নৈর্ব্যত্তিক ও সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দিতে হবে
প্রকাশিত : ০৭:৪২ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৩:৪৩ পিএম, ১ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক। জীবনের একটি বড় অংশ অধ্যাপনায় কাটালেও লেখক, গবেষক, অনুবাদক, সমাজ বিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবেও তার অবদান অনন্য। নির্মোহ রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য সমসাময়িককালে যাদের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক অন্যতম।
প্রগতিপ্রয়াসী এ লেখকের লেখায় মূলত স্বদেশ ভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তা প্রাধান্য পায়। তার লেখায় থাকে অন্ধাকার ভেদ করে আলোয় আসায় দিশা। সম্প্রতি রাষ্ট্রচিন্তা, শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজচিন্তা ও সংস্কৃতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় একুশে টেলিভিশন অনলাইনে। এতে প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতি, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, একুশে বই মেলা, ছাত্র রাজনীতি, ডাকসু নির্বাচনসহ নানা দিক উঠে এসেছে তার কথায়। তিনি মনে করেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ায় গলদ। আমাদের শিক্ষানীতি নতুনভাবে করতে হবে। শিক্ষা থেকে নৈর্বত্তিক ও সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। মূল শিক্ষাব্যবস্থাকে বিভক্ত করে ইংরেজি ভার্সন চালু করাটা ঠিক হয়নি। প্রচলিত ইংরেজি ভার্সন দিয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়ছে না। এর সংস্কার প্রয়োজন। পাশাপাশি নীতি নৈতিকতার শিক্ষায় জোর দিতে হবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ প্রশ্নফাঁস এই সময়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বড় একটি সমস্যা। একজন শিক্ষক হিসেবে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কী উপায় আছে বলে মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই নানা ধরনের সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পুরো জাতির মনোযোগ একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এটাকে আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্য যেসব সমস্যা আছে, সেসবের তুলনায় প্রশ্নফাঁস একটা গৌণ ব্যাপার। এ রকম শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি থাকলে প্রশ্নফাঁস হবেই। পদ্ধতিগত ত্রুপর কারণেই প্রশ্নফাঁস এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি তাহলে কেমন শিক্ষা কিংবা পরীক্ষা পদ্ধতির কথা বলছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ এই পরীক্ষা পদ্ধতি স্থগিত করে শিক্ষামুখী ,জ্ঞানমুখী পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা উচিৎ। এদেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরো অনেক মনীষী পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। নানা ধরনের মতামত দিয়েছেন। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। আগে যেরকম বর্ণনামুলক, বিশ্লেষণমূলক, বিচারমূলক, জ্ঞানমূলক,শিক্ষামূলক প্রশ্ন করা হতো সেটা ভালো ছিল। পরিবর্তিত বাস্তবতায় তার আরও সংস্কার করার সুযোগ আছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে বৃত্তিমুলক শিক্ষা, পেশামূলক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বর্তমানের সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দিয়ে আগের বর্ণনামূলক পদ্ধতিকে আধুনিক ও বিকশিত করতে পারলেই শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে ।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ তাহলে কী আপনি বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতির সরাসরি বিরোধিতা করছেন ?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ অবশ্যই বিরোধিতা করছি। শুধু আজকে না, যখন এসব নৈর্বক্তিক ও সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হচ্ছিল, তখন থেকেই বিরোধিতা করে আসছি। শুধু আমি নই, আমার মতো অনেকেই বিরোধিতা করে আসছেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আমাদের দেশে অনেকেরই কাছেই ইংলিশ মাধ্যমের শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন ?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ আমি মনে করি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংলিশ ভার্সন চালু করাটা বড় অন্যায় হয়েছে। এটা বাংলাদেশ বিরোধী কাজ। আমাদের ইংরেজি শিখতে হবে। কীভাবে ভালোভাবে ইংরেজী শিখা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে মূল শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে বিভক্ত করা হয়েছে। এটা জাতির জন্য ক্ষতিকর। যদিওবা বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বাংলা ভার্সনে পড়ে তথাপি ইংলিশ ভার্সনকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে ।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ তাহলে কী আপনি বিদেশী ভাষা শিখায় নিরুৎসাহিত করছেন ?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ মোটেই না। আমাদের বিদেশী ভাষা শিখা দরকার। পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান আহরণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, কূটনৈতিক সম্পর্কসহ সবকিছুতেই বিদেশী ভাষা শেখার প্রয়োজন। কিন্তু ইংলিশ ভার্সন দিয়ে আমাদের সেই শিক্ষা পরিপূর্ণ হবে না । বরং বাংলা ভার্সনেই যে ইংরেজি আছে তাকে আরো উন্নত করা দরকার। ব্রিটিশ আমলে বা পাকিস্তান আমলে যিনি ম্যাট্রিক পাশ করতেন, তিনি ভালো ইংরেজি বলতে, পড়তে ও লিখতে পারতেন। আর এখন অনেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করার পরও দুই লাইন শুদ্ধ করে বলতে ও লিখতে পারে না। ইংরেজি কেন, বাংলাটাও কী শুদ্ধভাবে লিখতে বা বলতে পারে? এখানেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ। আমাদের শিক্ষানীতি নতুনভাবে করতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ শিক্ষা ব্যবস্থার এই অনিয়ম ও ত্রুটির জন্য কারা দায়ী?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ আমাদের সংসদে, সচিবালয়ে, বড় বড় শিল্পপতি, আমলা, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা সবাই তাদের সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াশুনার জন্য পাঠিয়ে দেয়। তাদের দেশপ্রেমের অভাব থাকায় এমনটি হচ্ছে। ফলে তারা দেশের প্রতি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি কোন দায়বদ্ধতা অনুভব করে না। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থায় যেভাবে দুর্বল ইংরেজি শিখানো হয় বাস্তব জীবনে তা কোনো কাজ দিচ্ছে না। ফলে তার জানার পরিধি অল্পশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত লোকের মতো থেকে যাচ্ছে। এখানে যত বড় ডিগ্রী নেওয়া হোক না কেন তার প্রকৃত শিক্ষার অভাব থেকে যাচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি প্রকৃত শিক্ষা বলতে কি নীতি নৈতিকতার শিক্ষাকে বুঝাচ্ছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ প্রকৃত শিক্ষার একটা দিক হচ্ছে নীতি নৈতিকতা। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক ও অন্যসব পর্যায়ে পৌরবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো উচিত। এই পৌরবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাধ্যমে নীতি নৈতিকতা পড়ানো উচিত এবং সবপর্যায়ে নীতি নৈতিকতার অনুশীলন করা উচিত।
দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ হবে আগামীকাল
/ এআর /