ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটাবে ৩ পর্যটন পার্ক

ইয়াসির আরাফাত রিপন

প্রকাশিত : ০৬:৩৪ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০১:৫৩ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

বছরে অতিরিক্ত দুই বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করতে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এ ট্যুরিজম পার্কগুলো স্থাপনের ফলে আগামী ৮ বছরের মধ্যে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ অবস্থান বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের ১২৭ থেকে দুই ডিজিটের ঘরে চলে আসবে। এ তিনটি পর্যটন পার্ক বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করছেন সংশিষ্টরা।

ইতোমধ্যে বেজা কর্তৃক নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। আর সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। অপরদিকে সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনেরর উদ্দেশ্যে বেজা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় করছে। তাছাড়া সেখানে বসবাসরত ৩৩৩টি পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ তিন চ্যুরিজম পার্ক স্থাপনে অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে বেজা।

এক নজরে তিনটি পার্ক

নাফ ট্যুরিজম পার্ক

পর্যটন নগরী কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদীর একটি মনোরম দ্বীপ জালিয়ার দ্বীপ। এই দ্বীপের মোট ২৯১ একর জায়গার মধ্যে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে উঠছে। পাহাড় আর নদীর বৈচিত্র্যময় দৃশ্য, নির্মল বাতাস, সুউচ্চ পাহাড়ের সৌন্দর্য দ্বীপটিকে অনন্য সাধারণ রূপ দিয়েছে।

নাফ পর্যটন পার্ক হবে দেশের প্রথম বিশেষ পর্যটন পার্ক। পার্কটি সফলভাবে সম্পন্ন হলে পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। বেজা বলছে, এ পার্কটি প্রতিষ্ঠত হলে  এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

নাফ ট্যুরিজম পার্কে যা থাকবে:

বেজা বলছে, দৃষ্টিনন্দন এ পার্কটিতে পর্যটকদের সুবিধার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হবে। হোটেল, কটেজ, ইকো-ট্যুরিজম, ৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার ক্যাবল নেটওয়ার্ক, ভাসমান জেটি, ঝুলন্ত সেতু, শিশু পার্ক, ইকো কচেজ, ওসানোরিয়াম/মেরিন অ্যাকুয়ারিয়মের ব্যবস্থা রাখা হবে। এছাড়া আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ বিনোদনের সব সুবিধার ব্যবস্থাও থাকবে।

পুরোদমে চলছে পার্ক উন্নয়ন কাজ:

বেজা কর্তৃপক্ষ জানায়, নাফ পর্যটন পার্কে ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ডিজাইন প্রস্তুতকরণের কাঝ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর সম্ভাব্য উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। ১৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে জেটি নির্মাণের জন্য দরপত্র প্রস্তুতের কাজ চলছে। ভূমি উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর সম্ভাব্য উন্নয়ন কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পার্কটিতে ২৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বাধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।

সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক:

সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক দেশের সর্ব দক্ষিণে টেকনাফ উপজেলার সাগর তীরে অবস্থিত। মোট  এক হাজার ৪১ একর জায়গার উপর পার্কটি গড়ে উঠছে। পাহাড় ও সাগরের বৈচিত্র্যময় দৃশ্য, সুদীর্ঘ বালুকাময় সৈকত এ স্থানকে সৌন্দয্যের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটি বিনোদনপ্রেমীদের অন্যতম আর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে বলে মনে করছেন পার্ক নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা। আর পার্কটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এখানে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৭০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছে বেজা কর্তৃপক্ষ।

 যা থাকছে পার্কটিতে:

সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটিতে পাঁচ তারকা হোটেল, ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুরিয়াম, সি-ক্রুজ, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, ওসানেরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা বিনোদনের সুবিধা রাখা হবে।

সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক:

কক্সবাজারের সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কটি মহেশখালি উপজেলার সোনাদিয়া, বিজয় একাত্তর ও সমুদ্র বিলাস মৌজায় অবস্থিত। পার্কটি মোট ৯ হাজার ৪৬৭ একর জায়গার উপর গড়ে উঠছে। পার্কটি নির্মাণের জন্য বেজা কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সমীক্ষার কাজ হাতে নিয়েছে। পার্কটি পরিবেশ বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিকভাবে মোট জমির ৩০ শতাংশ  জায়গা ব্যবহাররের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যাতে পরিবেশের উপর কোন প্রভাব না পড়ে।

বেজা অভিযোগ করে বলছে, এখানে অবৈধভাবে বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দারা অবৈধভাবে ঘের নির্মাণ করে মাছ চাষ করছেন। এটা পরিবেশে ও জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি স্বরুপ। ইকো-ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণের ফলে একদিকে যেমন অবৈধভাবে ঘের পরিচালনা বন্ধ হবে অন্যদিকে পরিকল্পিত ট্যুরিজমের ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সুযোগ তৈরি হবে।

সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কের বৈশিষ্ট্য:

পার্কের মোট বালুকাময় সমুদ্র তীরের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ২ কিলোমিটার। কক্সবাজারের ২ দশমিক ৬ কিলোমিটারের মধ্যে পার্কটির অবস্থান।

এখানে থাকছে ঝাউবনের মনমাতানো ঝিরিঝিরি শব্দ, দৃষ্টি নন্দন লাল কাঁকড়া, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, শুটকি মাছ প্রক্রিয়াকরণ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ।

সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড় তুলতে বেজার প্রকল্প:

এখানে বসবাসরত ৩৩৩টি পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে বেজা কর্তৃপক্ষ। সোনাদিয়া দ্বীপে নতুন করে যাতে মৎস্যঘের ও অবৈধভাবে বসতি গড়ে না ওঠে সে বিষয়ে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। সোনাদিয়া দ্বীপে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন স্থাপনে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রয়োজনী কাজ করছে। দ্বীপ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্বীপের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ড একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। সেখানে তাদের স্থাপনার জন্য জমি বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দ্বীপের জীব-বৈচিত্র বজায় রেখে পরিবেশ-বান্ধব ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তুলতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে। দ্বীপের উপকূলীয় অংশে ঝাউবন সৃজনের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া দ্বীপের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ টার্মিনাল স্থাপনে কাজ করছে। সুপেয় পানি নিশ্চিতকল্পে কাজ করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।

এছাড়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কে কয়েকটি অত্যাধুনিক আবাসিক কটেজ ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও অবৈধ দখল বন্ধে পুলিশ ক্যাম্প ও সশস্ত্র আনসার নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী ইটিভি অনলাইনকে বলেন, আমাদের দেশে মতো সর্ব বৃহৎ সমুদ্র সৈকত রয়েছে, সুন্দরবন, পর্বত ও নদী পৃথিবীর কম দেশেই আছে। কিন্তু দু:খের বিষয় আমাদের দেশে বিদেশি পর্যটক আসে না বললেই চলে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও বিপুল সংখ্যক পর্যটক রয়েছে। বছরে যেখানে ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ এদিক-সেদিক যায়। আবার বাংলাদেশ থেকে শুধু ভারতেই ২০ লাখ পর্যটক ভ্রমণে যায়। এই পরিস্থিতে বিদেশি পর্যটকদের উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা দরকার। আমরা সেজন্য অনেকগুলো এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম পার্ক করছি। এ বিষযে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে আমরা একটি সেমিনারও করেছি।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আরও বলেন, কক্সবাজারে আমরা বড় ধরনের ট্যুরিজম সিটির কাজে হাত দিয়েছি। মাস্টার প্লানও করা হয়েছে। এবং সমুদ্র থেকে যাতে সেগুলোকে রক্ষা করা যায় এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও (ফিজিবিলিটি স্টাডি) চলছে। তবে ট্যুরিজম সিটিটা ২ বছর পর শুরু হবে। আর ট্যুরিজম পার্ক যেটা কক্সবাজারের নাফ নদীতে এবং সাবরাং-এ। এগুলোর অল রেডি কাজ চলছে। সেখানে অনেক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি পর্যটন সেক্টরে গুণগত মানে বড় পরিবর্তন দেখতে পারবেন।

আর/টিকে