ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

থমকে দাঁড়াচ্ছে পুনর্বাসন কর্মসূচি

‘সহজ’ আয়ের পথ ছাড়তে রাজি নয় ভিক্ষুকরা

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৪:৪৪ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১১:৪৪ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার

ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচির এক অনুষ্ঠানে সরকারি অনুদান গ্রহণ করছেন এক ভিক্ষুক। ফাইল ছবি

ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচির এক অনুষ্ঠানে সরকারি অনুদান গ্রহণ করছেন এক ভিক্ষুক। ফাইল ছবি

‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ বর্তমান সরকারের অনেকগুলো উন্নয়নমুখী পদক্ষেপের মধ্যে একটি। কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাব ও ভিক্ষুকদের কাজ করতে না চাওয়ার মনোভাবে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না সরকারের নেওয়া প্রশংসনীয় এ পদক্ষেপে। ভিক্ষুকরা আবারও ফিরে যাচ্ছেন পুরনো পেশায়।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১০ সালের আগষ্টে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারের সময়োপযোগী এ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ঢাকাসহ সারাদেশে কাজ করছে প্রত্যেক এলাকার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। আর তাদেরকে সহযোগিতা করছে সমাজসেবা অধিদফতর, ইসলামী ফাউন্ডেশন এবং সিটি কর্পোরেশনগুলো।

ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম. বজলুল করিম চৌধুরী একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে জানান, ভিক্ষাবৃত্তি আইনগতভাবে একটি অপরাধ এবং নৈতিকভাবেও এটি সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু অনেকে শারীরিক কারণে বা সহায় সম্বল হারিয়ে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়। একইসঙ্গে কেউ কেউ অভ্যাসগত কারণে ভিক্ষা করে। যথেষ্ঠ শক্তি ও সামর্থ্য থাকার পরও ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত এমন ভিক্ষুকের সংখ্যাও ঢাকায় কম নয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু ও কুসংষ্কারাচ্ছন্ন। মানুষের আবেগকে পুঁজি করে একটি অপরাধী চক্র ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়ে তাদের অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আইন যেমন ভিক্ষাবৃত্তি সমর্থন করেনা তেমনি পবিত্র ইসলাম ধর্মও ভিক্ষাবৃত্তি সমর্থন করেনা।

ভিক্ষুকদের ব্যবহার করা ওই অপরাধীচক্রকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কেনো-এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বলেন, মানুষ সচেতন হলে অপরাধীরা পার পাবে না। এজন্যই আমরা আগে মানুষকে সচেতন করতে চাচ্ছি। এরপরও কেউ যদি এসব চক্রের ব্যাপারে আমাদের অভিযোগ করে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনী ব্যবস্থা নেব।

সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড

সমাজ থেকে ‍ভিক্ষাবৃত্তি তুলে দেওয়ার জন্য সামাজিক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এজন্য বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।

গত ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ তারিখে রমনা থানা এলাকার ৫৭ টি মসজিদে লিফলেট বিতরণ এবং খুতবায় ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে বয়ান করা হয়।

এছাড়া ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধের লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৩০টি জোনের সব মসজিদকে কেন্দ্র করে সচেতনতা কার্যক্রম চালু আছে বলে জানা গেছে।

গত বছরের ১৮ এপ্রিল ঢাকার মসজিদগুলোতে সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) তত্বাবধানে ১২ হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়।

এপ্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম. বজলুল করিম চৌধুরী বলেন, সাধারন মানুষের আবেগকে পুঁজি করে যেনো কেউ ভিক্ষাবৃত্তির মতো অবৈধ কাজে না নামতে পারে, সেজন্য আমরা মসজিদে লিফলেট বিতরণ করে সাধারণ মানুষদের সচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছি।

এছাড়া ২০১৬ সালের ৪ জুন ২০০ জন ভিক্ষুকের অর্শগ্রহণে `পুনর্বাসন চাহিদা নিরূপণ` শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করেছিল সমাজসেবা অধিদপ্তর।

আইনী ব্যবস্থা

গত বছরের ৮ জুন তারিখে `ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যাক্তি পুনর্বাসন আইন ২০১১` এর আওতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এছাড়া ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা, হোটেল সোনারগাঁও, হোটেল রূপসী বাংলা, দূতাবাস এলাকাসমূহ, কূটনৈতিক জোন, বেইলী রোড, হোটেল রেডিসন এলাকাগুলোকে ইতোমধ্যে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকার পরিমাণ আরো বাড়ানো হবে বলে দাবি করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম. বজলুল করিম চৌধুরী।

ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় ভিক্ষা না করার জন্যও কয়েকদিন পর পর অধিদপ্তরের উদ্যোগে মাইকিং করা হয়।

আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ

ঢাকা মহানগরে সমাজসেবা অধিদফতরের উদ্যোগে ২০১১ সালে ১০টি জোনে ১০টি এনজিও-র মাধ্যমে ১০ হাজার ভিক্ষুকের উপর জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। এদের মধ্য থেকে ২ হাজার ভিক্ষুককে নিজ নিজ জেলায় পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ ও জামালপুরে ৬৬ জন ভিক্ষুককে রিকসা, ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য পুঁজি দেওয়া হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ময়মনসিংহের বেশিরভাগ ভিক্ষুকই তাদের রিকসা, ভ্যান বিক্রি করে আবার ফিরে এসেছে ভিক্ষাবৃত্তির পেশায়।

তবে জামালপুরের ভিক্ষুকরা নতুন পেশায় গিয়ে অনেকখানি সফল বলে জানান কর্মকর্তারা। ২০১৭ সালে ১১৪ জন ভিক্ষুককে আশ্রয়কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। এদের মধ্যে ৭৬ জনকে পারিবারিক এবং ৩৮ জনকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।

বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ খাতে ২০১৫-১৬ সালে ৩৯ লক্ষ টাকা এবং ২০১৬-১৭ সালে ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অবশিষ্ট টাকায় ৭১৭ জনকে জেলা পর্যায়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

কার্যক্রমের ফলাফল

একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই উদ্যোগটি হাতে নিলেও, সুনির্দিষ্ট তদারকির অভাবে প্রত্যাশিত ফল মিলছে না। অনেক ভিক্ষুক আবার আগের পেশায় ফিরে আসছে।

বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা দাবি করেন, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও অধিকাংশ ভিক্ষুকই এ পেশা ছাড়তে রাজী নয়। অনেকেই অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ পেশায় আবার ফিরে আসছেন। তাছাড়া ভিক্ষুকদেরকে নানাভাবে ব্যবহার করে যারা পরোক্ষভাবে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা না গেলে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলেও জানান তিনি।

/ এআর /