যোগব্যায়াম একটি পরিপূর্ণ মনোদৈহিক প্রক্রিয়া
আসিফ হাসান
প্রকাশিত : ১২:১০ এএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১০:৪৬ এএম, ১০ জুন ২০২১ বৃহস্পতিবার
ইয়োগা বা যোগব্যায়াম একটি শাস্ত্রীয় কৌশল, যা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুনি ঋষিরা তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং দীর্ঘজীবনের জন্য বিভিন্ন কলা-কৌশল আবিষ্কার বা আয়ত্ত করেন। প্রায় ৪০০ বছর আগে সর্বপ্রথম ঋষি পতঞ্জলি কিছু আসনের কথা বলেন এবং এগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ধীরে ধীরে এই কলাকৌশল ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর দিকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ‘পতঞ্জলিআসনা’ নামে গ্রন্থটি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আরো অনেকেই যোগব্যায়াম এর ওপর বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন।
ইয়োগা আসলে কী? কী এর রহস্য? এর উৎসই বা কোথায়? ‘ইয়োগা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘যুবক’ বা ‘যৌবন’। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় ‘যোগ’। যার অর্থ গ্রন্থিভূক্ত করা বা সমন্বয় সাধন করা। কীসের সমন্বয় সাধন? অর্থাৎ মানুষের দেহ ও মনের যৌবন ধরে রাখার কৌশল। ইয়োগা বা যোগব্যায়াম শুধু রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণই করে না; রোগ নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারত উপ-মহাদেশে এর উদ্ভাবন হলেও আজ সারা বিশ্বে ইয়োগা চর্চা বিকাশ ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি মানুষ ইয়োগা চর্চা করছেন। ইতিবাচক চিন্তা, প্রাণায়াম, নিউরোবিক জিম, মেডিটেশনের সমন্বয়ে ইয়োগার পরিপূর্ণ প্রয়োগ মানুষকে তার ভেতরের সুপ্ত অসীম শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। যোগব্যায়ামকে জীবনযাপনের অংশ করে তুলতে পারলে দেহ-মনের সুস্থতা ও শান্তি নিশ্চিত হবে।
ওজন কমানো, শক্তিশালী নমনীয় শরীর, উজ্জ্বল ত্বক, শান্ত মন, ভালো স্বাস্থ্য ইত্যাদি যা কিছু আমরা পেতে চাই সব কিছুর চাবি আছে যোগাসনে। এতে অনেক রকম শারীরিক সমস্যা যথা-উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করোনারি আর্টারি ব্লকের ইত্যাদি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ জীবন কাটানো সম্ভব। যোগ হল এক জীবনদর্শন, যোগ হল আত্মানুশাসন, যোগ হল এক জীবন পদ্ধতি। যোগ শুধু বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিই নয়, বরং যোগের প্রয়োগ ব্যাধিকে নির্মূল করে। এটি এক বিধাতা প্রদত্ত শুধু শরীরেরই নয়, পুরো মানসিক রোগেরও চিকিৎসা শাস্ত্র। যোগ অ্যালোপ্যাথির মতো কোনো লাক্ষণিক চিকিৎসা নয়, বরং রোগের মূল কারণকে নির্মূল করে আমাদের ভেতর থেকে সুস্থ করে তোলার এক উপায়। ইয়োগা বা যোগব্যায়াম সাধারণত তিনটি প্রধান কাঠামোর ওপর নির্মিত হয়। যেমন ব্যায়াম, শ্বাস এবং ধ্যান। ব্যায়াম ও বিভিন্ন আসনের মাধ্যমে শরীরকে নিজের আয়ত্তে আনার কৌশল জানা যায় এবং বিভিন্ন রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। এছাড়া যোগব্যায়াম স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য এবং শিথিলকরণ একটি পথ।
যোগাভ্যাস একটি নিয়মিত অভ্যাস। দু’দিন করে ছেড়ে দিলে হবে না, নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমেই এর সুফল পাওয়া সম্ভব। নিজে নিজে অভ্যাস না করে একজন ট্রেনারের অধীনে এগুলো অভ্যাস করা ভালো। প্রয়োজন বুঝে ট্রেইনার নির্দেশ দিয়ে থাকেন ঠিক কোন ধরনের আসনগুলো করা উচিত। এর পাশাপাশি নানারকম রোগ যোগাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, অ্যাজমা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাইগ্রেন, দুশ্চিন্তা এবং অবসাদ ইত্যাদি। বিশেষ কয়েকটি যোগাসন (প্রাণায়াম, মেডিটেশন, রিউরোবিক জিম ও আকুপ্রেসার) নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে এ ধরনের রোগগুলো থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে এবং অনেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কলস্টেরল ও অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রেখেছন।
প্রতিদিন আমাদের নানা ধরনের কাজের চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে ইয়োগা বা যোগব্যায়াম সেসব চাপ কমাতে সাহায্য করে। সব ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে, স্থিরচিত্তে বসে, শরীর ও মনের যত্ন নিতে শেখায় যোগব্যায়াম। মনের ভারসাম্য বজায় রাখতে যোগব্যায়ামের বিকল্প নেই। যোগব্যায়াম স্নায়ু শান্ত রাখতে সাহায্য করে এবং মানসিক চাপ দূর করে।
বেহিসাবিভাবে খেলে শরীরের ক্ষতি হয়। এমন খাদ্যাভ্যাস পরিহারে প্রয়োজন নিজের মনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা। যোগব্যায়াম মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সাহায্য করে। যারা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন, তারা মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সহজেই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যোগব্যায়াম। রাগ নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত আবেগ কিংবা কঠিন পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার মতো অভ্যাস গড়ে ওঠে যোগব্যায়ামের মাধ্যমে। হতাশা কাটানোর জন্য যোগব্যায়াম বেশ উপকারী। যোগব্যায়াম মাদকাসক্তি নিরাময়ে কার্যকর।
অন্যান্য ব্যায়ামের (Physical Exercise) সাথে যোগ-ব্যায়ামের (Yoga) পার্থক্য কোথায়? এ বিষয়ে বলা যায়, ব্যায়ামের উদ্দেশ্য যদি হয় দেহে অসাধারণ পুষ্টি ও অমিত শক্তিধারণ, তবে তা ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম দ্বারা সম্ভব নয়। আর যদি হয় ব্যায়ামের উদ্দেশ্য শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখা, দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা এবং জ্বরা-বার্ধক্যকে দূরে রাখা, তাহলে এ ক্ষেত্রে ইয়োগার জুড়ি নেই। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলতে যদি দেহের স্বাভাবিক গঠন, পুষ্টি ও শক্তিলাভ বোঝায়, এটা যোগ-ব্যায়াম দ্বারাই সম্ভব। এই সুস্থতার চাইতে স্ফীত পেশী ও অমিত শক্তিলাভ কি খুব গুরুত্বপূর্ণ?
দেহে শুধু মাংসপেশী (Muscles) অস্বাভাবিক স্ফীত হলে বা অসাধারণ শক্তি থাকলেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা তার অধিকারীকে সুস্থদেহী বলা যায় না। হতে পারেন এরা মাসলম্যান, কিন্তু এদের দেহে প্রায়ই অকালে জ্বরা-বার্ধক্য দেখা দেয় বা মৃত্যু হাতছানি দেয়। এর কারণ আর কিছুই না। দীর্ঘকাল যন্ত্র নিয়ে বা অতিরিক্ত শ্রমসাধ্য ব্যায়াম করলে শরীরের অত্যধিক শক্তি ক্ষয় হয়, দেহে অত্যধিক পৈশিক ক্রিয়া হয়। দেহে যতো বেশি পৈশিক ক্রিয়া হয়, শরীরে ততো বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। আর দেহে যতো বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ততো বেশি বৃদ্ধি পায়। কারণ হৃদযন্ত্র এই বিষাক্ত গ্যাস দেহ থেকে বের করে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। শারীর বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী দেহে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে অতিরিক্ত শ্রমসাধ্য কাজে বা দৌড়ানোর সময় আমাদের হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়, জোরে বা দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস বইতে থাকে। কেন এমন হয়? অত্যধিক পৈশিক ক্রিয়ার কারণে দেহে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। আর ঐ গ্যাস দেহ থেকে বের করে দিতে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস তার ক্ষমতা অনুযায়ী সচেষ্ট হয়ে উঠে। ঠিক একইভাবে শ্রমসাধ্য ব্যায়ামেও হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু দিনের পর দিন যদি হৃদযন্ত্রকে এইভাবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, তবে তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শ্রমসাধ্য ব্যায়ামে দেহের পেশীর পুষ্টি ও ওজন বাড়তে থাকায় দুর্বল হৃদযন্ত্র বিশাল দেহ চালানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং একদিন বিকল হয়ে পড়ে। মূলত ওই ব্যায়ামগুলো কেবল পেশীবৃদ্ধির দিকেই নজর দেয় বলে যোগ-ব্যায়াম ছাড়া অন্য কোন ব্যায়ামে দেহের সর্বাঙ্গীন ব্যায়াম হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইয়োগার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের স্নায়ুতন্ত্র (Nervous System) ও দেহযন্ত্রগুলোর স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষমতা ঠিক রাখা। স্নায়ুতন্ত্র দেহযন্ত্রকে পরিচালিত করে দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে খবরাখবর মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডে পৌঁছে দেয়, আবার সেখান থেকে আদেশ-নির্দেশ বহন করে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গকে চালিত করে। তাই দেহের কোন অংশের স্নায়ু যদি বিকল হয়ে যায়, দেহের সেই অংশটি অসাড় হয়ে পড়ে। আজ পর্যন্ত অন্য এমন কোনো ব্যায়াম আবিষ্কৃত হয় নি যার দ্বারা এই অত্যাবশ্যক স্নায়ুতন্ত্রের ব্যায়াম হয়। কুস্তি বা উগ্র যন্ত্র-ব্যায়ামে এই স্নায়ুজাল অনেক সময় বিকল হয়ে যায়, মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। কেননা এই সকল ব্যায়ামে আসলে দেহের শুধু কয়েকটি নির্দিষ্ট অংশের ব্যায়াম হয়।
জীবদেহের সকল যন্ত্রই তন্তুময়। এই তন্তু কোষ (Cell) দ্বারা গঠিত। কোষের গঠন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দরকার হয় নিয়মিত প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ এবং নালীহীন গ্রন্থিসমূহের প্রয়োজনমতো রস-নিঃসরণ। অন্যদিকে চাই দেহের বিষাক্ত ও অসার পদার্থের অপসারণ। কোষের গঠন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দরকার প্রোটিন, শর্করা ইত্যাদি নানাজাতীয় খাদ্য ও অক্সিজেন। এই অক্সিজেন আমরা প্রায় সবটুকুই পাই প্রশ্বাসের মাধ্যমে। সুতরাং দেহের পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্র যদি সবল ও সক্রিয় না থাকে, তাহলে দেহের কোষ, তন্তু বা পেশী কিছুই সুস্থ থাকতে পারে না।
শ্বাসযন্ত্র ও পরিপাক যন্ত্রগুলো দেহের দেহগহ্বরে অবস্থিত। দেহগহ্বর দু’ভাগে বিভক্ত। বক্ষ-গহ্বর ও উদর গহ্বর। হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস থাকে বক্ষ-গহ্বরে। এবং পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতি পরিপাক-যন্ত্রগুলো উদর গহ্বরে অবস্থিত। এই দুই গহ্বরের মাঝে ডায়াফ্রাম নামে একটি বিশেষ ধরনের শক্ত পেশীর পর্দা আছে। ফুসফুসের নিজের কোন কাজ করার ক্ষমতা নেই। ডায়াফ্রাম-এর পেশী, বক্ষ-প্রাচীর ও পেটের দেয়ালের পেশীর সাহায্যে তাকে কাজ করতে হয়। শ্বাস নেওয়ার সময় ডায়াফ্রাম উদর গহ্বরে নেমে যায় এবং চাপ দেয়। ফলে উদরস্থ যন্ত্রগুলি একটু নিচের দিকে চলে যায় এবং তলপেট উঁচু হয়ে উঠে। আবার পেট ও তলপেটের পেশী সঙ্কুচিত হলে এবং ডায়াফ্রামের পেশী প্রসারিত হলে শ্বাস বেরিয়ে যায়। পরিপাক-যন্ত্রগুলি যথাস্থানে ফিরে আসে। এইভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে পরিপাক-যন্ত্রগুলোও উঠানামা করে। ফলে স্বতঃক্রিয়ভাবে মৃদু মর্দন হয় বা ব্যায়াম হয়।
পরিপাক ক্রিয়া (Digestive System) সক্রিয় রাখতে হলে পেট ও তলপেটের পেশীগুলোর সঙ্কোচন ও প্রসারণ ক্ষমতা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। হজমশক্তিহীন ব্যক্তিদের তলপেটের পেশী শক্ত ও দুর্বল হয়ে যায়। ভুজঙ্গাসন, উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন, অর্ধ-চন্দ্রাসন প্রভৃতি আসনগুলো তলপেটের সম্মুখস্থ পেশীগুলো প্রসারিত ও পিঠের পেশীগুলো যেমন সঙ্কুচিত করে, তেমনি পদ-হস্তাসন, যোগমুদ্রা, পশ্চিমোত্থানাসন, জানুশিরাসন, হলাসন প্রভৃতি আসনগুলো পেটের পেশীগুলো সঙ্কুচিত ও পিঠের পেশীগুলো প্রসারিত করে। অর্ধ্বমৎস্যেন্দ্রাসন দ্বারা পেট ও পিঠের দু’পাশের পেশীর উত্তম ব্যায়াম হয়। শলভাসনের দ্বারা ডায়াফ্রাম-এর খুব ভালো ব্যায়াম হয়। আবার উড্ডীয়মান ও নোলি দ্বারা তলপেটের পেশীর আরো ভালো ব্যায়াম হয়। এবং প্রাণায়াম-এর মতো হৃদযন্ত্রের জন্য উপযুক্ত আর দ্বিতীয় ব্যায়াম নেই।
রক্ত সংবহনতন্ত্রের (Blood Circulatory System) মাধ্যমে আমাদের দেহের সর্বত্র রক্ত চলাচল করে এবং রক্ত থেকে দেহকোষগুলো প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে। এই রক্ত-সংবহনতন্ত্রের প্রধান যন্ত্র হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। তাছাড়া ধমনী (Artery), শিরা (Vein), জ্বালকশ্রেণী (Capillaries) এবং লসিকানালী (Lymphatics) এই তন্ত্রের অন্তর্গত। হৃৎপিণ্ড এক বিশেষ ধরনের পেশী দ্বারা নির্মিত। দেহে রক্ত চলাচল এই হৃৎপিণ্ডের পেশীর সব প্রসারণ ও সঙ্কোচন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। হলাসন, সর্বাঙ্গাসন, শলভাসন প্রভৃতি আসন দ্বারা হৃৎপিণ্ডের খুব ভালো ব্যায়াম হয়। সমস্ত দেহে রক্ত আনা-নেওয়া করতে ধমনী ও শিরার মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। ধমনীর যেমন দেহের উপরাংশে রক্ত পাঠাতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, তেমনি দেহের নিম্নাংশ থেকে রক্ত টেনে আনতে শিরার অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। আর এই মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয় হৃৎপিণ্ডকে। সর্বাঙ্গাসন, শীর্ষাসন প্রভৃতি আসনকালে হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে বিশ্রাম পায়। এই সব আসনে দেহের ঊর্ধ্বাংশে প্রচুর রক্ত সঞ্চালিত হয়।
অক্সিজেন দেহকোষের পুষ্টির অন্যতম উপাদান। অত্যাবশ্যক এই অক্সিজেনের প্রায় সবটাই আমরা শ্বসন প্রক্রিয়ায় (Respiratory System) ) বায়ু থেকে ফুসফুসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। সুতরাং ফুসফুসের পেশী ও বায়ুকোষের কর্মক্ষমতা কমে গেলে দেহে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে, দেহে দেহকোষ গঠন ও পুষ্টিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রতি ৩ মিনিটে একবার করে ২৪ ঘণ্টায় ৪৮০ বার দেহের সমস্ত রক্ত ফুসফুসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বা চালিত হয়। দেহের এমন একটি অত্যাবশ্যক যন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য শলভাসন, উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন প্রভৃতি আসন ও প্রাণায়াম ছাড়া আর কোন ব্যায়াম আজ পর্যন্ত পাওয়া নি।
দেহযন্ত্রগুলোর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দেহে বিপাক ক্রিয়ার (Metabolism) মাধ্যমে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও অসার পদার্থ দেহ থেকে বের করে দেওয়া অবশ্যই দরকার, এটা আগেই বলা হয়েছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক প্রভৃতি অ্যাসিড এবং মল-মূত্র প্রভৃতি অসার পদার্থ দেহে জমে থাকলে প্রথমে দেহে নানাপ্রকার ব্যাধির সৃষ্টি করে, পরে দেহের সব যন্ত্র বিকল করে দেয়। শেষ পরিণাম হয়তো অকালমৃত্যু। দেহযন্ত্র কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাসের সাহায্যে, কফ-পিত্তাদি মলের সঙ্গে অথবা মুখ দিয়ে, আর ইউরিক ও ইউরিয়া প্রভৃতি অ্যাসিড মুত্রের সঙ্গে দেহ থেকে বের করে দেয়। আর লবণজাতীয় বিষাক্ত পদার্থগুলো ঘর্মগ্রন্থির সাহায্যে ত্বকের মাধ্যমে ঘামের আকারে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। সুতরাং, এই সব নিঃসারক যন্ত্রগুলো সুস্থ ও সক্রিয় থাকলে দেহে উৎপন্ন এই সব বিষাক্ত ও অসার পদার্থ সহজেই দেহ থেকে বের হয়ে যেতে পারে। শ্বাস-যন্ত্রের কথা আগেই বলা আছে, দেহের বৃক্কদ্বয়, মূত্রাশয়, মলনালী প্রভৃতি সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে নোলি, উড্ডীয়মান ইত্যাদি যোগ-ব্যায়াম অতুলনীয়। অন্য কোনো ব্যায়ামে শরীরের এই সকল যন্ত্রের সঠিক ব্যায়াম হয় না।
মানব দেহের গ্রন্থিগুলো (Glands) প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। নালীযুক্ত ও নালীহীন। লালাগ্রন্থি, ঘর্মগ্রন্থী, অশ্রুগ্রাবী প্রভৃতি গ্রন্থিগুলো নালীযুক্ত গ্রন্থি। লালাগ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হয়ে খাদ্যের সঙ্গে মিশে খাদ্য পাকস্থলীতে পৌঁছুতে ও হজম হতে সাহায্য করে। ঘর্মগ্রন্থির সাহায্যে দেহ থেকে ঘাম বের হয়, আর অশ্রুগ্রাবী-গ্রন্থির জন্য চোখ দিয়ে জল পড়ে। থাইরয়েড, প্যারা-থাইরয়েড, পিটিউটারি, পিনিয়্যাল, এ্যাড্রিনাল প্রভৃতি গ্রন্থিগুলো নালীহীন গ্রন্থি। এইসব গ্রন্থি থেকে যে রস নিঃসৃত হয়, তাকে হরমোন বলে। হরমোন রক্তের সঙ্গে সরাসরি মিশে যায় এবং দেহের সকল ইন্দ্রিয় ও যন্ত্রের গঠন, পুষ্টি ও সক্রিয়তায় সাহায্য করে। একমাত্র যোগ-ব্যায়াম ছাড়া আজ পর্যন্ত এমন কোন ব্যায়াম আবিষ্কৃত হয়নি, যার দ্বারা গ্রন্থি সুস্থ ও সক্রিয় রাখা যায়।
ব্যায়াম বহু প্রকার আছে। এর দ্বারা হাত, পা, কাঁধ প্রভৃতি অংশের পেশীর খুব ভালো ব্যায়াম হয়। ঐ সব ব্যায়ামে দেহের সব পেশীর ব্যায়াম হয় কি? যোগ-ব্যায়াম ছাড়া অন্য কোন ব্যায়ামে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও অন্ত্রের পেশীর ব্যায়াম হয় না।
মেরুদণ্ড (Vertebral Column) আমাদের দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আছে। এরই স্থিতিস্থাপকতা ও সবলতার উপর দেহের যৌবনশক্তি ও কর্মক্ষমতা নির্ভর করে। পদ-হস্তাসন, জানুশিরাসন, পশ্চিমোত্থানাসন, অর্ধ-মৎস্যেন্দ্রাসন, অর্ধ-কুর্মাসন, অর্ধ-চন্দ্রাসন, শশঙ্গাসন, উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন, ভুজঙ্গাসন, হলাসন প্রভৃতি আসনগুলো মেরুদণ্ড সবল ও নমনীয় রাখতে সাহায্যে করে।
ধ্যানাসন, পদ্মাসন, সিদ্ধাসন প্রভৃতি আসন দ্বারা দেহে শারীরিক ব্যায়াম হয় না। কিন্তু দেহের ও মনের প্রভূত উপকার হয়। এইসব আসনকালে দেহে পেশীর ক্রিয়া হয় না বললেও চলে। ফলে দেহে অতি সামান্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ মন্থর হয়, ফলে তারাও কিছুটা বিশ্রাম পায়। মস্তিষ্ক ও দেহ ভারমুক্ত হয় ও বিশ্রাম পায়। মানসিক বিশ্রামে ও চিত্তশুদ্ধিতে আসনগুলো অদ্বিতীয়। তাছাড়া এই সব আসনে পেটের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর রক্ত চলাচল করে। ফলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।
উপরোক্ত দেহযন্ত্র এবং এর কাজ ও সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে শারীর তত্ত্ব (Anatomy and Physiology) আমাদেরকে সে সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু যে কথাটা না বললে নয়, উপরোক্ত যুক্তি উপস্থাপনে নিশ্চয়ই এখানে এটা বলার উদ্দেশ্য না যে অন্য কোন ব্যায়ামে আমাদের শরীর ও মনের কোন উপকার হয় না। নিশ্চয়ই হয়। তবে যোগ-ব্যায়ামের মতো সর্বাঙ্গীন উপকার অন্য কোন ব্যায়াম দ্বারা হয় না। বিশেষ করে দেহের অভ্যন্তরস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর জন্য এখনও যোগ-ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। তাই অতিশ্রমসাধ্য পেশীস্ফীতি অর্জন ও প্রদর্শনে হয়তো বা দুর্বার মোহ ও মাদকতা থাকতেই পারে, কিন্তু তা কি নির্ভরযোগ্য সুস্থতার বিকল্প হতে পারে?
ছবি: সম্পাদক, সপ্তাহিক আমাদের মানচিত্র
ফিটনেস: শারীরিকভাবে সুস্থ মানেই কিন্তু পুরোপুরি ফিট থাকা নয়। তখনই পুরোপুরি ফিট যখন মানসিক, আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও সামাজিকভাবেই আপনি সুস্থ থাকবেন। আপনার আবেগ থাকবে আপনার নিয়ন্ত্রণে। কথায় বলে, রোগের অনুপস্থিতি কিন্তু স্বাস্থ্য নয়, স্বাস্থ্য হল জীবনের বহুমুখী বহিঃপ্রকাশ। আপনি কতটা আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে জীবনকে উপভোগ করতে পারছেন সেটাই কিন্তু আপনরার স্বাস্থ্যের প্রমাণ। যোগাসন আপনাকে দেয় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য। আপনাকে সর্বদা ফিট রাখে শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সবভাবেই।
স্ট্রেস বা চাপ কমায়: সারা দিনের কাজের চাপে আমরা সবাই কমবেশি কাহিল হয়ে পড়ি। কাজশেষে বাড়ি ফেরার পর ক্লান্ত লাগে। অনেক সময়ই মেজাজ খারাপ থাকে। এর কারণ স্ট্রেস। শারীরিক এবং মানসিক দু’ভাবেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। যোগাসন এর থেকে মুক্তি দেয়। যোগাসন, প্রাণায়াম এবং ধ্যান করে স্ট্রেসকে দূরে রেখে প্রাণোচ্ছল জীবনযাপন করা সম্ভব।
মানসিক শান্তি: মানসিক শান্তি কে না চায়? মানসিক শান্তি পাওয়ার জন্য আমাদের কতই না প্রচেষ্টা। আমরা সুন্দর জায়ায় ঘুরতে যাই, ভালো গান শুনি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে সময় কাটাতে চাই তবে নিয়মিত মানসিক শান্তি পাওয়ার জন্য এত কিছু করার দরকার নেই। নিয়ম করে একটু যোগাসন, ধ্যান, প্রাণায়াম, নিউরোবিক ইত্যাদির মাধ্যমে মনোঃসংযোগ এবং মানসিক শান্তি উভয়ই বাড়ানো সম্ভব। অভ্যাস করে দেখুন, নিশ্চিত ফল পাবেন।
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: নিয়মিত যোগাভ্যাস আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। চারদিকে এখন এত দূষণ যে সবসময় নানারকম জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে এবং ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকা দরকার। যোগাসন রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে টিস্যু এবং পেশিকে শক্তি দেয়। শ্বেতকণিকাগুলোকে আরও উজ্জীবিত করে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের টেকনিক এবং ধ্যানও এতে সাহায্য করে।
এনার্জি বাড়ায়: দিনশেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বাড়ি ফেরার পর এনার্জি অবশিষ্ট থাকে না। মাত্র কয়েক মিনিটের যোগাভ্যাস কিন্তু সারা দিনের পরও এনার্জির জোগান দেবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ যোগাসন করলে কাজের ফাঁকেও ফ্রেশ আর এনার্জেটিক থাকা যাবে।
সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক: যোগাভ্যাস আমাদের কাছের মানুষ অর্থাৎ বাবা, মা, বন্ধু, স্বামী, স্ত্রী, আত্মীয়, পরিজন, অফিস কলিগ সবার সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো রাখতে সাহায্য করে। সুস্থ, রিল্যাক্সড মন সবসময় সম্পর্কের খুটিনাটিগুলোকে ভালো বুঝতে পারে। আর সম্পর্কের বিষয়টি যেহেতু খুব স্পর্শকাতর তাই অত্যন্ত সাবধানতার সাথে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত।
‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম’- এর পথ হলো সুপ্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধ্যাত্ম দর্শনের অন্তর্ভূক্ত যোগশাস্ত্রের একটি বিশেষ পথ। যাকে হঠযোগ বলা হয়। দেহকে গঠন করে, তাকে রোগমুক্ত করে, দীর্ঘায়ু করে তবেই যোগের কঠিন সাধনায় এগুতে হবে। নইলে ভঙ্গিল দেহ অসুস্থ কায়াযোগের নিত্য নতুন সম্পদ গ্রহণে সমর্থ হবে না। যোগফল লাভের পূর্বেই সে-দেহ বিনষ্ট হয়ে পড়বে। প্রাচীন যোগশাস্ত্রের সামগ্রিক ভাবনা এবং পরিকল্পনার একটা নির্দিষ্ট অংশ হলো এই হঠযোগ। যদিও এই সমৃদ্ধ দর্শনের উৎপত্তি ও লালন-পালন প্রাচীন ভারতেই, কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এসে এর ব্যাপক চর্চা এখন ছড়িয়ে গেছে দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা মানববিশ্বে। পার্থক্য কেবল এর আধ্যাত্মিক বীক্ষণের রূপান্তরটুকুতেই। যা বহুবিধ ধারায় বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সূত্র সমন্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পারফরমিং আর্ট বা মনোবীক্ষণিক পদ্ধতি হিসেবে একই সাথে অধ্যয়ন ও জনপ্রিয় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। জুডো, ক্যারাটে, সু, জুজুৎসু, কুংফু ইত্যাদি মার্শাল আর্ট বা সম্মোহন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন, হিলিং, কোয়াণ্টাম ম্যাথড, যোগব্যায়াম ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কতো কী পোশাকী নাম! মোদ্দা কথা এই সবকিছুরই চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মন নামক এক অদৃশ্য চেতনাগত অবস্থার অভাবনীয় ক্ষমতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে দৃশ্যমান মাধ্যম এই দেহটাকে ইচ্ছেখুশি আজ্ঞাবাহী করে তোলার অভূতপূর্ব অবস্থায় উন্নীত করা। আর তাই যন্ত্রসভ্যতার এক বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশকালের গণ্ডিহারা বিচ্যুত ও একাকী হয়ে যাওয়া মানবসত্ত্বার কাছে হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন আজ কার্যকর এক প্রায়োগিক দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে গোটা বিশ্বে দিনকে দিন অত্যন্ত আগ্রহের ও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।
ধারণা করা হচ্ছে ৫০০০ বছরেরও পূর্বে সিন্ধু নদীর তীরবর্তী ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতায় বা তারও আগে থেকে ইয়োগার অস্তিত্ব যে ছিলো তা প্রাপ্ত ইয়োগা-আসনের প্রত্ন-নিদর্শন থেকেই ধারণা করা হয়। এছাড়া প্রাচীন গ্রন্থ বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতার মতো শাস্ত্রীয় পুরাণগুলোতেও এর বহু উল্লেখ রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট সময়কাল চিহ্ণিত করা না গেলেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্ট শতকের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে ভারতীয় আর্যঋষি পতঞ্জলিকে আধুনিক যোগশাস্ত্রের জনক বলে ধরা হয়। একটি আদর্শ ও নৈতিক জীবন যাপন চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ জ্ঞানানুসন্ধানের নিহিত লক্ষ্য অর্জনে The Yoga Sutra of Patanjali বা `যোগসূত্রে`র ১৯৫টি সূত্র সংকলনের মাধ্যমে তিনি যোগশাস্ত্র সম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান পরিকল্পনা ও যাবতীয় ভাবনাগুলোকে কতকগুলো আবশ্যকীয় নীতিমালা বা গাইড লাইন আকারে প্রকাশ করেন। এগুলোই যোগসাধনার মৌলিক উৎস হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। যাকে পতঞ্জলি লক্ষ্যনিহিত সুষ্ঠু জীবন যাপন পদ্ধতির নিয়মাবলী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে ইয়োগা বা যোগসাধনা প্রচলিত বা উদ্দেশ্যহীন জাগতিক কর্মপ্রবাহে নিজেকে নিয়োজিত করতে প্রয়োজনীয় সামর্থ অর্জনের লক্ষ্যে গুরুগৃহে শুধুমাত্র কিছুক্ষণ আসন বা শরীরচর্চা করা নয়; বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ইয়োগা হচ্ছে নিহিত লক্ষ্য নিয়ে দেহ মন ও আত্মশক্তিকে উৎকর্ষতায় উন্নীত করার একটি কার্যকর মাধ্যম।
পতঞ্জলি এই যোগসাধনাকে আবার আটটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যেগুলোকে প্রাথমিক অবস্থায় পর্যায়ক্রমিক অনুশীলন এবং সাফল্য অর্জিত হলে পরে সমন্বিত চর্চার মাধ্যমে একটি উন্নত জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব বলে তিনি প্রস্তাব করেন। এই আটটি পর্যায়কে The eight limbs of Patanjali বা ‘পতঞ্জলির অষ্টঅঙ্গ যোগ’ বলা হয়। ত্বড়িৎ ফলপ্রাপ্তির তাড়াহুড়ো পদ্ধতি এগুলো নয়। নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ও দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই তা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হয়। পতঞ্জলির অষ্ট যোগাঙ্গগুলো হচ্ছে- ওঁম (Yama), নিয়ম (Niyama), আসন (Asan), প্রাণায়াম (Pranayama), প্রত্যাহার (Pratyahara ), ধারণ (Dharana ), ধ্যান (Dhyana) ও সমাধি (Samadhi)। বন্ধনী বেষ্টনিতে মূল সংস্কৃত নামগুলো ইংরেজি উচ্চারণে দেখানো হয়েছে।
পতঞ্জলির এই অষ্টাঙ্গ-যোগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শরীর ও মনের গূঢ় সম্পর্ক সূত্রগুলো। এবং তার উপর ভিত্তি করেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ নির্ভর মনোদৈহিক সম্পর্ক বিশ্লেষণী ইয়োগা সেণ্টার। বহু বিচিত্র পদ্ধতি ও নামে দেহমনের প্রাকৃতিক চিকিৎসার মাধ্যমে এক স্পিরিচ্যুয়াল আন্দোলনে সুস্থ থাকার প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে ব্যাপৃত করার চেষ্টা করছে এই ইয়োগা সেন্টারগুলো।
ওষুধ খেলেই রোগ নিরাময় হয় না, সঙ্গে কিছু নিয়ম-নিষেধও মানতে হয়। তেমনি শুধু যোগ-ব্যায়াম অভ্যাস করলেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায় না, কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় বৈ কি। নিয়মিত যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসে শরীর সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সাথে চাই পরিমিত ও যতদূর সম্ভব নিয়মিত আহার, বিশ্রাম, সংযম, নিয়মানুবর্তিতা, আত্মবিশ্বাস, অটুট মনোবল ও একাগ্রতা।
তথ্যসূত্র: সংগৃহীত
লেখক: সম্পাদক, সপ্তাহিক আমাদের মানচিত্র