ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

ভালোবাসা এমন যদি হতো…

শামসুল হক

প্রকাশিত : ০১:০৭ পিএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার

আজ থেকে ২০ বছর আগে বিশ্ব ভালোবাসার ধারণাটা বাংলাদেশের কতজনের মধ্যে ছিল তা বলা কঠিন হবে। এর নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও নেই। বাংলাদেশে কিভাবে  এ দিবসটি এলো এরও নির্ভেজাল ইতিহাস পাওয়া নেই সম্ভবত। আর এ নিয়ে বড় ধরেনের গবেষণা হয়েছে কি না তাও জানা নেই।

তবে আজকের দিনে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস যেভাবে ঘটা করে উদযাপন করা হচ্ছে আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগে এমনটা নিশ্চয়ই ছিল না। আর ২০ বছর পরও এমনটা থাকবে  বলে মনে হয় না। তখন  সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসাতেও আসবে আধুনিকতা-ডিজিটাইজেশনের ছোঁয়া হয়তো।

প্রতিবছর ঘটা করে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়। যদিও দিবসটি আমাদের নয়, পশ্চিমাদের। তবুও কালের পরিক্রমায় এটি এখন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে।

এই দিবসকে ঘিরে জমে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যও। বিশেষ করে এই বিশেষ দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করেন তরুণ-তরুণীসহ ব্যবসায়ীরা। এ দিনকে ঘিরেই বড় লেনদেন হয়।

এখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে যেভাবে এ দিনকে উদযাপন করা হয়, সেই একই রকম কি গ্রামে দেখা যায়? অবশ্যই এমনটা নয়। বাংলাদেশের এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে পৌঁছায়নি এখনও বিদ্যুতের আলো। মানুষ খেতেও পারেন না তিন বেলা পেট ভরে। বিশেষ করে দূর্গম চরাঞ্চলে। তাদের কাছে এ দিবসের মর্যাদা কেমন বা তাদের অনুভূতি কেমন এ নিয়ে নেই কারো মাথা ব্যথা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতেই। ভালোবাসার রঙ লক্ষণীয় ক্যাম্পাস জীবনে। এখনও ক্যাম্পাসগুলোতে এই দিনে লাল-হলুদের রঙে হারিয়ে যায় অনেকেই।

আজ সারাটা দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এ রঙের ছড়াছড়ি চোখে পড়বে। এটা প্রতিবছর পড়েই থাকে। কিন্তু বস্তির ওই শিশু বা বৃদ্ধ দিনটিকে কিভাবে দেখছে? তাদের কাছে এই দিনের বিশেষত্ব কী। এটা কি আমরা ভাবি? ভাবার সময় হয়তো নেই।

এই তো  কয়েকদিন আগে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে অফিসের দিকে হাঁটছিলাম। তাড়া ছিল অফিস যাওয়ার। কিন্তু পথেই এক মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের অনিন্দ ভালোবাসা দেখে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। সড়কের ধারে দুজন মিশে ছিলেন এক স্বর্গীয় ভালোবাসায়। প্রচণ্ড শীতে ময়লা-ছেড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে মা আগলে রেখেছেন বুকের ধনটিকে। আর শিশুটি পরম তৃপ্তি নিয়ে হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখপানে। মাও বাকা হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার ফিরতি ভালোবাসা। ব্যস্ত সময়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও থামিয়ে দিয়েছিল তাদের ভালোবাসার চাহনি আমার ব্যস্ত সময়কে।

আজ যখন ভালোবাসা দিবস নিয়ে এতো মাতামাতি তখন চোখের সামনে ভেসে আসে পথের ধারে সেই মা-মেয়ের ভালোবাসা। তাদের চাহনি। আজকের ভালোবাসা দিবসে ধনী পরিবারগুলোর সন্তানদের ভালোবাসার প্রকাশ আর সেই দিনের দেখা ভালোবাসার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য নেই?  

ওই মা ও শিশুর নেই অর্থ, নেই বাড়ি-গাড়ি রয়েছে একবুক ভালোবাসা। এটাই বা কম কিসের? অনেকের কোটি কোটি টাকা, আলিশান বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। কিন্তু নেই শান্তি তৃপ্তি। একটুও ভালোবাসা নেই। তারা কি পরাজিত নয় ওই পথ মা-শিশুর ভালোবাসার কাছে?

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা চাঙা হয়ে উঠেন। বিশেষ করে গিফট আইটেমের দোকানগুলোতে চলে জমজমাট কেনাকেটা। এর কারণও আছে। আজকের ভালোবাসার বড় শর্ত মনে হয় ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ অর্থাৎ বিনিময়ে ভালোবাসা। প্রেমিক এই দিনে প্রেমিকাকে কোনো গিফট না দিলে মনে হয় ভালোবাসার দিনটাই যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই দিনে অনেক বন্ধুকে মন খারাপ করে রুমে বসে থাকতে দেখিছি। আবার অনেককে উৎফুল্লে সারাদিন কাটাতেও দেখেছি। তাই বলা যায়, ভালোবাসার রঙ অনেক। বহুরুপী। ঘটা করে একটি দিনে ভালোবাসা নিয়ে যা করা হয় তা বাড়াবাড়ি বললেও দোষ হবে না। বাকি দিনগুলোর কি অবস্থা? প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ভালোবাসার যেমন আবেগ রয়েছে। তেমনি থাকা দরকার বাবা-মায়ের প্রতি। কিন্তু তেমনটা কি লক্ষ্য করা যায়?

ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি শুধু না বলে, মানবজাতির মঙ্গলের জন্য জেগে উঠুক ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় থাকবে না স্বার্থ, থাকবে না ছলচাতুরি। এই বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সবাই যদি এমনটা ভাবতো যে, ভালোবাসা দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভালোবাসা সর্বজনীন। তবে মানবতা জেগে উঠতো না? পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠতো না?

ভালোবাসা হোক সবার জন্য। গরিব-ধনী, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে জেগে উঠুক মানবতা- এমনটা প্রত্যাশা করাটা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না।

লেখক: সাংবাদিক।