রাইড শেয়ারিং অ্যাপস
বাড়ছে মোটর সাইকেলের বাজার
সোলায়মান হোসেন শাওন
প্রকাশিত : ০৩:১৪ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৭:১৫ পিএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার
রাইড শেয়ারিং এর ধারণা আমাদের দেশে খুব বেশি না হলেও দিন দিন এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাছে। এর ফলে বাড়ছে দেশের মোটর সাইকেলের বাজার। পাশাপাশি দেশেই মোটর সাইকেল উৎপাদন বা সংযোজনের কারণে আগের তুলনায় কম মূল্যে কেনা যাচ্ছে এই দ্বিচক্র যান। এসব সুবিধার পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনের জন্য সরকারি খরচ কম হওয়াতেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মোটর সাইকেল বিক্রির পরিমাণ।
কি পরিমাণ মোটর সাইকেল আছে?
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা বিআরটিএ জানায়, ২০১৭ সালের শেষ দিন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় রেজিস্ট্রেশন হওয়া মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৫ লাখ ৭২ হাজার ৬৮৬টি। এর মধ্যে শুধু ২০১৭ সালেই রেজিস্ট্রেশন হয় ৭৫ হাজার ২৫২টি মোটর সাইকেল। অন্যদিকে সারা দেশে রেজিস্ট্রেশন হওয়া মোটর সাইকেলের সংখ্যা ২৩ লাখ ১০ হাজার ৮৬৭টি। তবে রাজধানীর বাইরে অনেকে বাইকের রেজিস্ট্রেশন না করায়, মোটর বাইকের আসল সংখ্যাটা কত, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই।
উল্লেখ্য ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে মোটর বাইক রেজিস্ট্রেশন করার প্রচলন তুলনামূলক কম হওয়ায় মোট বাইকের পরিমাণ উল্লেখিত সংখ্যার থেকে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের মাধ্যমে অনেক মোটরবাইক দেশে প্রবেশ করায় সংখ্যাটা ধারণারও বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সবথেকে বেশি মোটর সাইকেল নিবন্ধিত হয় ২০১৭ সাল, যার পরিমাণ ৭৫ হাজার ২৫২টি। তবে সবথেকে কম মোটর সাইকেল বিক্রি হয় ২০১৩ সালে। ২৬ হাজার ৩৩১টি। মোটর সাইকেল বিপণন ও বিক্রয় করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এক নজরে (২০১৩-২০১৭)
এলাকা |
২০১৩ |
২০১৪ |
২০১৫ |
২০১৬ |
২০১৭ |
মোট |
ঢাকা |
২৬৩৩১ |
৩২৮৯৪ |
৪৬৭৬৪ |
৫৩৭৩৮ |
৭৫২৫২ |
৫৭২৮৬৮ |
বাংলাদেশ |
৮৫৮০৮ |
৯০৬৮৫ |
২৪০৩৫৮ |
৩৩২০৫৭ |
৩২৫৪৯১ |
২৩১০৮৬৭ |
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম
বর্তমানে রাজধানীতে চালু থাকা বাইক রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কার্যক্রম থাকা অ্যাপসগুলোর মধ্যে পাঠাও, উবার মটো, মুভ, ইজিয়ার, স্যাম, ওভাই মটো, ডাকো ক্যাপ্টেইন, লেটস গো, সহজ রাইড ইত্যাদি অন্যতম। ২০১৬ সালের শেষভাগে দেশে প্রথমবারের মত শুরু হওয়া এসব রাইড শেয়ারিং অ্যাপস বেশ দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাজধানী জুড়ে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামেও বিস্তৃতি লাভ করে এ সেবা।
এ খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, সামনের বছরগুলোতে এ সেবা আরও জনপ্রিয় হবে। বর্তমানে রাইড শেয়ারিং এর যে পরিমাণ চাহিদা আছে সে পরিমাণ যোগান নেই।
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ওভাই এর চীফ অপারেটিং অফিসার কাজী ওমার ফেরদৌস বলেন, “বর্তমানে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ৫৫ লাখ ট্রিপ হয়। অর্থ্যাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ ৫৫ লাখ বার যাতায়াত করে। সে হিসেবে সামনের দিনগুলোতে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের বাজার আরও বড় হবে”।
সিঙ্গাপুর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রাব বাইকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু রাজধানীতেই কমপক্ষে ২লক্ষ মোটর সাইকেল দরকার যারা নিয়মিত রাইড শেয়ারিং করবে। এমনটা হলে সকলের জন্য এ সেবা নিশ্চিত করা যাবে। তবে রাইড শেয়ারিং সুবিধা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করছে তাতে অচিরেই এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌছানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
গুগল প্লে-স্টোর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবথেকে বেশি মোটর সাইকেল নিবন্ধিত আছে পাঠাও-তে। নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ১ লাখেরও বেশি। সবগুলো অ্যাপস মিলিয়ে সংখ্যাটা এমনই হবে। আর এসব প্ল্যাটফর্মের কারণে বাড়ছে মোটর সাইকেল বিক্রির পরিমাণ।
কর্মসংস্থানের উৎস
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো অনেকের জন্যই হয়ে ওঠছে কর্মসংস্থানের উৎস। বিশেষ করে তরুণ এবং যুবকদের একটি বড় অংশ আয়ের মাধ্যম হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মকে। কিস্তি সুবিধার সুযোগ নিয়ে অনেকেই কিনছেন মোটর সাইকেল। স্বাধীনভাবে কাজ করে তৈরি করে নিচ্ছেন নিজের আয়ের উৎস।
২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকারত্বের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। মোটর সাইকেল খাত এবং রাইড শেয়ারিং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বেকারদের বড় একটি অংশ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত জীবন রায়হান বলেন, “টিউশনি করে করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলো থেকে ভাবলাম আমিও হয়তো শুরু করতে পারি। জমানো টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে কিস্তিতে একটি মোটর সাইকেল কিনলাম। এখন ভার্সিটির পর রাইড শেয়ার করি। নিজের ইচ্ছেমত স্বাধীনভাবে কাজ করি। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। কাজটা বেশ ভালোই লাগে আমার”।
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বাড়ছে মোটর সাইকেল ইন্ডাস্ট্রির পরিমাণ। মোটর সাইকেল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত অনেকের মতে, এর ফলে এ ইন্ডাস্ট্রি আরও বড় হবে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তৈরি করবে আরও কর্মসংস্থান। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে মোটর সাইকেল বিক্রির এই যে কাটতি তার অন্যতম প্রধান দুই কারণ হল দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশে হিরো মোটর সাইকেলের বিপণন প্রধান মাহবুব আলম বলেন, “বাংলাদেশে বর্তমানে মোটর সাইকেলের বাজার খুবই ভাল। রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলো এখানে একটি ভালো ভূমিকা রাখছে। অনেকেই শুধু রাইড শেয়ারিং এর জন্য মোটর সাইকেল কিনছেন”।
ই-কমার্স সাইট পিকাবুর সহকারী বিপণন ব্যবস্থাপক নাইম হোসেন বলেন, “রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের কারণে দিন দিন মোটর সাইকেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা মাসিক কিস্তি সুবিধা চালুর আগে যে অনুমান করেছিলাম বাস্তবে গড়ে মোটর সাইকেল পরিমাণ অনেক বেশি। গ্রাহকদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি আমরা”।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের বৈধতা
ঢাকার বাইরে এখন বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও কার্যক্রম চালু করেছে বেশ কয়েকটি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান। এ খাত সংশ্লিষ্টদের অনুমান অনুযায়ী চলতি বছরের মধ্যে দেশের সবক’টি বিভাগীয় শহরে চালু হতে পারে এ সেবা। তবে দ্রুত প্রসারিত হওয়া এই প্ল্যাটফর্মের জন্য এখনও নেই কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা। তবে একটি খসড়া নীতিমালা ইতোমধ্যে মন্ত্রীসভায় অনুমোদনের কথা জানান বিআরটিএ পরিচালক (প্রকৌশল) মো. নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলো ইতোমধ্যে আমাদের এক ধরনের মৌন সম্মতি পেয়েছে। তবে এর জন্য একটি আইনী কাঠামো দরকার। একটি খসড়া নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে। পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন, এখন সময়ের ব্যাপার।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের এই খসড়া নীতিমালার কারণে অনেকটা স্বস্তিতে আছে এই সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সে কারণেই নিজেদের ব্যবসা প্রসারিত করছে এ খাত সংশ্লিষ্টরা। ফলশ্রুতিতে বিক্রি বাড়ছে মোটর সাইকেলের।
সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে এ খাতটিকে যদি পরিচালনা করা যায়, তাহলে মোটর সাইকেল খাতের জন্যই ভালো হবে বলে মনে করছেন মোটর সাইকেল বাজারজাতকরণ এবং রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জড়িতরা।
এমজে