ভাষাসৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম
আমাদের ধারণা ছিলো ওরা গুলি করবে না
প্রকাশিত : ০৩:১১ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার
মির্জা মাজহারুল ইসলাম। একজন ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকেই সংগ্রাম ও সংগঠনিক তৎপরতার সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি জড়িত হন ১৯৪৭ সালের সূচনাপর্ব থেকেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজে এই আন্দোলন সংগঠিত করেন তিনি। এই আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নিজেকে ভাষা আন্দোলনের ‘আঁতুড় ঘরের’ সাক্ষী বলেও দাবি করেন এ ভাষাসৈনিক।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর পুলিশের হামলার পর তিনি হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অসংখ্য আহত ভাষাকর্মীর চিকিৎসা দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন আমতলার জনসভায় এবং গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি।
মির্জা মাজহারুল ইসলাম প্রায় ছয় দশক ধরে শৈল্য চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি অনারারি হাউজ সার্জন হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন (১৯৫২) এবং তৎকালীন ই পি এম এস ক্যাডারে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। হাউস সার্জন ও ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার (১৯৫৪), সহকারী সার্জন : বরিশাল সদর হাসপাতাল (১৯৫৮), সহকারী সার্জন : ফরিদপুর সদর হাসপাতাল (১৯৬০), সহযোগী অধ্যাপক : ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (১৯৬৬), প্রফেসর অব সার্জারি ও প্রিন্সিপাল : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (১৯৭৬), প্রফেসর অব সার্জারি : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (১৯৮০) এবং ১৯৮৫ সালে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর পর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের উপদেষ্টা হিসেবে কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন তিনি। মুখ্য উপদেষ্টা : বারডেম সার্জারি বিভাগ (১৯৯৩) এবং তিনি দু’বার বারডেমের অবৈতনিক মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ কলেজ অব জেনারেল প্র্যাকটিশনারসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ২০ বছর ধরে।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনের একান্ত সাক্ষাৎকারে এই প্রবীণ ভাষাসৈনিক জানালেন ভাষা আন্দোলনের সেইসব দিনের কথা। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- সোহাগ আশরাফ
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : স্যার, কেমন আছেন?
ভাষাসৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম : সবার দোয়ায় এখনও বেঁচে আছি।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : স্যার, আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। আপনি ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম সক্রিয় ভাষাসৈনিক। আমরা আপনার কাছে জানতে চাই- বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা করবার জন্য আন্দোলনের সূচনাটা কিভাবে হয়েছিলো?
ভাষাসৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম : সেই কথা যদি বলি তবে একটু পেছনে যেতে হয়। আমরা যখন আন্দোলন আরম্ভ করেছি তার আগে ব্রিটিশদের সঙ্গে কিন্তু যুদ্ধ হয়ে ছিলো। সেই যুদ্ধের কি পরিণতি হবে তা আমরা ধরে নিয়ে ছিলাম। যদি দেশ বিভক্তি হয় তাহলে ভাষাও বিভক্তি হবে। ওরা (ব্রিটিশ) আগে থেকেই এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য খুব সিকিউর অবস্থায় ছিলো। আমরা বহুবার অনুরোধ করে বলেছি যে- বাংলাটাকে আপনারা রাষ্ট্রভাষা করেন। এ কথাও বলেছিলাম যে- উর্দুর সঙ্গে হলেও বাংলাটাকে রাখেন। দুইটা ভাষাই হোক।
১৯৪৭ সালে দিকে আমরা বিপদে পড়ে গেলাম। ঢাকার লোক সংখ্যা তখন দেড় লাখের মত ছিলো। ওরা (পাকিস্তানি) আসায় প্রায় দুই আড়াই লাখ হয়ে গেলো। যখনই কথা বলি দেখি বিপদ। আমরা মেডিকেল, ইউনির্ভাসিটির শিক্ষার্থীরা যেখানেই যাই দেখি উর্দুতে কথা বলছে সবাই। যে কোন অফিসে যাই উর্দু। কাগজে, কলমে উর্দু। যেখানে যেখানে বাংলা ছিলো তাও উঠে গেলো। ওরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আসছে। ওরা মনে করেছে আমরা দুর্বল। আমাদের ওদের সঙ্গেই থাকতে হবে। আমরা মানতে পারলাম না। আমরা ওতটা বেকুব নই। ছাত্ররা ওতটা বেকুব হতে পারে না। আমরা মাঝে মাঝে গোপনে মিটিং করতাম। যত সময় যাচ্ছে আমাদের ইউনিটিটা আরও বাড়ছে।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : আপনি কি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন?
ভাষাসৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম : হ্যাঁ। আমি কলকাতা থেকে এসেছিলাম। ওই সময় প্রতিজ্ঞা করেই এসেছি যে আমরা বাংলা ভাষাই প্রতিষ্ঠিত করব। কিছুদিন ভালো ভাবে চললো। কিন্তু তারপর দেখা গেলো টাকার উপর ব্রিটিশ আমলে যে বাংলাটা ছিলো তাও তারা উঠিয়ে দিলো। ওখানে উর্দু বসিয়ে দিলো। যা সাধারণ মানুষ পড়তে পারতো না। গ্রামের লোকদের পড়তে সমস্যা হতো। এর আগে কিন্তু মানিঅর্ডারে বা পোস্ট কার্ডে বাংলা ও ইংরেজি লেখা থাকতো। আমাদের বর্তমান বাংলাটাই তখন ছিলো।
যেখানেই যাই একই ভাষায় কথা বলে, ওই উর্দু। আমরা বললাম এটা চলতে পারে না। ওই সময় ঢাকায় কিছু রায়েট (দাঙ্গা) সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন ভাবে ওগুলো থামানো হয়। কিন্তু যখন প্রত্যক্ষ আক্রমন আসলো, আমাদের যখন বাংলা বলতে দেওয়া হবেই না, আমাদের উর্দু বলতেই হবে তখন আর আমরা চুপ থাকতে পালাম না। ১৯৪৭ এ-ই আমরা আন্দোলন শুরু করলাম। তবে এই আন্দোলনে আমরা তেমন ভাবে ভায়োলেন্ট হইনি। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ আমরা একটা বিক্ষোভ প্রদর্শন করলাম। দেখতে চেয়েছিলাম সাড়াটা কেমন পড়ে। কিন্তু অনেক সাড়া পেলাম। ওই সময় আমারও মাথা ফেটে গেছিলো। আমি সলিমুল্লাহ হলে থাকতাম। তখন ওই ভাবে হোস্টেল ছিলো না। বাঁশের ব্যারাক তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রথম ব্যাচের ছাত্র। আমরা চারটা হলে ভাগ হয়ে রইলাম। ৪৮-এ আমরা যে উৎপাত করলাম তাতে লাঠিচার্জ দিয়ে উঠিয়ে দিলো। আমি ছাত্রনেতা ছিলাম। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রদের নিয়ে এডিন ভবনের দিকে অগ্রসহ হলাম। এখন যেখানে শিক্ষা ভবন সেখানে আমাদের বাধা দেওয়া হলো। কি আর করার। ঢিল মারামারি করলাম। একপর্যায়ে সংঘর্ষ হলো। ওই সময়ই আমি আহত হই। আমরা কার্জন হলে সেল্টার নিলাম। আমরা আবারও দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ওরা লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দিলো। ওই সময় বঙ্গবন্ধু সহ অনেককে আটক করে নিয়ে যাওয় হয়। আমরা দেখেছি গাড়িতে তাদের নিয়ে যাচ্ছে। আমরাও বুঝলাম যে আমাদের আটক করা হতে পারে। তাই স্লোগান দিতে দিতে সেখান থেকে সরে গেলাম। এটা ছিলো আমার প্রথম অংশগ্রহণ। এরকম পুরো শহরেই হয়েছে। স্কুলে-কলেজে সব জায়গায় ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলো। সবাই আমাদের পক্ষে। শুধু একটা পক্ষ ছিলো না। ওরা পাকিস্তানকেই চেয়েছিলো। আমাদের সময় আমাদের গভর্নমেন্ট একটা চুক্তি করলো। তারা জানালো আমরা এটি অ্যাসিম্বলিতে পাস করে আনার চেষ্টা করবো, তোমরা শান্ত থাকো। উর্দু বাংলা দুটাই থাকবে। পরে যারা ওয়াদা করলো তারাই তালবাহানা শুরু করে। আমাদের গভর্নমেন্ট ছাত্রদের সঙ্গে একটা কম্প্রোমাইজ করতে গেলো, তারা বললো যে- তোমাদের আর আন্দোলন করতে হবে না, আমরাই করে দিবো। এরপর অনেক ঘটনা। তা হয়তো সবার জানা আছে। কিন্তু পরবর্তিতে সব ওয়াদা ভঙ্গ করে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেয়। এতেই আগুন ধরলো। এর মধ্যে তো অনেক সময় চলে গেছে। তখন ৫২ চলে আসে।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সেক্রেটারিয়াটে আমাদের মানপত্র জমা দিবো। সেখানে ঘেরাউ করে বসে থাকবো যতক্ষনা মানপত্র গ্রহণ করা না হয়। ওই অ্যাসেম্বলি বসার সময়ই গোলমান শুরু হয়ে যায়। ওরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ২১ তারিখে ডেট দিয়েছে, ওই দিনও অ্যাসেম্বলি চলবে। জগন্নথ হলে ওই অ্যাসেম্বলি চলছে। আমরা আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে বললাম- আমতলায় অর্থাৎ যেখানে মেডিকেলের প্রধান গেট সেখানে হাজির হতে হবে। অনেক লোকের সমাগম ঘটলো। এতো লোক সাড়া দিবে বোঝাই যায়নি।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : এই আন্দোলনে কি শুধু ঢাকার মানুষই অংশ নেয়। নাকি ঢাকার বাইরের মানুষও আসে?
ভাষাসৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম : না, ঢাকার বাইরে থেকে আনা হয়নি। হয়তো নিজে থেকে কেউ আসতে পারে। সকাল ১০টার মধ্যই মাঠ ভরে যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে আগের দিনে ওরা ১৪৪ ধারা দিয়ে দিয়ে দেয়। আমরা তা ভেঙেই জড় হই। তবে আশঙ্কায় ছিলাম যে, যেনো সময় লাঠিচার্জ করতে পারে। কিন্তু ওরা আমাদের দেখেও দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা গেটের ভেতরে। বাইরে যাকেই পায় ধরে। মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন যেখানে শহীদ মিনার সেই সড়কটা যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিনত হলো। আমাদের কাছে একমত্র অস্ত্র হচ্ছে ইট। ওদের কাছে টিয়ার গ্যাস, বন্দুক, লাঠি সব কিছু নিয়েই ওরা হামলা চালায়। এতো পরিমানে টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে যে ধুয়াতে অন্ধকার হয়ে গেছে। ওই সময় ওখানে অনেক গাছ ছিলো। তবে এতো কিছুর মধ্যেও কেউ চলে যায়নি। দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে। এভাবে অনেক সময় চলে। বিকেল হয়ে যায়। ওরা হয়তো অপেক্ষায় ছিলো। এরপর চালায় গুলি। আমরা বরকতের সঙ্গে ছিলাম। সে ছিলো হোস্টেলের বারান্দায়। আমাদের ধারণা ছিলো আর যা করুক ওরা গুলি করে মারবে না। কিন্তু তাই করলো। অনেকেই আহত হলো। কারো পায়ে, কারো গায়ে গুলি লেখেছে।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : অনেক ধন্যবাদ। আপনার সুস্থতা কামনা করছি।
ভাষাসৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম : ধন্যবাদ।
এসএ/