কথা আছে। আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে।
তিনি জানালেন, একটি জরুরী কাজে থানায় গিয়েছেন। ঘন্টাখানেক পরে আসবেন।
আমাকে তাদের অফিসে বসতে বললেন।
আমরা দুই ভাই তাদের অফিসে বসে রইলাম।
অফিসে তখন কয়েকজন বসা ছিলেন। তারা আমাদের জিজ্ঞাস করলেন, কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় যাবেন?
আমি বললাম, ঢাকা থেকে এসেছি। যাব দুবলার চরে।
অনেক কথা হলো তাদের সঙ্গে। আমি ঢাকার পত্রিকার সাংবাদিক শুনে তারা ভালোই ব্যবহার করলেন।
একজন জানালেন, আমাদের সঙ্গে গেলেতো ভালোই হবে। আমরা অনেকেই যাব।
অপেক্ষা আর শেষ হয় না। দুই ঘন্টা হয়ে এসেছে কারো দেখা নাই।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।
আমি মাকসুম ভাইকে বললাম, ভাই সন্ধ্যা তো হয়ে এসেছে চলেন একটু ঘুরে দেখি। মংলাতো এর আগে আসা হয়নি।
ভাই রাজি হয়ে গেলেন। তার আগে ওই সেই ভাই কে একটা ফোন করলাম যে তিনি কখন আসবেন।
তিনি জানালেন, আরো ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।
আমি তাকে বললাম, ভাই তাহলে আমরা একটু ঘুরে দেখি। আপনি যদি আগে চলে আসেন তবে আমার এই নম্বরে একটা ফোন দিয়েন।
মাকসুম ভাই আমাকে বললেন, চিন্তা করো না, যদি কোনো কাজ না হয় তবে রাতে এখানে কোনো একটি হোটেলে থাকব। ভোরে এখান থেকে অনেক টুরিস্ট দুবলার চর যায়। তাদের একটিতে উঠে যাব।
আমিও বললাম ঠিক আছে।
দুই ভাই ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে নদীর পাড়ে বাঁধের উপর হাটতে লাগলাম। অনেক সুন্দর জায়গাটা। সন্ধ্যার গোলাপী আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্যামেরা দিয়ে সেই রূপ আটকে রাখলাম। সন্ধ্যায় নদীর বুকে সূর্য ঢুবে যাওয়া কি যে অপরুপ, তা চোখে না দেখলে বর্ণনা করা যাবে না।
দুজনে অল্প-স্বল্প নিজেদের ফটেশেসনটাও সেরে নিলাম।
(চলবে ...)
এসএ/