৮২তম জন্মদিনে নিযুত শুভেচ্ছা
নিরন্তর কলম সাধনা বয়ে চলুক
মোহাম্মদ আতাউর রহমান
প্রকাশিত : ১১:০০ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১০:৫০ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার
ঢিলেঢালা সাদা পাজামা আর লম্বা পাঞ্জাবি পরে রোজ সকালে ক্যাম্পাসের সবুজ শ্যামল ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে চলা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। অসাধারণ হয়েও অতি সাধারণ জীবন যাপন মানুষটির। রাগ-গোস্বা-আভিজাত্য ছুঁতে পারে নি কখনোই। তার নেই কোনো অতৃপ্তিও। তার ধ্যানে–জ্ঞানে চিন্তায় শুধুই শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজচিন্তা। তার লেখা ছাড়া আজও বড় কোনো কাগজের বিশেষ সংখ্যা বের হয় না। কয়েক যুগ ধরে ধরে তিনি বিবেচিত হচ্ছেন সাহিত্য ও জ্ঞানের বাতিঘর হিসেবেই। কারো কারো মতে জ্ঞানের সাগর তিনি, যেখানে যে কেউ ডুব দিয়ে মণি-মুক্তোর খোঁজ পেয়ে থাকেন। জ্ঞানের দ্যুতি বিলানোয় যেন তার আজন্ম ধ্যানজ্ঞান।
হ্যাঁ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যাঁরের কথাই বলছি। নির্মোহ এই আলোকিত মানুষটির আজ ৮২ তম জন্মদিন। আজও তিনি নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান, একান্ত ব্রতী; আজও তার কলম সাধনা থামেনি। শুভ জন্মদিন, প্রিয় শিক্ষক। আপনার নিরন্তর কলম সাধনা বয়ে চলুক।
সাধক, মনীষী, বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার অন্যতম অগ্রদূত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আপনি অন্তত শতায়ু হোন। দেশ-জাতির জ্ঞান ও বিবেচনায় আরও কিছু পালক যোগ করে যান, জন্মদিনে এটাই আমাদের কামনা।
আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পাঁচ দশকে এ দেশের মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অকুতোভয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম অধ্যাপক; একাধারে অতুলনীয় গবেষক, চিন্তক ও অসামান্য লেখক। তিনি শিক্ষাবিদ, কিন্তু তার শিক্ষার অহঙ্কার নেই। তিনি বিনয়ী, নিরহঙ্কারী। তার জীবনযাপন সাদাসিধে, অথচ প্রাণপ্রাচুর্যে টইটুম্বুর। অপরিসীম মানসিক ধৈর্যশক্তি এবং বয়স ও শ্রেণি-পেশার পার্থক্য ভুলে সবার সঙ্গে তার মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম। তার প্রচ্ছদ লেখা ছাড়া কাগজের বিশেষ কোনো সংখ্যা কিংবা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন যেন খাপছাড়া মনে হয়।
তিনি মুক্তবুদ্ধি, সুরুচি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিঃশঙ্কচিত্ত। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষক হিসেবে জাতির অন্যতম অভিভাবকও তিনি। কয়েক যুগ ধরে যেকোনো সংকটে জাতিকে দিশা দিয়ে চলেছেন ক্ষুরধার লেখনিতে, বক্তৃতায়। তিনি বাচন অত্যন্ত সরল ও সাবলীল তবে গভীর চিন্তার খোরাক থাকে তাতে। থাকে দর্শন, সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা। নির্মোহ মানুষটি নিজের জন্য কিছুই করেননি। সারাজীবন জ্ঞান,বুদ্ধি, সাধনা বিলিয়েছেন অকাতরে। তাকে নিয়েই থিসিস হতে পারে। গবেষণা হতে পারে।
আনিসুজ্জামান স্যারের সাধারণ জীবন যাপন ও চিন্তার গভীরতা নিয়ে তার বন্ধু কবি শামসুর রহমান লিখেছেন, `যখন পাঞ্জাবি আর পাজামা চাপিয়ে শরীরে, সকালে কিংবা বিকেলে একলা হেঁটে যান- প্রায় প্রতিদিন দীর্ঘকায় সবুজ গাছের তলা দিয়ে তাঁকে বাস্তবিক সাধারণ মনে হয়। ...এখনও সিদ্ধির পরে, খ্যাতির শিখরে পদার্পণ করেও সাধনা তাঁর থামেনি, বরং মাঝে মাঝে এখনও গভীর রাতে ঘুমন্ত জীবনসঙ্গিনীর পাশে শুয়ে অথবা টেবিলে ঝুঁকে থিসিসের ভাবনায় কাটান প্রহর।` এই লেখায় আনিসুজ্জামান স্যারের জীবন নিয়ে সঠিক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।
১৯৩৭ সালের এই দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা ছিলেন গৃহিণী। দু`জনই ছিলেন সাহিত্যমনস্ক। পরিবারের অন্য সদস্যরাও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৫২ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে `রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?` শিরোনামের একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর এটিই ছিল প্রথম পুস্তিকা। ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এছাড়া ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামেও তিনি কার্যকর ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে জাতিকে বুদ্ধি পরামর্শ ও লেখনি দিয়ে দিশা দিয়েছেন।
১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারের গৌরব নিয়ে। ১৯৫৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর মাঝে এবং ১৯৬৫ সালে `উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস :ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল` বিষয়ে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৩ সালে তিনি অবসর নেন। বর্তমানে তিনি প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে পাঠদান করাচ্ছেন। এখন মাঝে মধ্যেই মলচত্বরের সবুজ ঘাসে তার ধীর হেটে চলা লক্ষ্য করা যায়।
বর্তমানে তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। জন্মদিন উপলক্ষে এই প্রাজ্ঞজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে একইরকম কর্মব্যস্তই পাওয়া গেল। ৮১ বছরের জীবন পেরিয়েও তিনি যেন এখনও একইরকম প্রাণচঞ্চল। আপনার এই নির্মাহ জীবন ও প্রাণপ্রাচুর্যনতা থাকুক চিরকাল।
শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংগঠনিক কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা।১৯৫৬ সালে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ১৯৫৮ সালে স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে অলক্ত পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ১৯৯০ সালে বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট, ১৯৯৩ সালে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক, ১৯৯৪ সালে অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার, ২০১১ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বর্ণপদক, ২০১২ সালে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১৪ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কালজয়ী এই বিজ্ঞজন। এ ছাড়াও ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এক জীবনের এত অর্জন আর কারো পক্ষে ছোঁয়া সম্ভব হবে কি না বলা মুশকিল। স্যার আপনার নিরন্তর পথচলা অব্যাহত থাকুক। জ্ঞানের দ্যুতি বিলানোর সাধনা বহমান থাকুক অনন্তকাল। জন্মদিনের এই মুহূর্ত জীবনে আসুক আরও অন্তত কয়েক যুগ।
/ এআর /