পর্ব-১
দেড় কোটি মানুষের শহরে ২ লাখ ৩৩ হাজার কবর
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ১১:৪৩ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৮:০৩ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার
দিনে দিনে বাড়ছে রাজধানীর জনসংখ্যা। প্রতিদিনিই কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হচ্ছেন মানুষ। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ানো হয়নি নগরবাসীর জন্য শেষ শায়িত স্থানের সংখ্যা। এর ফলে রাজধানীবাসীর মরদেহ সৎকার সুবিধা নিশ্চিতের জন্য বিভিন্ন সময় মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে কবরের সংকট রয়েই গেছে।
কাগজে কলমে ঢাকা জেলার জনসংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন। তবে বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি। আর রাজধানী ঢাকায় প্রায় দেড় কোটি মানুষের শহরে রয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৭৮ জনের মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বর্তমানে ৮টি কবরস্থান রয়েছে। এছাড়া খ্রিস্টানদের মরদেহ সৎকারের জন্য রাখা হয়েছে তিনটি কবরস্থান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিগত আবাসিক ভূমি উন্নয়ন আইনে রাজধানীর প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য ০.০৪ একর জমি রাখার কথা বলা হয়েছে ধর্মীয় উপাসনায়, মরদেহ সৎকার ও কমিউনিটির অন্যান্য সামাজিক সুবিধার জন্য।
যেকোনো নতুন আবাসিক এলাকা তৈরির ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করেই এর পরিকল্পনা পাস করানোর নিয়ম। এটা করা হয়েছে ২০০৪ সালে। ১৯৫৯ সালে ঢাকায় কবরস্থানের জন্য একটা মাস্টারপ্ল্যানও হয়েছিলো।
এরপর ১৯৯৫ এবং ২০১৫ সালে আবারও প্ল্যান করা হয়। কিন্তু বারবার উদ্যোগ নিলেও আলোর মুখ দেখেনি মাস্টারপ্ল্যানগুলো।
রাজধানীর কবরসমূহ
আজিমপুর: রাজধানী সব থেকে পুরানো কবরস্থান আজিমপুর । প্রায় ৭০ বছর আগে ২৭ একর জমির উপরে প্রতিষ্ঠা করা হয় আজিমপুর গোরস্তানের। এখানে স্থায়ী কবর ৬ হাজার ৫০০, অস্থায়ী কবর ৩০ হাজার মিলিয়ে মোট ৩৬ হাজার ৫০০ লোকের কবর দেওয়া ব্যবস্থা রয়েছে।
জুরাইন কবরস্থান : এর মোট আয়তন ১৭.২৬ একর যার মধ্যে সাধারণ কবরস্থান ১২ একর আর সংরক্ষিত রয়েছে ৫.২৬ একর জায়গা। এখানে স্থায়ী কবর ২ হাজার ৬৯৪ ও অস্থায়ী কবর ৪১ হাজার। মোট ৪৩ হাজার ৬৯৪ মানুষের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে জুরাইন কবরস্থানে।
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান: ৬৫ একর জায়গায় স্থায়ী কবরের সংখ্যা ৩০ হাজার। পাশাপাশি অস্থায়ী কবরের সংখ্যা ৬১ হাজার। মোট ৯১ হাজার লোক কবরের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে।
বনানী কবরস্থান: ১০ একর জায়গায় স্থায়ী কবরের সংখ্যা ৭ হাজার ৫১৪ ও অস্থায়ী কবরের সংখ্যা ৪ হাজার ৫০০। মোট ১২ হাজার ৪টি কবর রয়েছে ওখানে।
উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর: ১.১০ একরে স্থায়ী কবর ৮৪ ও অস্থায়ী কবর ৫৮০ মিলিয়ে মোট ৬৬৪ লোকের কবর দেওয়া ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর: ৬ একর জমিতে ২ হাজার ৫০০ লোকের কবর দেওয়ার ধারণ ক্ষমতা আছে।
খিলগাঁও কবরস্থান : খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় ৫ দশমিক ৩৭ একর জমিতে নির্মিত এই কবরস্থানে অন্তত দুই হাজার ৭০০ লাশের দাফন করার ব্যবস্থা রয়েছে।
রায়েরবাজার কবরস্থান: রাজধানীর রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পেছনে দেশের সবচেয়ে বড় কবরস্থান নির্মাণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। রায়েরবাজার কবরস্থানে মোট জমির পরিমাণ ৯৬ দশমিক ২৩ একর। মূল কবরস্থান ৮১ দশমিক ৩০ একর। একসঙ্গে সাড়ে ৮৫ হাজার মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
এছাড়া তেজগাঁও হোলি রোজারি চার্চের পাশে, মোহাম্মদপুর এবং ওয়ারী এর মধ্যে তেজগাঁও তিনটি স্থানে খ্রীষ্টান ধর্মীয় লোকেদের জন্য ২ হাজার ৫০০ লোকের মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানের ‘মোহরার’ (তত্ত্বাবধায়ক) মো. নুরুল হুদা একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুয়ায়ী একটি কবর ২ বছর রাখা হয়। জায়গা সংকটের কারণে পুরানো কবর ভেঙ্গে নতুন করে কবর দেওয়া হয়। আগে স্থায়ীভাবে বরাদ্দের ব্যবস্থা থাকলেও এটা বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্মে কবরের উপরে কবর দেয়ার অনুমতি আছে।
ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে দেখা গেছে, অসংখ্য কবর কোনটি কার খবর তা চেনার লেশমাত্র নেই। একটি আরেকটির গায়ে লেগে আছে। কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। অসংখ্য কবরের উপরে দেখা একাধিক লোকের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে।
অর্থাৎ একের অধিক মানুষের জায়গা হয়েছে একেকটি কবরে। কখনো কখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবার থেকে, ভিন্ন এলাকা থেকে তারা এসেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সমাজকল্যাণ বিভাগের কর্মকর্তা লৎফুর রহমান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, দক্ষিণ সিটির প্রতিটি ওয়ার্ডে নতুন করে কবরস্থান করার মতো জায়গা আছে কি-না তা অনুসন্ধানে কাজ চলছে।
রাজধানীর কবরস্থানে চাপ কমাতে ঢাকার বাইরে নিজস্ব এলাকায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া এবং দাফনে কিছু আর্থিক সহায়তা করার পরিকল্পনা নিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
নগরবিদরা বলছেন, ঢাকার জনসংখ্যা এখন দেড় কোটির উপরে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলাম নাজেম বলেন, আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। কবর, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টারসহ সামাজিক যেসব সুবিধার দরকার তাতে পরিকল্পনার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এখনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে কঠিন পরিস্থিত তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
টিআর/ এমজে/