কে হচ্ছে ডিএসই’র কৌশলগত অংশীদার?
প্রকাশিত : ০৮:৪৬ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৮:৪৮ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার
শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কে হচ্ছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত অংশীদার। এদিকে চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের কনসোর্টিয়াম এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ, ফ্রন্ট্রিয়ার ফান্ড বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাকের কনসোর্টিয়ামের অংশীদারি পেতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
তবে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের সভায় চীনের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামকেই অংশীদার হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এদিকে সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারী ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ অব ইন্ডিয়ার (এনএসই) কনসোর্টিয়াম কৌশলগত অংশীদারি পেত রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ভারতের কনসোর্টিয়ামের কাছে শেয়ার বিক্রির ব্যাপারেই আগ্রহী। তবে চীনের কনসোর্টিয়াম দর বেশি দেওয়ায় ডিএসই চাইছে চীনকে দিতে। এ অবস্থায় উভয় কনসোর্টিয়ামকেই ডিএসইর অংশীদার করার ব্যাপারে ভাবছে বিএসইসি। তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের পুঁজিবাজার ও স্টকহোল্ডারদের স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
সূত্র জানিয়েছে, নানামুখী চাপ সত্ত্বেও কৌশলগত মালিকানা ইস্যুতে সর্বোচ্চ দর হাঁকানোয় সাংহাই- শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জের কনসোর্টিয়ামকেই চূড়ান্ত করার করার পক্ষে ডিএসই। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সর্বনিম্ন দরপ্রস্তাবকারী ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ অব ইন্ডিয়ার (এনএসই) কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত মালিকানা দিতে চান না তারা। সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নিয়মানুসারে সর্বোচ্চ দর হাঁকানো প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়ামকেই কৌশলগত বিনিয়োগকারী করতে ঐক্যবদ্ধ ডিএসইর সদস্যরা। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসই’র পর্ষদ সভার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) নিজেদের সিদ্ধান্ত জানাবে ডিএসই। ৩১ মার্চের মধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগ চূড়ান্ত করতে হবে স্টক এক্সচেঞ্জটিকে।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, ভালো কৌশলগত অংশীদার পেলে ডিএসইর রূপ পাল্টে যাবে। তিনি বলেন, আইনে বলা আছে স্টক এক্সচেঞ্জ তার কৌশলগত অংশীদার খুঁজবে। বিএসইসি কিন্তু খুঁজবে না। তাই ডিএসই তার কৌশলগত অংশীদার খুঁজে বের করেছে। আমাদের রেগুলেটরি ‘এ’ ক্যাটাগরির উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৌশলগত অংশীদার নিয়ে যা হচ্ছে তাতে বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনএসই সরাসরি শেয়ার কেনার বদলে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এনএসই স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের নামে বিনিয়োগে করতে চায়। তাহলে আমাদের একটা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হবে। এছাড়া কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে আসার পাঁচ বছরের মধ্যে আইপিওর মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার বিক্রির তাদের যে প্রস্তাব তা আইন পরিপন্থী। তাই সবকিছু বিচার করে ডিএসইকে একটি বিশ্বমানের এক্সচেঞ্জ হতে যে অংশীদার সাহায্য করবে তার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আমাদের অর্থনীতির তুলনায় পুঁজিবাজার পিছিয়ে আছে। এক্ষেত্রে ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার পুঁজিবাজারের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট হবে। তবে ‘বেস্ট’ কনসোর্টিয়ামকে আমাদের বেছে নিতে হবে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এটা করতে হবে। এখানে আপোস করা উচিত হবে না। পুঁজিবাজারের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কৌশলগত অংশীদার বিজনেস তৈরী করবে। টার্নওভার না বাড়াতে পারলে তাদের পোষাবে না। মূল কথা, তাদের অংশগ্রহণে লেনদেনের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
জানা গেছে, চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের কনসোর্টিয়াম প্রতিটি ২২ টাকা দরে ৯৯০ কোটি টাকায় ডিএসইর ৪৫ কোটি বা ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তাদের একজন প্রতিনিধি ডিএসইর পর্ষদে বসবে। এছাড়া ডিএসইর কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ৩০০ কোটিরও বেশি টাকা (৩৭ মিলিয়ন ডলার) খরচ করতে চায় তারা। কনসোর্টিয়ামটি ডিএসইর ট্রেডিং ও সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের আধুনিকায়ন, বিজনেস প্রসেস ম্যানেজমেন্ট (বিপিএম) সিস্টেম কনসাল্টিং প্ল্যান, বন্ড টেন্ডার সিস্টেমের জন্য কনসাল্টিং সার্ভিস, ইনফরমেশন ডিসক্লোজার সিস্টেম কনসাল্টিং প্ল্যান, ডাটা সেন্টার ও কো-লোকেশনের জন্য কনসাল্টিং সার্ভিস প্ল্যান, এফডিইপি প্রযুক্তি স্থানাস্তর পরিকল্পনা, ফিন্যান্সিয়াল ক্লাউড টেকনোলজি স্থানান্তর পরিকল্পনা করার কথা বলেছে। এসব কারিগরি প্রযুক্তির জন্য ১০ বছরের লাইসেন্স এবং তিন বছরের ট্রেনিং ও কনসাল্টিং সার্ভিস সম্পূর্ণ ফ্রি দেবে তারা। এর বাইরে বেশ কিছু পণ্য ও বাজার উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেবে তারা।
অন্যদিকে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ অব ইন্ডিয়ার (এনএসই) কনসোর্টিয়াম ডিএসইর ২৫ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার প্রতিটি ১৫ টাকা দরে কিনতে প্রস্তাব দেয়। তারা ডিএসইর পর্ষদে দুজন পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে যা ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনের পরিপন্থী। এনএসই সরাসরি শেয়ার কেনার বদলে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এনএসই স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের নামে বিনিয়োগ করতে চায়। এই কনসোর্টিয়ামে ইকুইটি পার্টনার হিসেবে থাকা ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স পরিচালিত প্রাইভেট ইকুইটি ফান্ড ফ্রন্টিয়ার ফান্ড বাংলাদেশ এলএলপির বিনিয়োগের বিষয়টি অনিশ্চিত।
এদিকে এনএসই কনসোর্টিয়াম তাদের কারিগরি সহায়তাসংক্রান্ত প্রস্তাবে বলেছে, ফিউচার ও অপশনস, এসএমই, ইটিএফ, বন্ড কারেন্সি ডেরিভেটিভস ইত্যাদি পণ্য প্রচলন, গভর্ন্যান্স ও রেগুলেটরি উন্নয়ন, টেকনোলজি সার্ভিস ও কানেক্টিভিটি এনওডবিøউ, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম, কো-লোকেশন, সার্ভিল্যান্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা, শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রম, ইনডেক্স ও ডাটা বিজনেস, ক্লিয়ারিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন উদ্যেগ নেয়ার কথা বলেছে। এজন্য তারা ডিএসইর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবে। যা নির্দিষ্ট ফির মাধ্যমে দেয়া হবে।
চীনের প্রধান তিনটি স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে সাংহাই ও শেনজেন রয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের সেরা ১০টি স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাতে রয়েছে। সাংহাই স্টক একচেঞ্জের বাজার মূলধন সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন দুই দশমিক দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ৫১ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ১১ হাজার ৪৫৫টি এবং শেনজেনে রয়েছে ৭ হাজার ১০০টি প্রতিষ্ঠান। আর ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান মাত্র ৫৬৭টি। মার্কেট ক্যাপিটালের দিক থেকে কয়েকগুণ এগিয়ে আছে সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ। ডিএসইর মার্কেট ক্যাপিটাল ৪৩ দমমিক ৮০ ইউএসডি। আর সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের যথাক্রমে ৫৪৩৮ দশমিক ২৪ ও ৩৪৫৮ দশমিক ১৪ ইউএসডি।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের পর বাজারের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্রোকারদের প্রভাব কমানোর জন্য মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক অর্থাৎ ডিমিউচুয়ালাইজ করা হয়। ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন ২০১৩ অনুসারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ১৮০ কোটি শেয়ারের মধ্যে ২৫ শতাংশ কৌশলগত অংশীদারদের কাছে বিক্রি করা যাবে। ৩৫ শতাংশ বিক্রি করতে হবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। বাকী ৪০ শতাংশ থাকবে মালিকদের কাছে। আইনে কৌশলগত বিনিয়োগকারী বলতে সেসব প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়েছে, যারা ইকুইটি বা টেকনোলজিক্যাল পার্টনার হিসেবে পর্ষদে থেকে ডিএসইকে একটি আধুনিক এক্সচেঞ্জে উন্নীত করতে সাহায্য করবে। এর আগেও একবার কৌশলগত অংশীদারের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তখন দেশি-বিদেশি কয়েকটি কোম্পানি দরপত্র জমা দিলেও ডিএসইর কাছে ওইসব প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তা বাতিল করা হয়।
এমজে/