দিন দিন বাড়ছে মোটর সাইকেল বিক্রি
শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত : ০৬:৪৮ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১১:০০ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রবিবার
প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। পুরো দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটিরও বেশি। আর বিশাল এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দুই চাকার বাহন মোটর সাইকেল। বিশেষ করে ছাত্র এবং তরুণ সমাজের মধ্যে এই বাহটির কদর সবচেয়ে বেশি। আর এর ফলে বাড়ছে মোটর সাইকেল বিক্রির পরিমাণও।
বাজার পরিসংখ্যাণ
বিগত বছরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সব থেকে বেশি মোটর সাইকেল বিক্রি হয় ২০১৭ সালে। বাংলাদেশের বাজারে থাকা দেশি বিদেশী প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান গত বছরে প্রায় পৌনে চার লাখ মোটর সাইকেল বিক্রি করে। ২০১৬ সালের থেকে যা প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। মোটর সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এত পরিমাণ মোটর সাইকেল বিক্রি আগের আর কোনো বছরে হয় নি। চলতি বছরে ছাড়িয়ে যেতে পারে এই রেকর্ডও। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলতি বছরে দেশের মোটর সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
মোটর সাইকেল ইন্ডাস্ট্রির তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। ইঞ্জিন সক্ষমতার বিবেচনায় সব থেকে বেশি বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি সম্পন্ন মোটর সাইকেল। এরপরেই আছে ১৫০ সিসির মোটর বাইকগুলো। তবে মোট বিক্রি হওয়া মোটর সাইকেলের মধ্যে অর্ধেকই হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ সিসির মোটর সাইকেল। এগুলোর বাজার দর ১২৫ বা ১৫০ সিসির বাইকের থেকে কম হওয়ায় গ্রাহকদের কাছে এর চাহিদা বেশি।
দেশে মোটর সাইকেলের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত ভারত থেকে আনা বাইকগুলো। বাজাজ, টিভিএস, ইয়ামাহা, হিরো, হোন্ডা, সুজুকি এবং মাহিন্দ্রা ভারতীয় বাইকগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর মধ্যে ইয়ামাহা, হোন্ডা ও সুজুকির মূল সত্ত্বাধিকারী জাপানের। এর বাইরে আছে কিছু চীনা প্রতিষ্ঠানও। ডায়াং, জংশেন, হিরো পাওয়ার এদের মধ্যে অন্যতম। দেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে যমুনা এবং রানার। তবে ওয়ালটন দেশের প্রথম মোটর সাইকেল প্রস্তুত করলেও এখন তারা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। দেশীয় এ প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে মোটর সাইকেলের যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন করছেন। সম্প্রতি রানার অটোমোবাইলস নিজেরাই মোটর সাইকেলের কিছু যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি করছে। দেশের বাজারের মাত্র ১০ শতাংশ দখল করে আছে দেশীয় এসব প্রতিষ্ঠান। আর বাকি ৯০ শতাংশই বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে।
বিক্রি বৃদ্ধির কারণ
আগে দেশের বাইরে থেকে সম্পূর্ণ ফিটিং করা মোটর সাইকেল আমদানি করা হতো। আর এতে আমদানি শুল্ক গুনতে হতো প্রায় ১৮১ শতাংশ। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে ইঞ্জিন এবং যন্ত্রপাতি আমদানি করে দেশেই সেগুলো সংযোজন শুরু করে। যার ফলে সেসব মোটর সাইকেলে আমদানি শুল্ক দিতে হচ্ছে ৮৯ শতাংশ। এ পদ্ধতিতে মূলত মোটর সাইকেল বাজারজাত করছে চীন এবং কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো। যেমন জংশেন, কিওয়ে ইত্যাদি। আর যমুনা বা রানারের মত প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক সময়ে মোটর সাইকেলের প্রায় সকল যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি করছে। পাশাপাশি সংযোজনও করছে। এ ধরনের মোটর সাইকেলে সরকারের আরোপিত করের পরিমাণ মাত্র ৩৮ শতাংশ।
মূলত এসব কারণেই মোটর সাইকেলের দাম আগের বছরগুলোর থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। আর চলে আসে মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষার্থীসহ তরুণ সমাজের সাধ্যের মধ্যে।
ইএমআই এবং মাসিক কিস্তি
সাম্প্রতিক সময়ে মোটর সাইকেল বিক্রি বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল এখন বিনাসুদে অথবা স্বল্প সুদে মাসিক কিস্তিতে মোটর সাইকেল কেনার সুযোগ করে দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এমনকি কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সমান মাসিক কিস্তি (ইএমআই) সুবিধায় কেনা যাচ্ছে বাইক। আর সে কারণে তরুণরা খুব সহজেই মোটর সাইকেল কিনতে পারছেন।
ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ইএমআই (ইকুয়াল মানথলি ইন্সটলমেন্ট) গ্রাহকদের মোটর সাইকেল কেনার সুযোগ দিচ্ছে ই-কমার্স শপ দারাজ এবং পিকাবু। সর্বোচ্চ ছয় মাসের কিস্তিতে বিনা সুদে মোটর সাইকেল কেনা যায় এখান থেকে। এছাড়াও সহজ শর্ত এবং সীমিত সুদে ১২ মাস থেকে সর্বোচ্চ ২৪ মাসের কিস্তিতেও মোটর বাইক কেনার সুযোগ আছে এখানে। এ বিষয়ে পিকাবুর সহকারী বিপণন ব্যবস্থাপক নাইম হোসেন বলেন, “গ্রাহকদের আসল ব্র্যান্ড পণ্য দেওয়াই পিকাবু’র মূল উদ্দেশ্য। তারই অংশ হিসেবে আমরা হিরো মোটর সাইকেল নিয়ে এই ইএমআই সুবিধা চালু করি। শুরুতে আমরা ধারণা করেছিলাম যে, প্রথম মাসে হয়তো ১০টি মোটর সাইকেল বিক্রি হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম যে, ইএমআই সুবিধা চালুর প্রথম মাসেই ৫০টিরও বেশি মোটর সাইকেল বিক্রি হয়। ইএমআই সুবিধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অথবা সদ্য ক্যারিয়ার শুরু করেছেন এমন ব্যক্তিরাও মোটর সাইকেল কিনতে পারছেন”।
“এছাড়াও রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলোর কারণেও মোটর সাইকেলগুলো বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গেছে অনেকখানি”।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপস ও ই-কমার্স
মোটর সাইকেল নিজেই এখন হয়ে উঠছে আয়ের এক বড় মাধ্যম। ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা ই-কমার্স এবং এফ-কমার্সে (ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মোটর সাইকেল। ই-শপ থেকে পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে মোটর সাইকেল। অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই মোটর সাইকেল কিনে কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহের কাজটি করে থাকে। আবার অনেকে মোটর সাইকেল কিনে এসব প্রতিষ্ঠানের হয়ে চুক্তি ভিত্তিতে পণ্য সরবারের কাজ করেন।
এছাড়াও রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের ধারণার বদৌলতে, দিন দিন মোটর সাইকেল বিক্রির পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। পাঠাও, মুভ, স্যাম, উবার-মটো, ইজিয়ার, ওভাই এর মত রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলোতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে নিবন্ধিত বাইক চালকের সংখ্যা। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ কিস্তিতে মোটর সাইকেল ক্রয় করে রাইড শেয়ারের মাধ্যমে আয় করেই পরিশোধ করছেন মাসিক কিস্তির টাকা।
এছাড়াও পড়াশুনা অথবা চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজ হিসেবেও রাইড শেয়ারিং করছেন অনেকেই। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাহিদুল ইসলাম বলেন, “পড়াশুনার পাশাপাশি আগে টিউশনি করতাম। অনেক ধরণের সমস্যা ছিল সেখানে। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে কিস্তিতে একটি বাইক কিনি। এখন পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে রাইড শেয়ার করি। এতে কিস্তি পরিশোধের পরও হাতে যা থাকে তা টিউশনির আয় থেকে বেশি”।
দেশেই তৈরি হবে সম্পূর্ণ মোটর সাইকেল
বর্তমানে দেশেই মোটর সাইকেল তৈরি করছে দেশীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরে এর সাথে যুক্ত হবে আরও বেশকিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠান। দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে ইতোমধ্যে কারখানা তৈরির কাজ এগিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড।
ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ বাইক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রানার এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মজিবুর রহমান ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “দেশের বাজারে যেসব মোটর সাইকেল তৈরি হচ্ছে তার বেশিরভাগই প্রস্তুত করছে রানার। দেশের মোট মোটর বাইকের ৭ শতাংশের জোগান দিচ্ছি আমরা। এমনকি দেশের বাইরে নেপালেও আমরা আমাদের বাইক রপ্তানি করছি”। ময়মনসিংহের ভালুকায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব বাইক উৎপাদন কারখানা।
ভারতীয় বাজাজ বাইকের উৎপাদনের জন্য ঢাকার সাভারের জিরানীতে কারখানা নির্মাণ করছে বাংলাদেশে বাজারের পরিবেশক উত্তরা মোটরস। আগামী মার্চ মাস থেকে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন কারখানা চালু করেছে আরেক ভারতীয় ব্যান্ড হিরো মটরস। যশোরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন কারখানা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মাহবুব আলম ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “গত বছর থেকেই বাংলাদেশে মোটর সাইকেল উৎপাদন করে আসছে হিরো মটরস। নিলয় মটরস এর পরিবেশক। বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব নতুন হিরো বাইক দেখা যাচ্ছে সব আমাদের দেশেই তৈরি” ।
আর এ বছরের মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে টিভিএস এবং হোন্ডা মোটর সাইকেলের। ময়মনসিংহের ভালুকায় কারখানা নির্মাণ করবে টিভিএস। এছাড়াও টঙ্গীতে যন্ত্রাংশ সংযোজনের একটি কারখানা আগে থেকেই আছে তাদের। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব সেলস মো. আতিকুর রহমান বলেন, “নিত্য প্রয়োজনীয় বাহন হিসেবে মোটর সাইকেল এখনো সকলের পছন্দের বিষয়। আর সরকারের এক নীতি অনুযায়ী, আমরাও দেশেই মোটর সাইকেল উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছি। এবছরই আমাদের উৎপাদন শুরু হবে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের তুলনায় চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে টিভিএস এর বিজনেস গ্রোথ বেড়েছে শতকরা ৫০ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে তা ১০০ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে বলে আশা করা যাচ্ছে”।
অন্যদিকে মুন্সিগঞ্জের আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ২৫ একর জমির ওপর কারখানা নির্মাণ করছে জাপানি মোটর সাইকেল প্রতিষ্ঠান হোণ্ডা।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরটি হতে যাচ্ছে মোটর সাইকেল খাতের জন্য এক স্বর্ণযুগ।
টিকে