‘বাম রাজনীতিতে খারাপ কিছু নেই, তবে ভুল আছে অনেক’
প্রকাশিত : ০৫:০৪ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:৩৯ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক। জীবনের একটি বড় অংশ অধ্যাপনায় কাটালেও লেখক, গবেষক, অনুবাদক, সমাজ বিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবেও তার অবদান অনন্য। নির্মোহ রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য সমসাময়িককালে যাদের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক অন্যতম।
প্রগতিপ্রয়াসী এ লেখকের লেখায় মূলত স্বদেশ ভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তা প্রাধান্য পায়। তার লেখায় থাকে অন্ধকার ভেদ করে আলোয় আসায় দিশা। সম্প্রতি রাষ্ট্রচিন্তা, শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজচিন্তা ও সংস্কৃতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় একুশে টেলিভিশন অনলাইনে। এতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, একুশে বইমেলা, ছাত্র রাজনীতি, ডাকসু নির্বাচনসহ নানা দিক উঠে এসেছে তার কথায়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ মেধাবী ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতিতে উৎসাহ হারাচ্ছে। দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার কী উপায় আছে বলে মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ এখন যেটাকে ছাত্ররাজনীতি বলা হচ্ছে সেটাতে রাজনীতি কোথায়? ছাত্রসুলভ বৈশিষ্ঠ্য কোথায়? ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর যা করেছে বা করছে সেখানে ছাত্র সমাজের অধিকার নিয়ে কখনো কি কিছু ছিল? জনকল্যাণমূলক কিছু কি ছিল? ছিল না। আবার বাম ছাত্র সংগঠনগুলো যা করছে সেখানে খারাপ কিছু নেই বটে, তবে ভুল আছে অনেক। এ অবস্থায় মেধাবী ছাত্ররা উৎসাহটা পাবে কীভাবে?
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ডাকসু নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এই দাবি বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ আজকের বাস্তবতায় ডাকসু নির্বাচন সম্ভব নয়। এখন জাতীয় রাজনীতি যে অবস্থায় আছে, ছাত্রসংগঠনগুলোর ভাবমূর্তিটা এমন-এই অবস্থায় ডাকসু নির্বাচন বা দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া সম্ভব নয়। এখন যদি নির্বাচন দেওয়া হয় এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠ করতে হয়, তাহলে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব দরকার হবে। তাহলে সেই নির্বাচনের কার্যকারিতা কী? সাধারণ ছাত্ররা কি স্বাধীন ভাবে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাবে? পাবে না। তাহলে সময়, অর্থ খরচ করে নির্বাচন না হওয়াই ভালো। যদি সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহী হয়, তাহলে দশ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে একটা সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। পুরনো সেই ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা দরকার। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ সম্প্রতি আদালতের রায় বাংলায় দেওয়ার জন্য একটা আওয়াজ উঠছে। আপনি ব্যপারটাকে কিভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ এ আওয়াজটা আরও আগে উঠার দরকার ছিল। আমরা এ দাবি ১৯৭২ সাল থেকে করে আসছি। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার দাবি নতুন নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা কমিটি নামে আমাদের একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠন থেকেও এসব দাবি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। লিফলেট বিতরনসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে করা হয়েছে। শুধু রায় কেন, আদালতের সব কার্যক্রম বাংলায় করা উচিত। এ ব্যাপারে এরশাদ সরকার একটা আদেশও জারি করেছিল।
আমাদের বিচারকদের, আইনজীবীদের ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের বাংলায় কাজ চালানোর মতো যোগ্যতা আছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং, উচ্চশিক্ষা এসব ক্ষেত্রেও বাংলাকে পরির্পূণ মর্যাদা দেওয়া উচিত। যদি আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়, তাহলে আদালতেও বাংলা চালু করতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ সম্প্রতি ইউনেস্কো বিলীয়মান ভাষা রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ বিলীয়মান মাতৃভাষা রক্ষা করা যাবে না। এটা সম্ভবও না। ইউনেস্কো বিলীয়মান মাতৃভাষা রক্ষার যে উদ্যেগ নিচ্ছে, তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূল জাতিসত্ত্বার ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশে এখনও যে ভাষাগুলো বিলীয়মান তা ওই ভাষাভাষী লোকেরা ব্যবহার করছে না। কারণ, তারা অনুধাবন করতে পারছে, এই ভাষা ব্যবহার করে তারা বা তাদের সন্তানরা বেশি দূর এগোতে পারবে না। আজকে বাংলাদেশে অনেক আদিবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন, উচ্চপদস্থ সরকারী- বেসরকারী কর্মকর্তা হচ্ছেন। যদি তারা তাদের আদিভাষা নিয়ে বসে থাকতেন, তাহলে তারা আজকে এই অবস্থানে আসতে পারতেন না। আমার মনে হয়, বিলীয়মান ভাষা নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠীর জীবনমান কীভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত। ইউনেস্কো সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কিছু মাথাবেচা বুদ্ধিজীবীকে এসব নিয়ে লেলিয়ে দিয়েছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বই মেলা চলছে । বইমেলা নিয়ে আপনার অভিব্যক্তি কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমার দৃষ্টিতে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বই মেলা, ফেব্রুয়ারী এসব আমাদের এখানে একটা বাড়তি আমেজ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের পক্ষে, বাংলাভাষার পক্ষে কিছু চর্চা হয়। হুজুগের জন্য হোক বা অন্য কারণেই হোক- এই উদ্দীপনা আমাদের চেতনার পক্ষে যায়। এখনও যে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে টিকে আছে, লেখকরা বাংলায় লিখছেন, চর্চা করছেন, তার পেছনে বইমেলার ভূমিকা আছে। অমর একুশকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী আমাদের যে কর্মসূচি তা সাম্রাজ্যবাদীদের বিপরিতে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখে। এটাকে আরও ভালো কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবা উচিত। প্রতিবছর ভালো ভালো লেখকদের কাছ থেকে ভালো বইগুলো বের করে প্রকাশ করা উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্যার, আপনি বিভিন্ন সময় বলে থাকেন, বাংলা একাডেমি ধীরে ধীরে তার স্বকীয়তা ও গতি হারাচ্ছে…
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তান আমলে যখন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন, তখন যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, যে কর্মসূচি স্থির করেছিলেন তা আমাদের জাতির জন্য মঙ্গলজনক ছিল। সে ধারাবাহিকতায় ৭০ ও ৮০’র দশকে কাজ করা হয়েছে। কিন্তু এর পরে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ একাডেমির দাবিটা বুঝতেই চান নি। সবাই শুধু চাকরিই করেছেন ও লুটপাট করেছেন। এখনও সে লুটপাট চলছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ স্যার, উনারা কী অপরাজনীতির শিকার হয়েছেন নাকি সৃজনশীলতার অভাব ছিল?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ আগে যারা বাংলা একাডেমির দায়িত্বে ছিলেন তারা কাজ করেছেন দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকে। তাদের মধ্যে দায়বদ্ধতা ছিল, মন্যুষত্ববোধ ছিল। কিন্তু ৯০ থেকে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল এবং এখনও ঘাটতি আছে। হাতেগোনা কয়েকজন যখন লুটপাট করে তখন সরকার ও রাষ্ট্রের উপর প্রভাব পড়ে ও পুরো দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি সাম্রাজ্যবাদকে দোষারোপ করছেন। আমাদের দেশে এখন বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর জয়জয়কার। দেশীয় চ্যানেলগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে, কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হকঃ কোনো কোনো কোন ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রন থাকা দরকার। যেমন: পশ্চিমবঙ্গের তারা চ্যানেল। মাঝে মধ্যে খেয়াল করি, তারা এমন কিছু বিজ্ঞাপন প্রচার করে যা মানুষের মনে অদৃষ্টবাদী ধারণার জন্ম দেবে। এজাতীয় চ্যানেলগুলো এখানে প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার দরকার ছিল। শুধু ভারতীয় চ্যানেল নয়; পাশ্চাত্যের এমন কিছু চ্যানেল আছে যা অত্যন্ত রুচি গর্হিত। পৃথিবীর অনেক দেশে আইন আছে, কোনো চ্যানেল প্রচার করা যাবে কোনো চ্যানেল প্রচার করা যাবে না তা নিয়ে নীতিমালা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন কোন নীতিমালা নেই।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতায় এনজিওগুলোর উপর বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। কেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : এনজিওগুলো দেশের সরকারের পরিধির বাইরে গিয়ে কাজ করে। তাদের আয়ের উৎস বিদেশী দাতা সংস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের আয়ের উৎস গোপন রাখে। এমনকি সরকারও তাদের আয়ের উৎসগুলো সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানতে পারে না। যাদের কাছ থেকে তারা অর্থ পায় তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই এদের উদ্দেশ্য। এমনিতে মুখে জনগণের জন্য ওদের দরদের অন্ত নাই। কিন্তু তাদের জন্যই দেশে রাজনীতি দাঁড়ায় না। রাষ্ট্র ব্যবস্থা শক্তিশালী হয় না। জনগণের প্রতিনিধিত্ব কার্যকর হয় না। ওরা সবসময় বিদেশী প্রভুদের তাঁবেদারী করতে ব্যস্ত থাকে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ কিন্তু পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে সিএসও (CSO) কাজ চালাচ্ছে।
আবুল কাশেম ফজলুল হকঃ হ্যাঁ, ভারতে CSO ( Civil Service Organigetion) কাজ করে। সম্প্রতি ভারত সরকার তাদের অনেক নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছে। তাদের কার্যকারিতাকে অনেক আইন কানুন দিয়ে খর্ব করা হয়েছে। এদেশেও NGO -র কার্যক্রম খর্ব করা উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। শুভকামনা আপনার জন্য।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জন্যও শুভকামনা।
/ এআর /