পোড়ামন ২ এর শ্যুটিংয়ে আমরা সবাই কেঁদেছি: রায়হান রাফি
প্রকাশিত : ০৭:০৩ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১২:১৬ এএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রবিবার
বাংলা চলচ্চিত্রে এখন কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ কাজ করছে। তারাই এই ইন্ডাস্ট্রিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিসীম প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের মধ্যে রায়হান রাফি অন্যতম। বর্তমানে তিনি আলোচিত চলচ্চিত্র ‘পোড়ামন ২’ নির্মাণ করছেন। যিনি পড়ালেখা করেছেন মাদ্রাসায়। সেখানকার চারদেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হাত দিয়েছেন নির্মাণে।
তার বর্তমান কর্মব্যস্ততা, চলচ্চিত্র ভাবনা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, সবকিছু নিয়ে কথা হয় ইটিভি অনলাইন এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আউয়াল চৌধুরী।
ইটিভি অনলাইন: চলচ্চিত্র তৈরির স্বপ্ন কিভাবে তৈরি হলো?
রায়হান রাফি: আমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছি। সেখানে টিভি দেখা বা পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু নিজের স্বপ্ন জগতে সিনেমার বিষয়গুলো সবসময় ঘুরপাক খেত। তাই চুরি করে পত্রিকা কিনে বিনোদনের নিউজগুলো পড়তাম। এর মাধ্যমে নিজের আগ্রহ আরো বাড়তে লাগলো। যখন সিনেমা দেখতাম তখন ছবির পরিচালকের নামের প্রতি খুব খেয়াল করতাম। এই নামটিই সব। এটি আমাকে খুব টানতো। আমি এই নাম নিয়ে ভাবতাম। আমার একটা ডায়েরি ছিল সেখানে ছবির নাম, পরিচালকের নাম লিখে রাখতাম। এভাবে নিজের মধ্যে একটা স্বপ্ন তৈরি হলো।
ইটিভি অনলাইন: মাদ্রাসার ঘেরাটোপ পেরিয়ে চলচ্চিত্রে আসলেন, কিভাবে সম্ভব হলো?
রায়হান রাফি: এটা একটা কঠিন ব্যাপার। মাদ্রাসার ওই দেয়াল থেকে বের হয়ে আসা অবশ্যই একটু কঠিন। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি কিছু একটা করার। চুরি করে বিনোদনের নিউজ পড়ার সময় একদিন তারেক মাসুদের নিউজ দেখি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে দেখা করি। আমি যখন সিনেমা দেখতাম তখন মনে হতো আমি যদি গল্প বলি এর থেকে ভালো গল্প বলতে পারবো। আমি নিজে নিজে গল্প বানাতাম। আমাদের প্রচুর পড়তে হতো। ভোর তিনটা থেকে প্রায় রাত ১২ পর্যন্ত পড়তাম। এর মধ্যে গল্প নিয়ে ভাবতাম। এভাবে সিনেমার মধ্যে ঢুকে যাওয়া। তারপর মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করলাম।
ইটিভি অনলাইন: নাটক না বানিয়ে শর্ট ফিল্ম এর দিকে কেন ঝুঁকলেন?
রায়হান রাফি: আমার মাথায় সব সময় সিনেমার ভাবনা থাকতো। নাটক বানানোর চিন্তা কখনো করিনি। তাই ভাবলাম সিনেমা বানানোর আগে প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সে জন্য শর্ট ফিল্ম বানাতে হবে। তাই শুরু করলাম ছোট ছবি বানানো। আমি চেষ্টা করেছি শর্ট ফিল্মগুলো সিনেমার মতো করে বানাতে। বিগ বাজেটের শর্ট ফিল্মও তৈরি করেছি। আমার বেওয়ারিশ নামে একটা শর্ট ফিল্ম ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন ইউনিভাসিটিতে সেটা প্রদর্শন করেছি। আবার অনেকগুলো শর্ট ফিল্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেখানো হয়। তারপর অনলাইন মিডিয়ার জন্য কিছু কনটেন্ট বানাই। আমার ‘আজব বাক্স’ নামে একটা শর্ট ফিল্ম যেটাকে বলা হয় ফেসবুকের সবচেয়ে ভাইরাল শর্ট ফিল্ম। এই ফিল্মটি অনেক মানুষ দেখেছে। মানুষের কাছ থেকে ভালো রেসপন্স পাওয়ায় তখন আরো বড় কিছু করার সাহস পেতে থাকি।
ইটিভি অনলাইন: ইউটিউব থেকে কেমন আয় করলেন?
রায়হান রাফি: এখনতো ইউটিউবের যুগ। আমি অনেকগুলো শর্ট ফিল্ম বানিয়েছি। কিন্তু ইউটিউব দিয়ে টাকা ইনকামের চিন্তা কখনো করিনি। মাথায় সিনেমার চিন্তাটাই বেশি কাজ করেছে, টাকা নিয়ে সেজন্য ভাবিনি। ভাবলে অনেক টাকা আয় করতে পারতাম। আমি যদি কনটেন্টগুলো ফেসবুকে না ছাড়তাম তাহলে আমি হয়ত সিনেমা বানাতে পারতাম না। ফেসবুকে ছাড়ার পর অনেক মানুষের কাছে পৌছে গেছে তখন আমার কনফিডেন্ট অনেক বড়ে গেল যে আমি আরো অনেক ভালো কিছু করতে পারবো। বড় বাজেটেরও অনেকগুলো শর্ট ফিল্ম তৈরি করি। আমার বেশির ভাগ শর্ট ফিল্ম বিগ বাজেটের ছিল। সিনেমার মতো করে করা।
ইটিভি অনলাইন: পোড়ামন ২ এর গল্প শুনতে চাই। কিভাবে শুরু করলেন?
রায়হান রাফি: এই ছবি শুরু করার আগে আমার একটি শর্ট ফিল্ম ছিল খেলনা নিয়ে। গল্পটা এইরকম, আমাদের অনেকের বাসায় পুরোনো খেলনা আছে। সেগুলো আমরা ফেলে দেই বা কোথাও রেখে দেই। এই পুরনো ভাঙ্গা খেলনাগুলো যদি আমরা এমন মানুষকে দেই বা এমন বাচ্চাদের দেই যাদের কাছে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাদেরকে টাকা দিলে খুশি হবে না কিন্তু এই ভাঙ্গা খেলনা দিলে খুব খুশি হবে। এই শর্ট ফিল্মটা আজিজ ভাই কারো মাধ্যমে দেখেছেন। দেখার পর তিনি তাকে বললেন এই ছেলেটাকে আমার দরকার। ওকে নিয়ে আস। তারপর আমি দেখা করতে আসলাম। তিনি বললেন আমি সবাইকে ইমোশনাল করে দেই আর তুমি আমাকে ইমোশনাল করে দিয়েছ। এখন বল, সিনেমা বানাবা।
আমি বললাম জি ভায়া ছবিতো বানাবো এক সময়। ইচ্ছা আছে। তিনি গল্প চাইলেন। এরপর বেশ কিছু দিন পার হয়ে যায়। মাথায় কোনো ভাল গল্প আসে না। তারপর আবার একদিন আজিজ ভাই ডাকলেন। তিনি জাজের ওপর একটি ডকুমেন্টারি বানাতে বললেন। আমি কাজটি করলাম। এটা আজিজ ভাই খুব পছন্দ করলেন।
সিনেমার জন্য গল্প অনেক চিন্তা করছি কিন্তু মাথায় আসছেনা। তারপর আবার বেশ কিছুদিন গ্যাপ। আমাকে গল্প দেওয়ার জন্য বলে কিন্তু ওই রকম গল্প আসে না। এরপর গল্প মাথায় আসলো। আজিজ ভাইকে বললাম। তিনি পছন্দ করে ফেললেন। বললেন আমি এটাই বানাবো। নাম হবে ‘পোড়ামন ২’।
ইটিভি অনলাইন: প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
রায়হান রাফি: আমি খুবই লাকি যে শুরুতেই জাজ মাল্টিমিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠান পেয়েছি। এখানে কাজ করার ক্ষেত্রে আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। সিনেমা করতে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন সংকট দেখা দেয় বাজেট সংকট বা অন্যান্য কিছু সমস্যা থাকে। কিন্তু এখানে আমি যা চেয়েছি, সবই পেয়েছি। এদিক থেকে আমি খুব হ্যাপি।
ইটিভি অনলাইন: প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে শ্যুটিং এর অভিজ্ঞতা কেমন?
রায়হান রাফি: শ্যুটিং এর অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। যখন যেটার প্রয়োজন তখন সেটা অলৌকিকভাবে হলেও পেয়ে গেছি। যেমন শটে আমার একটা কুকুর লাগবে। আমরা শট ধরেছি দেখি একটা কুকুর কোত্থেকে চলে এসেছে এবং শটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমাদের একটা দৃশ্যে ছিল বাপ্পা ভাই কাঁদতেছে। ওই সময় আমি বললাম যে, এখানে একটা কুকুর থাকলে খুব ভালো হতো। তখনই দেখলাম একটা কুকুর চলে আসলো। বাপ্পা ভাই কাঁদতেছে তিনি একজন প্রফেশনাল অভিনেতা। অ্যাকটিং না থামিয়ে ধরে রেখেছেন। এরপর বাপ্পা ভাই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। ঠিক কুকুরটাও তার পেছন পেছন চলে গেল। কিছু অলৌকিক ঘটনা আমাদের শ্যুটিং এ ঘটেছে। এ জন্য বলছি আমার কপালটা ভালো। শুরুতেই পোড়ামন করছি।
ইটিভি অনলাইন: আপনি নতুনদের নিয়ে কাজ করছেন। অন্যদিকে আপনারও এটি প্রথম চলচ্চিত্র। নতুন নিয়ে কাজ করতে কোনো সমস্যা কি মনে হয়েছে?
রায়হান রাফি: প্রথমে বলি, পোড়ামনের জন্য আমি অনেক নায়িকা দেখেছি কিন্তু কোনো নায়িকাই আমার পছন্দ হচ্ছিল না। তাই চিন্তা করলাম একটা নতুন মেয়ে লঞ্চ করবো। তারপর আমার পূজার কথা মাথায় আসলো। আমি যখন শর্ট ফিল্ম বানাই তখন পূজার কথা মাথায় ছিল। কিন্তু ওই সময় তাকে নিয়ে কাজ করা হয়নি। ওর অভিনয় আমার খুব পছন্দ হয়। তখন আজিজ ভাইকে ওর বিষয়ে বললাম। তিনি বললেন দেখ বাচ্চা মানুষ পারবে কি না। তারপর তার ফটোশুট করলাম। ছবি দেখে সবাই খুব প্রশংসা করলো। বললো ওতো ভালো করবে। তারপর শুরু করলাম। পূজার প্রথম সিনেমা ‘পোড়ামন ২’। আর সিয়াম সেতো আগে থেকেই মিডিয়ায় কাজ করে। সিনেমায় নতুন হলেও অনেক নাটক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছে। মূলকথা হলো আমার হিরো হিরোইন আমি কি চাই তারা সেটা ভালো বুঝতে পারে। তারা দু’জন খুবই কো-অপারেট করে। সে জন্য অলরেডি ঘাষণা দিয়েছি আমার পরবর্তী ছবিতে পূজা আর সিয়াম থাকবে। আমি চাই তাদের নিয়ে কাজ করতে। কারণ তাদেরকে নিয়ে আমি খুব কমপোর্টেবল। তাদেরকে আপনারা সহযোগিতা করবেন। আমরা যদি তাদের না দাঁড় করাই তাহলে ইন্ডাস্ট্রি চলবে না। আমরা ভালো কিছু করতে পারলে এটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য ভালো।
ইটিভি অনলাইন: এ পর্যন্ত ছবির তিনটি ‘লুক’ প্রকাশ করেছেন। যা এর আগে বাংলাদেশের ছবিতে তেমন একটা দেখা যায়নি। এ সম্পর্কে কিছু বলুন?
রায়হান রাফি: আমরা আমাদের সিনেমার মার্কেটিংটা একটু অন্যভাবে প্রচার করছি। আগে সিনেমায় ফার্স্ট লুক বের হতো না। আমরা এই স্টাইলটা শুরু করেছি। এই চর্চাটা আমাদের শুরু করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এখন বাংলাদেশে এটার একটা স্টাইল শুরু হলো। আমরা কমার্শিয়ালে নতুন একটা মাত্রা যোগ করার চেষ্টা করছি।
আমরা প্রথমে ফার্স্ট লুক ছেড়েছি। মানুষ যখন সিনেমাটা দেখতে যাবে তখন নিজেকে কানেক্ট করতে পারবে ও তাহলে এই জায়গায় ছিল এটা। এই ফার্স্ট লুকটাই আমার ছবির গল্প। সিনেমা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ধরে ফেলতে পারবে কেন এই ফার্স্ট লুক।
সর্বশেষ যে পোস্টারটি ছাড়া হয়েছে এটা আসলে কবর না অন্য কিছু, এখানে এক ধরণের ধাঁধা রয়েছে। দর্শক ছবি দেখলে সেটা জানতে পারবে। আমাদের প্রত্যেকটা পোস্টারই প্রচুর শেয়ার হয়েছে। এরকম ভাইরাল এর আগে কোনো পোস্টার হয়নি।
তবে বাংলাদেশে একটা বিষয়ে খুব কষ্ট লাগে, সেটা হলো কোনো ভালো জিনিষ করা হলেও অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। সবাই মনে করে এটা বুঝি নকল। এটা নিশ্চয় কোথাও থেকে কপি মারছে। এরকম ভাবনাটা বেশি। পৃথিবীর সব কিছু কোনো ঘটনা বা ক্ষেত্রের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। কথা মিলে যেতে পারে কাজ মিলে যেতে পারে তাই বলে সেটা নকল না।
ইটিভি অনলাইন: ‘পোড়ামন ২’ মানুষ কেন দেখবে। কি আছে এর ভেতর?
রায়হান রাফি: ‘পোড়ামন ২’ অবশ্যই ভালোলাগার মতো একটি ছবি। এই ছবি কেউ দেখতে বসলে তার ভালো লাগবে ইনশাআল্লাহ। ভালো লাগার মতো যত উপাদান প্রয়োজন সবই আছে আমাদের এই ছবিতে। এটা একটা খাঁটি বাংলাদেশি ছবি। সকল আর্টিস্ট বাংলাদেশি, পরিচালক বাংলাদেশি, লাইট, ক্যামেরা, ফাইট সব কিছুই এদেশের। সব কিছুতে রয়েছে বাংলাদেশের ফ্লেভার। তবে আমি বলবো যাদের হার্টের সমস্যা আছে তাদের ছবিটি দেখতে না যাওয়াই ভালো। বেশি মর্মান্তিক ছবি। আমি কাজে বিশ্বাস করি। ছবির ট্রেইলার দেখলেই সবাই বুঝতে পারবে।
ইটিভি অনলাইন: এই ছবির ব্যাপারে আপনি খুবই কনফিডেন্ট, কেন?
রায়হান রাফি: খুবই কনফিডেন্ট হওয়ার কারণ হলো আমরা যখন মেহেরপুরে সিনেমাটির শ্যুটিং করি, সেখানে এমন কিছু দৃশ্যেপট তৈরি হয়েছিল যা ভোলার মতো নয়। যখন ইমোশনাল সিনগুলো শুট করা শুরু করি দেখি পুরো ইউনিট কাঁদছে। আমাদের ক্যামেরাম্যান তিনি কাঁদছেন, লাইট ক্রুতে যারা আছে দেখি তাদের চোখেও পানি থৈ থৈ করছে। এ এক অন্যরকম ঘটনা, সবার চোখেই পানি। আমরা সবাই কাঁদছি। আমি কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো বাজানো হয়। সবাই খুব ইমোশনাল হয়ে যায়। এমনকি এখন যে ডাবিং চলছে এ সময়ও ওই দৃশ্যেগুলোতে আমরা নিজেরাই ঠিক থাকতে পারছি না। আমার বিশ্বাস মানুষ এই সিনেমা দেখে ঠিক থাকতে পারবে না।
এসি/