‘ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ওপর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা চাপানো ঠিক হয়নি’
প্রকাশিত : ০৬:১৫ পিএম, ৩ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক ড. সোহেল রহমান
ড. সোহেল রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস, ভুল পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থার গলদসহ নানা অসঙ্গতি নিয়ে সোচ্চার এ শিক্ষাবিদ। সম্প্রতি প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠিত প্রশাসনিক কমিটিতেও রয়েছেন তিনি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. সোহেল রহমান বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার নানা সংকট এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার দিশা দিয়েছেন। শিক্ষা পদ্ধতিতে ব্যাপক সংস্কারের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেছেন, সেই সংস্কারটি গতানুগতিক পদ্ধতিতে নয়, হতে হবে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শক্রমে, সময় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে।
প্রথিতযশা এ শিক্ষাবিদ মনে করেন, অল্প বয়সেই শিশুদের উপর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। কারণ পৃথিবীর কোথাও এতো পাবলিক পরীক্ষা নেই। তার উপর প্রশ্নফাঁসের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রতিরোধ করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে শিশুরা শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের প্রতি একটা নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হবে। সোহেল রহমানে আরও মনে করেন, সৃজনশীল পদ্ধতি আধুনিক হলেও তা প্রয়োগ করার মত সক্ষমতা ও প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। যে কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করার আগে তা নিয়ে যেমন পরীক্ষা নীরিক্ষা দরকার তেমনি সক্ষমতার দিকটিও বিবেচনায় আনা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান। পাঠকদের উদ্দেশ্যে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ প্রশ্নফাঁসের জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে। আপনি এর সঙ্গে কতোটা একমত?
ড. সোহেল রহমানঃ এই অভিযোগ আংশিকভাবে সত্য। প্রশ্নফাঁস যে আগে হতো না, তা কিন্তু নয়। আমরা যখন পরীক্ষা দিয়েছি, আমাদের বড় ভাইরা যখন পরীক্ষা দিয়েছেন, আজ থেকে বিশ- পঁচিশ বছর আগে, তখনও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। কিন্তু তখন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এতোটা ছড়িয়ে পড়ত না। কিন্তু এখন যদি কেউ প্রশ্ন ফাঁস করে, তাহলে তা এক সেকেন্ডে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে পারছে। অর্থাৎ আগে প্রশ্নফাঁস নিয়ন্ত্রন করা যেতো এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশ্নফাঁসকারীকে হয়তো গ্রেফতার করা যায়, কিন্তু ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন আর ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। এই জায়গায় এসে প্রযুক্তি দায়ী।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তিতে আরো বেশি এগিয়ে। সেখানে কিন্তু প্রশ্নফাঁস হচ্ছে না। কেন?
ড. সোহেল রহমানঃ যেকোনো কারণেই হোক, উন্নত বিশ্বের কোথাও কখনো প্রশ্নফাঁসের মতো কোনো ঘটনা কখনো ঘটেছে কি না তা আমি শুনি নাই। খেয়াল করলে দেখবেন, পৃথিবীর কোথাও এতো বেশি পাবলিক পরীক্ষা নেই। অস্ট্রেলিয়াতে ক্লাস টুয়েলভ- এর আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা হয় না। ইংল্যান্ডে পরীক্ষা হলেও আমাদের মতো এত মহাযজ্ঞে হয় না। তাদের ছাত্রসংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক কম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে GPA - 5 পাওয়াটাকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। জীবনে ক্যারিয়ারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু উন্নত বিশ্বে GPA নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ বা মাতামাতি নেই। আমি যখন পড়ালেখার জন্য দেশের বাইরে গেলাম, তখন আমার মেয়ে সেখানে একটি স্কুলে পড়ত। তখন আমি আমার মেয়ের বন্ধুদের দেখেছি, তারা পড়াশুনা নিয়ে অত সিরিয়াস না। আমাদের দেশে একটা ছেলে GPA - 5 না পেলে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারে না। নিম্ন মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ না থাকলে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে এখানে জিপিএ -৫ পাওয়াটা একটা ছাত্রের জন্য জীবন মরন সমস্যা। একজন ছাত্রের অভিভাবক, আশপাশের আত্মীয়- স্বজন সবাই সবাই তাকে জিপিএ ৫ এর জন্য চাপে রাখে। ছাত্রটি দেখে তার আশপাশে তার যেসব প্রতিদ্বন্দ্বিরা আছে সবাই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে, তখন সেও উদগ্রীব হয়ে উঠে। এখানেই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। অর্থাৎ অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কী প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব?
ড. সোহেল রহমানঃ হ্যাঁ, সম্ভব বলেই আমি বিশ্বাস করি। আফ্রিকার দু`একটা দেশে প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা ঘটেছিল। তারা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সেটা রোধ করেছে। সে ধরণের সমাধানের কথা আমরাও ভাবছি। সেটি হচ্ছে একটা ‘সিকিউরড এনভেলাপড’ ব্যবস্থা। ‘ভেইকেল ট্রেকিং’ করা বা মুভমেন্ট ট্রেক করা। এরকম পদ্ধতি আফ্রিকার কয়েকটা দেশে আছে বলে আমি জানি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ গত সাত- আট বছর ধরেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এবার যেরকম মহামারী হয়েছে সেরকম না হলেও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। সাত- আট বছরেও তা রোধ করা গেলো না কেন?
ড. সোহেল রহমানঃ আমাদের যেটা সবচেয়ে বড় সমস্যা, সেটি হলো প্রশ্নফাঁসের ব্যপারটাকে আমরা কখনো `সমস্যা` হিসেবে স্বীকার করে নিইনি। যখন প্রশ্নফাঁস শুরু হয়, তখন যদি আমরা এর বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থান নিতাম, তাহলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে হোক বা পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন বরে হোক, আমরা প্রশ্নফাঁস রোধ করতে পারতাম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষকরাও জড়িত এমন অভিযোগও আসছে। এটা রোধ করার উপায় কী?
ড. সোহেল রহমানঃ এত অল্পবয়সে পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া আমাদের বাচ্চাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। আমরা যখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম, তখন বৃত্তি পরীক্ষা চালু ছিল। সেটাও আমাদের জন্য বড় চাপ ছিল। এখন সে বয়সে ছেলেমেয়েরা বড় মহাযজ্ঞে আয়োজিত পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হচ্ছে। তার উপর প্রশ্নফাঁসের ব্যপারটা তাদের মনে খুব বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। খুব অল্প বয়সেই তারা এমন একটি দুর্নীতিগ্রস্থ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছে। আমরা এখন শুনি, স্কুলের অভ্যন্তরীন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। এই কোমলমতি বাচ্চারা খুব ছোটবেলা থেকেই এমন নিন্দনীয় একটা কাজ সামনে দেখছে। তাদের ধারণা জন্মাচ্ছে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক ব্যপার। আমি অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা বলেছেন, ‘প্রশ্ন যখন ফাঁসেই হয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা দেখব না কেন?’
যেহেতু আমাদের পড়ালেখা সার্টিফিকেটমুখী, পরীক্ষার ফলাফলের উপর একজন ছাত্রের ভবিষ্যত নির্ভর করে, সেহেতু প্রশ্নফাঁস তাদের মধ্যে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করে। স্কুলগুলোতেও প্রশ্নফাঁসের ব্যপারে একটা প্রতিযোগিতা হয়। কেননা, যেই স্কুলের ফলাফল যতো ভাল, তার পরিচিতি ও সুনাম তত বেশি। এর ফলে শিক্ষকরাই প্রশ্নফাঁসে জড়াচ্ছেন। অর্থাৎ আমরা একটা নেতিবাচক আবহের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই বৃত্ত থেকে অমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনার দৃষ্টিতে আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থার সবচেয়ে বড় গলদ কোথায়?
ড. সোহেল রহমানঃ দেখুন, আমরা সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করলাম। এটা কিন্তু একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ব করার জন্য যে সক্ষমতা দরকার তা আমাদের শিক্ষকদের নেই। অল্প কিছু শিক্ষক হয়তো সেই সক্ষমতা রাখেন, কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষকই এই ব্যপারে কোন ধারনা রাখেন না। যারা ধারণা রাখেন তারা গাইড বই লিখে ফেলেন। অন্যরা গাইড বই নির্ভর হয়ে গেল। এর ফলে সৃজনশীলতার যে উদ্দেশ্য ছিল তা ব্যর্থ হয়ে গেলো। তাই, আমি বলতে চাই, যখন ভালো কিছু করতে চাইব, তখন সময় নিয়ে পরীক্ষা - নিরীক্ষা করে তারপর তা করবো।
আরেকটা উদাহরণ দিই। আইসিটি (তথ্য প্রযুক্তি) বিষয়টাকে স্কুল পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা হল। আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু দেখুন, কয়টা স্কুলে আইসিটি শিক্ষক আছে? দেশের অধিকাংশ স্কুলে আইসিটি শিক্ষক নাই। তাহলে তারা আইসিটি শেখাচ্ছে কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নাই। দরকার ছিল বিষয়টি চালু করার আগে সব স্কুলে শিক্ষক আছে এমন প্রস্তুতি নেওয়া। একদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে, বা ঠিক হয়ে যাক তা আমি বলছি না। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সংস্কার দরকার। তবে সেই সংস্কার করতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে। পশ্চিমা বিশ্ব নতুন কোনো পদ্ধতি যখন নিয়ে আসে, তারা সেটা নিয়ে অনেক স্টাডি করে। নানা ধরণের গবেষণা চালায়। আবার প্রয়োগ করার নির্দিষ্ট সময় পর সেটা যাচাই বাছাই করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে তা করা হয় না। এজন্যই আমরা পরীক্ষার ফলাফল ও পাশের হার দেখে খুশি হই। কিন্তু যখন দেখি, জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেল করছে, তখন আমাদের টনক নড়ে। আমরা আলোচনা- সমালোচনা করি। কিন্তু মজার বিষয় হলো এরপর আবার সেটা ভুলে যাই। আজ পর্যন্ত সেটা নিয়ে কোনো সমাধান হয়নি। তার মানে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেকগুলো ফাঁক আছে। আমাদের দরকার ফাঁকগুলো বের করে সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
ড. সোহেল রহমানঃ সচেতনতামূলক সাংবাদিকতায় একুশে টেলিভিশন অনলাইনের যাত্রা অব্যাহত থাকুক। শুভ কামনা।
/ এআর /