ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পর্ব-১

ফাঁস

অধ্যাপক হাসনাত হারুন

প্রকাশিত : ০৩:৪৯ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১০:১২ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৮ রবিবার

বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ ও লেখক অধ্যাপক হাসনাত হারুন রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস `ফাঁস`। আজ থেকে নিয়মিতভাবে উপন্যাসটি প্রকাশ করবে ইটিভি অনলাইন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর প্রথম পর্ব। 

# এক #

 

সবুজের চোখে চিত্রা ছিল সুন্দরী, রুপকথার রাজকন্যা, মোনালিসা, ক্লিওপ্রেট্টা। চিত্রা সবুজের একক সিদ্ধান্তের, একক পছন্দের বউ।

সবুজের বাবা মা চেয়েছে, মধ্যবিত্ত ঘরের কোন শিক্ষিত সুন্দরির সাথে সবুজের বিয়ে দিতে । পাত্রীও নির্বাচন করা হয়ে গেছে । বিএ পড়ুয়া মেয়ে, গায়ের রং হলুদ বাটা ফর্সা নয়, তবে চোখ নাক ঠোঁট চুল সব মিলিয়ে মেয়েটাকে এক কথায় সুন্দরীই বলা যায় ।

সবুজ মেয়েটাকে দেখে, মেয়ের বাবা মা সবাই শহরে থাকে । নিজের বাসায় নয়, সরকারী বাসায় ।মেয়ের বাবা একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসের রক্ষক হিসেবে কাজ করে । মেয়ের মা পড়ালেখা  জানা শিক্ষিত মহিলা ।মেয়ের ভাইবোনেরা সবাই স্কুল কলেজে পড়ে । সব মিলিয়ে পরিবারটি মার্জিত রুচিশীল মধ্যবিত্ত ঘর ।সবুজ সব শুনে, মেয়েটির একটি ছবিও সে নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখে । ছবির মেয়েটি সবুজের পছন্দ হয় ।

 দিন ক্ষন ঠিক করে, বেশ কিছু সময়, সবুজ আলাদা ঘরে মেয়েটার সাখে কথা বলে ।শহরে থাকলেও মেয়েটা একটু ভিন্ন আদলে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে । শিক্ষা সংস্কৃতিতে, সংযত ও শালনিতায় সে বিশ্বাসী । সাধারণ একটা স্যালোয়ার কামিজ পরে, মাথায় কাপড় টেনে মেয়েটা সবুজের সামনা সামনি চেয়ারে বসে । মুখে ঠোঁটে সামান্য রংয়ের প্রলেপ, চুল গুলো ঝুটিতে বদ্ধ হয়ে ওড়নার চাপে স্থিত ।মেয়েটার চেহেরাটাও কেমন লাজুক লাজুক ।সবুজের সামনে একাএকা বসে থাকতে তার একটু অস্বস্থিই লাগে । তবু মাথাটা হালকা একটু নিচু করে মেয়েটা চুপচাপ বসে থাকে ।

সবুজ মেয়েটার সাথে কথা বলে । মেয়েটা কথার উত্তর দেয়, মেপে মেপে ধীর শান্ত গলায় ।কথা বলার সময় মেয়েটার ঠোঁটের কোন, চোখের তারায়ও কোন ধরনের ঝিলিক খেলা করে না ।

 সবুজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু মেয়ে দেখেছে । বন্ধু হিসেবে, প্রেমিক হিসেবে অনেকের কাছাকাছি ও এসেছে ।গল্প হয়েছে, হাসি তামশা হয়েছে ।বলা যায় প্রতিটি মেয়ে ছিল রুপে রংয়ে নকঁশায় জীবন্ত প্রজাপতি । সারাক্ষণ উড়ুউড়ু মন, দেহ বল্লরীর ভাঁজে পোশাকের বাহারিত্ব, কথার ছলাকলা, চোখের চঞ্চলতা, ঠোঁটের কোনে  বিটকেলে হাসি, ক্ষনে ক্ষনে মুখাবয়বের পরিবর্তন, এই মেঘের ছায়া,এই আবার নবর্সূযের সতেজ রাঙা আলো । মেঘ জড়ানো খোলাচুল, পদ্ম কুসুম খোঁপা, সর্পদোলা লম্বা বেনী । কারো আবার কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে কত রং, বাহাদুরি সব কিসব কাট । সবুজ বইতে পড়ে, নিজ চোখে দেখে, মেয়েরা হচ্ছে বহতা নদী, পাহাড়িয়া ঝর্ণা, ওড়ন্ত প্রজাপতি,  ভোরের আকাশে স্নিগ্ধ বৃষ্টি ফোটা । কিন্তু,

সবুজ হিসেবটা মেলাতে পারে না । এই মেয়ে তো ওর মা চাচীদের মতো অনেকটা গেঁয়ো প্রকৃতির, বদ্ধ ডোবা, গতিহীন ঢেউহীন. বড় বেশি ঘোলাটে ।  

সবুজের অভিজ্ঞতায় বিবেচিত হয়, মেয়েটা বোকা, ক্ষেতমার্কা ।শিক্ষা থাকলেও আধুনিক স্যের্ন্দযবোধ,উন্মুক্ত সংস্কৃতি এসব বিষয়ে তার ছিটে ফোটা জ্ঞানও নেই ।তার চোখে চাহনিতে নেই একবিংশ শতকের উন্মুক্ত প্রেম, কথার ভেতর আহ্লাদি ঢেউ নেই, স্রোত নেই ।মেয়েটাকে তার খুব একটা পছন্দ হয় না ।

সবুজের মা গ্রামের মেয়ে ।ভদ্র আচরণ, লাজুক স্বভাব, চলনে বলনে ধীর স্থির স্বভাবের মেয়েকে ছেলের বউ করে ঘরে তুলে আনতে তার ইচ্ছেটা বেশি ।

সবুজ নিজেও বড়বেশি মাতৃভক্ত । মা বাবার সাথে নিজের বিয়ে নিয়ে বেশি কথা বলতে সবুজের একটু আধটু লজ্জা করছে । তার বড় দুইভাই তো চোখ মুখ বন্ধ করে পিতৃআজ্ঞা পালন করে গেছে । মেয়ে নয়, ছবি দেখেই নিজেদের ভবিষ্যত বেছে নিয়েছে, মা বাবার ইচ্ছেয় সম্মতি জানিয়েছে । তবুও তার ভাগ্য হাজার গুণ ভালো । তার সাথে বিয়ের মতো একটা লজ্জাকর বিষয় নিয়ে বাবা মা তার সাথে কথা বলছে ।  তাই মাতৃ- আজ্ঞায় আদিষ্ট হয়ে সবুজ মেয়েটাকে অপছন্দ করতে পারে না । আংটি বদলের মধ্যে দিয়ে সবুজের মা-বাবা বিয়ের সব পাকা কথা বলে আসে ।মাকে হ্যাঁ বলার পরেও সবুজের মনের ভেতর কিছু একটা সুঁইযের মত সারাক্ষন বিঁধতে থাকে।

কাছের বন্ধুদের সাথে মেয়েটার রুপ গুন নিয়ে আলোচনা করে । এক বন্ধুর পরামর্শে সবুজ মেয়েটার পেছনের বাড়ির খোঁজ খবরে মেতে ওঠে । খবর যা পাওয়া যায়, তাতে সবুজের মন বিগড়ে যায় ।

সবুজ তার মাকে বলে, ওই মেয়েকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

সবুজের বাবা বলে, কেন, কি অপরাধ মেয়েটার?

সবুজ তার বাবাকে কিছু বলে না । সবুজ জানে, বাবা মেয়ের বংশ লতিকার গল্প শুনতে চাইবে না ।শুনলেও তা বিবেচনার গুরুত্বে আনবে না । উল্টো, মানুষের জন্ম, মনুষ্যত্ব, তার শ্রেষ্টত্ব এসব বিষয়ে একগাদা নীতিকথা সবুজকে শুনিয়ে সবুজের মুখ বন্ধ করে দেবে ।

সবুজ ফিসফিসিয়ে তার মাকে গোয়েন্দা রিপোর্ট শুনায় । মেয়েটার জাত পরিচয় খুব একটা ভাল নয়, যদিও মেয়ের বাবা একটা সরকারী অফিসে ভালো চাকুরি করে ।মেয়ের দুই ভাই আছে, বড়টা ডাক্তারী পড়ে, ছোট টা এখনো স্কুলে পড়ছে । মেয়েটার আরো একটা বোন প্রাইমারিতে পড়ে । এই টুকুতে সবুজের আপত্তি ছিল না । সম্যসাটা হয়, মেয়ের চাচা জেঠাদের নিয়ে । তারা সবাই গ্রামেই থাকে, পড়ালেখাও বিশেস জানে না । জমি চাষ করে, একজন নাকি গ্রামে রাস্তার মোড়ে একটা চায়ের দোকান চালায় । আড্ডা, গালগল্পে তাদের দিন পার হয় ।

গর্বকরে বলার মতো কোন বংশ পরিচয়ও তাদের নেই ।গ্রামের বাড়িতে তাদের কোন ভালোমানের একটা ঘরও নেই, এমনকি মেয়ের বাবার একটা ঝুপড়িও নেই ।মেয়েটার বাবাকে গ্রামের লোকেরা কেউ ভালো করে চেনেও না ।

সবুজ ইচ্ছে করে একটা ভয়ঙ্কর মিথ্যাও তার মাকে বলে ।মা. আমি মেয়েটার এক নিকট আত্মীয়ের কাছে শুনেছি, মেয়েটা শারীরিক ভাবে অসুস্থ । সারা বছর নানা রোগে ভুগে ।

সবুজের বাবা সবুজকে বলে, মেয়ের পুর্ব পুরুষের এতো ইতিহাস আর মেয়ের বাবার ধন সম্পদ আমাদের জানার দরকার নেই ।আমাদের দরকার একটি সুন্দর মনের মেয়ে, । মেয়েটিকে আমি দেখেছি, কথাও বলেছি, বড়বেশি সহজ সরল ।

বাবা, কিন্তু, মেয়েটা যে অসুস্থ । একটা অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে আমি,

মেয়েটা অসুস্থ নয়, যে তোমাকে এই কথা বলেছে, সেই লোকটাই মানষিকভাবে অসুস্থ ।অসুস্থ মানষিকতার লোকদের কথায় কান দিও না, মেয়েটাকে বিয়ে করলে তোমার ভাল হবে, আমি বলছি, জীবনে তুমি সুখি হবে ।

সবুজের মা গ্রামের সহজ সরল মহিলা । নানা সংস্কার-কুসংস্কারে তার মন নানা সুতোয় শক্ত করে বাঁধা । ছেলের অমঙ্গলের কথা ভেবে সে বলে, বাবা, আমরা ওদেরকে পাকা কথা দিয়ে এসেছি ।বিয়ের একটা তারিখও হয়ে আছে । এই সময়ে যদি, ওরা এই দুঃসংবাদ পায়, তাহলে যে, মেয়েটার অভিশাপ লাগবে, মেয়ের মেয়ের মায়ের বুকফাটা শাপ আর চোখের জলে তোকে সারা জীবন হাবুডুবু খেতে হবে ।

সবুজ গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে । কোন কথা সে বলে না ।

সবুজের বড়ভাবী বলে, তুমি তো আমাকে বলেছিলে, কোন একটা মেয়ের সাথে তোমার কি একটা সম্পর্ক আছে, এই মেয়ে যদি তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে তোমার সেই পছন্দের মেয়েটাকে বিয়ে করে নাও ।

সবুজ হঠাৎ থমকে যায় । বাবা মায়ের সামনে এই ধরনের কথা বলতে সবুজ অভ্যস্ত নয় । গম্ভীর স্বরে বলে, ভাবী, তুমি যে কি বলো না ।আমি আবার,

সবুজের বাবা নিজ বিবেচনায় স্থান ত্যাগ করে । মা চুপটি করে বসে থাকে ।

মুখ লুকাতে হবে না । ডুবে ডুবে তো বহু জল খেলে । এবার প্রকাশ করো, তোমার ঐ মুক্তা না ফুক্তা, যাকে তুমি নিজের চেয়ে বেশি ভালবাস বলে আমাকে বার কয়েক বলেছিলে ।

সবুজ ভাবীকে চোখ ইশারায় কিছু একটা বলতে চায় । ভাবী তার ইশারা বুঝেও বুঝতে চায় না ।

মুক্তা সবুজের কততম প্রেম, সবুজ নিজেও তা জানে না। সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে সে বহু মেয়ের প্রেম নদে একা একা হাবুডুবু খেয়েছে ।কত মেয়েকে প্রেমপত্র দিয়েছে । কিন্তু একটা চিঠির উত্তরও আজ পযর্ন্ত সে পায় নি সবুজ ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হঠাৎ করে মুক্তা আসে। রুপে রংয়ে অতি সাধারণ একটা মেয়ে ।সবুজের সাথে একই বিভাগে পড়ে । সবুজের দুই বছরের জুনিয়র ।পরিচয়, আলাপ, তারপর বোধহয় একটু কাছাকাছি আসা, গল্প আড্ডা, রিক্সায় চড়ে বিকেলের হাওয়া খাওয়া,টং দোকানে দাঁড়িয়ে বসে চটপটি ফুসকা খাওয়া । ভালই চলছিল দিনের সাক্ষাৎ আর রাতের নির্ঘুম স্বপ্ন কল্পনা গুলো ।কিন্তু হঠাৎ করে কি যে হয়, সবুজ তার ভেতরের কষ্টটাকে কোন রকমে চাপা দেয় ।

সবুজ হাসে, বলে, ভাবী, সম্পর্ক টম্পর্ক আসলে ঐগুলো কিছু না, সময় পার করার জন্য এই বয়সের ছেলে মেয়েরা সবাই কম বেশি এক আধটু এসব করে থাকে । ওখানে প্রেম বা ভালবাসা খুব একটা বেশি থাকে না ।মেয়েটা আমার জুনিয়র । আসলে আমার নোট ফোট নিয়ে একটু আধটু নাড়াচাড়া করতে ভালবাসত, সেই সুবাদে আমরা দুইজন একটু কাছাকাছি ছিলাম । 

বড় ভাবী সবুজের কথায় আহত হয়, বলে, তুমি বড় বেশি দেমাগী, অত দেমাগ কিন্তু ভাল নয়, নিজের দেমাগের আগুনে একদিন নিজেই জ্বলে পুড়ে মরবে, এই আমি বলে রাখলাম । 

সবুজ মায়ের, ভাবীর এইসব কথা মানে না, বিশ্বাস করে না । সবুজ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, সবুজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক ছেলে । সে ভাল করে জানে, মা বাবার কথা মেনে নিলে তার জীবন গরুর গাড়ির চাকা হয়ে ধূলো কাদায় ঘুরপাক খাবে । জীবনের ভোগ বিলাস, সুখ আহ্লাদ, কিছুই হবে না ।সুখের আশায়, বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্নে বিভোর থেকে, সবুজ তার মা বাবার কোন আদেশ উপদেশ কানে তুলে না ।

সবুজ এই যুগের ছেলে । আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত,শিক্ষার ধাক্কায়  গ্রাম্য আচারে সংস্কার বিশ্বাসের প্রতিও তার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অনক কমে গেছে ।মায়ের মুখে অন্যের অভিশাপের কথা শুনে, সে মনে মনে হাসে ।সবুজ ভাল করেই জানে মা বাবার জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে চলতে গেলে, জীবন চাকা সবুজের ইচ্ছেয় চলবে না ।বর্হিবিশ্বের রুপসৌর্ন্দয, জাগতিক জীবনের বিত্ত বৈভব, সুখ আহ্লাদ, কিছুই  আর তার ইহজনমে হয়ে ওঠবে না ।

আর মনে মনে বলে, দেমাগ, ভাবী, দেমাগ তো থাকতে হবে। দেমাগ দেখানোর জন্য যোগ্যতা থাকতে হয়। সে যোগ্যতা সবুজ অর্জণ করেছে ।তোমাদের মতো গ্রামীন সংস্কার বিশ্বাসকে বেদবাক্য মানলে, জীবন আমার গরুর গাড়ি চাকা হয়ে এই মাটির কাঁদা ধুলায় গড়াগড়ি খাবে । সবুজ গরুর গাড়ির চাকা হয়ে বেঁচে থাকার চন্য এত কষ্টকরে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ শেষ করে নাই ।সবুজের জীবন লক্ষ্য, সুখের আশায়, ভোগবাদি জীবনের লালসায় সবুজ মা বাবার পছন্দের মেয়েকে স্পষ্ট ভাষায় না বলে দেয়।

সবুজের এই না ধ্বনিতে তার মা বাবা আহত হয় । মেয়ে বাড়ির লোকজন ছুটাছুটি করে। কেন, কি দোষে, কোন অপরাধে, একটা মেয়ের জীবনে এতবড় কলঙ্ককালিমা টিপ সবুজের পরিবার পরিয়ে দেয়।

উত্তরহীর মুখে সবুজের পরিবার মাথা নিচু করে, মেয়ে বাড়ির লোকজনদের নানা কূটকাটব্য শুনে যায়। 

(চলবে)

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ কুমিল্লা ও রংপুর ক্যাডেট কলেজ।