বিশ্ববাজারে পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে: রাশেদুল করিম
প্রকাশিত : ০৭:১০ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৯:১৬ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৮ রবিবার
বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাটের সুদিন সগৌরবে ফিরে আসছে। দেশীয় বাজার বিকাশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও তাৎপর্যতায় অভ্যন্তরীণ পর্যায়েও বাড়ছে পাটের ব্যবহার। পাটের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত জাতীয় পাট দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আগামী ৬ মার্চ এ দিবসের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘সোনালী আশেঁর সোনার দেশ, পাট পণ্যের বাংলাদেশ’- এ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার জাতীয় পাট দিবস উদযাপন করা হবে।
দেশের গৌরবের অধ্যায় জুড়ে থাকা এ পাটের বহুমুখী পণ্যের উৎপাদন, ব্যবহার, বিশ্ব বাজারে রফতানি পরিস্থিতিসহ খাত সংশ্লিষ্ট সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখী হয় পাটপণ্য উৎপাদনকারী সমিতির আহ্বায়ক রাশেদুল করিম মুন্নার। গত বছর পাট দিবসে যিনি শ্রেষ্ঠ বহুমুখী পাটপণ্য রফতানিকারক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। তার কথায় পাট পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি উঠে এসেছে এর সম্ভাবনার দিকগুলো। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাট। তাই এ পাটের চাহিদা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তবে পাটকে কৃষি পণ্য হিসেবে ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। এ মুহুর্তে পাট খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাকে কৃষি পণ্য হিসেবে ঘোষণা না দেওয়া। ঘোষনাটি হলে খাত সংশ্লিষ্টরা উপকৃত হবেন। দেশে পাটের চাষ, পাট পণ্যের উৎপাদন ও রফতানি সবই বহুগুণে বেড়ে যাবে। তখন পাট উৎপাদন ও রফতানিতে শীর্ষ দেশ হবে বাংলাদেশ। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বাংলাদেশের সোনালী পণ্য হিসেবে পাটের আবেদন ক্রমশই বাড়ছে। বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে আপনি গত বছর পাট দিবসে পুরস্কৃত হয়েছেন। কি কি পাটপণ্য আমাদের দেশে এখন তৈরি হচ্ছে?
রাশেদুল করিম: দেশে বর্তমানে পাট দিয়ে মোটামুটি সব ধরনের পণ্যই উৎপাদন হচ্ছে। নিজ উদ্যোগে অথবা সরকারি-বেসরকারি কিছু সংস্থা বা এসএমই’র মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েও উত্তরাঞ্চলের নারীরা নানা রকম পণ্য উৎপাদন করছে। বস্ত্র, সুতা, কার্পেটের মতো পণ্যের বাইরেও সোনালি আঁশ পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক সব পণ্য। ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক, শাড়ি, জুতা, ব্যাগ, টেবিল ম্যাটের মতো দরকারি পণ্য ছাড়াও বানানো হচ্ছে পাটের তৈরি কাগজ, পাটের ভিজিটিং কার্ড, অফিস আইটেম, ফাইল ফোল্ডার, ব্যাগ, কার্ড হোল্ডার, পেপার ফোল্ডার, ফাইলবক্স, টিস্যুবক্স, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, স্কুল ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, লেডিস পার্স, শপিং ব্যাগ, মোবাইল-পাসপোর্ট ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, গ্রোসারি ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, স্যুটকেস, ব্রিফকেস, মানিব্যাগসহ নোটবুক, ফটো অ্যালবাম, ল্যাম্পশেড ও পুতুলসহ দৃষ্টিনন্দন শোপিস তৈরি করছে তারা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাটজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে কতগুলো প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে?
রাশেদুল করিম: দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে ৭০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান পাটজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। পাটের গতানুগতিক ব্যবহারের ধারণা থেকে বেরিয়ে পাটজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছে ১০টি মাঝারি ও ৩৮ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। সরকারের পাটের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের পাশাপাশি নতুন ব্যবসার পরিকল্পনাতেও ঠাঁই করে নিয়েছে সোনালি এ আঁশ।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার কি পরিমান আমরা রফতানি করতে পারছি?
রাশেদুল করিম: অনেক বছর ধরেই আমরা বছরে ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করছি। বস্তা, রশি, চট ও কার্পেটের মতো প্রথাগত পাটপণ্যের রফতানি তেমন একটা বাড়ছে না। এগুলোর প্রতি টনের দাম সর্বোচ্চ ৬০০ ডলার। কিন্তু গত ছয় বছরে আমাদের বহুমুখী পাটপণ্যের রফতানি আয় দ্বিগুণ হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন করে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৩ দশমিক ১০ কোটি ডলার আয় করে। এতে প্রবৃদ্ধির হার ১৩ দশশিক ৯৪ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি প্রতি বছরই বাড়ছে। এইচএনএম, ওয়ালমার্টের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পাট থেকে তৈরি কাপড় ও তৈজস সামগ্রী আমদানি শুরু করেছে। বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে এই খাত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা কেন আমরা কাজে লাগাতে পারছি না?
রাশেদুল করিম: বিশ্ব বাজারের চাহিদা মোতাবেক পণ্য তৈরি করার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। অনেক সময় মানসম্মত পণ্য তৈরি করলেও আমরা বাজারজাত করতে পারি না দামের কারণে। যদি ফিনিশিং দিয়ে পণ্য তৈরি করতে পারি, তাহলে আমাদের পণ্য বিদেশের বাজারে বিক্রি হবে। দামও বেশি পাব। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বড় পাটকলগুলোতেও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। যার কারণে আমরা রফতানির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কাজে লাগাতে পারছি না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পৃথিবীর কয়টি দেশে বাংলাদেশের পাট পণ্যের চাহিদা আছে? রফতানির সম্ভাবনাময় দেশ কোনগুলো?
রাশেদুল করিম: ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৫টি দেশের বাইরেও কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ ১২০টি দেশে এসব পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। পাট পণ্যের সম্ভাবনাময় বাজার হচ্ছে আফ্রিকা। এসব দেশে পাটজাত শপিং ব্যাগ রফতানির ক্ষেত্রে ভালো সুযোগ রয়েছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাট খাতের উন্নয়নে এ মুহুর্তে কী প্রতিবন্ধকতা দেখছেন?
রাশেদুল করিম: পাট খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা ও সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়া। অর্থাৎ আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী এ পাট কৃষি পণ্য এটা সবাই জানে। কিন্তু দু:খের বিষয় আজও এ পণ্যকে কৃষি পণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এ ঘোষণা দিতে পাটমন্ত্রণালয় আগ্রহী হলেও কৃষি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তা আটকে যায়। যার কারণে এটা কৃষি পণ্য হিসেবে ঘোষণা পাচ্ছে না। এ ঘোষণা দেওয়া হলে খাত সংশ্লিষ্টরা কৃষি পণ্যের যে সুযোগ পায়, সেগুলো পেত। চাষীরা পাট চাষে আগ্রহী হতো।পাটের উৎপাদন বেড়ে যেত। তখন খাত সংশ্লিষ্ট অন্যরাও তার সুফল পেত। সর্বশেষ দেখা যেত দেশের পাটের রফতানি আয় অনেকগুণ বেড়ে গেছে। পাট উৎপাদন ও রফতানিতে দেশ শীর্ষে অবস্থান করছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা সরকারের কৃষি পণ্যের সুযোগ-সুবিধা যেমন পায় না। তেমন ব্যাংকগুলো থেকেও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তাও পায় না। তাছাড়া আমাদের কারখানার ম্যাশিনগুলোও অনেক আগের। প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে দরকার আধুনিক যন্ত্রপাতি। সে ক্ষেত্রেও সরকারের সহযোগিতা দরকার।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আমরা যারা এই খাতে বিনিয়োগ করছি, তারা মূলত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করেছি। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়েছি। এখনো আমাদের দামি পাটপণ্য উৎপাদনের কোনো ডিজাইন সেন্টার তৈরি হয়নি। ভারতে তিনটি সরকারি সংস্থা আছে, যারা পাটপণ্য নিয়ে গবেষণা ও নকশা তৈরি করে। ফলে আমাদের চেয়ে খারাপ মানের পাট উৎপাদন করেও বিশ্ববাজার তাদের দখলে। আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ মানের পাট উৎপাদন করলেও বিশ্ববাজারের সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাটের সুদিন আবার ফিরে এসেছে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি এ খাত নিয়ে কী সম্ভাবনা দেখছেন?
রাশেদুল করিম: আমি নতুন একধরনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। ইউরোপের ২৮টি দেশের শপিং মলগুলোতে আগে ফ্রি পলিথিন ব্যাগ দেওয়া হতো। এখন এর জন্য তারা অর্থ নিচ্ছে। সেখানে পরিবেশবান্ধব তন্তু দিয়ে তৈরি ব্যাগ দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা আছে। এর বড় অংশ ইউরোপে। বিশ্বে প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের চাহিদা বাড়ছে। এই বাজারের ২ শতাংশ যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলে দেশের পাট খাতের চেহারা বদলে যাবে। পাটের উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।
আরকে// এআর