ওষুধের দামের কারসাজি আর বিবেকের বিষন্নতা
ইমদাদ হক
প্রকাশিত : ১১:৫৯ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১০:০৬ এএম, ৮ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার
দৃশ্যপট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ওষুধের দোকান। সাথে এই মেডিক্যালেরই অনারারি মেডিকেল অফিসার রাফি মোহাম্মদ আদনান। দোকানে সে একটি হেপাটাইটিস বি এর এনজেরিক্স বি ভ্যাক্সিন চাইলো। দোকানদার দুটি ভ্যাক্সিনের দাম চাইলো ৩ হাজার ৭০০ টাকা। রাফির আক্কেলগুড়ুম অবস্থা!
- প্রকৃত দাম দাম ৫৫০ টাকা। কেউ লাভ করতে চাইলে দশ বিশ টাকা বেশি রাখতে পারে। কিন্তু আপনি কিভাবে তিনগুণেরও বেশি দাম চান? এক লাফে ১৮৫০ টাকা!! কেন?
- সাপ্লাই কম! কমন উত্তর। নিরুত্তাপ উত্তর।
কাজে লাগলো না রাফির ডাক্তার পরিচয়। অথবা গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে আমার পরিচিতিও। বরং, একটি তাচ্ছিল্যের হাসির রেখাই দেখা গেলো দোকানদার ছেলেটির মুখে।
রাফি জানালো, বহুল প্রচলিত ও নিত্য দরকারী একটি ওষুধ পটাশিয়াম সিরাপ। এর স্বাভাবিক দাম ২৫ টাকা। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের ও আশেপাশের ওষুধের দোকানগুলোতে সুযোগ মতো দাম হাকায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। কখনো বা এরও বেশি। এদের প্রতারণার শিকার হয় সহজ-সরল মানুষ। রাফির গায়ে অ্যাপ্রোন ছিল না। আগ্রহ নিয়ে ওর সাথে ঢুঁ মারলাম আরো কয়েকটি দোকানে। রিফ্রেশ টিয়ার আই ড্রপের দাম চাইলো দোকানী সাড়ে চারশ টাকা। অথচ এটা প্রকৃত দাম আড়াইশ টাকা। রাফি জানালো, গ্যাস, সর্দি-জ্বর, বা বমির ওষুধের নাম ও দাম কম বেশি সবাই জানে। এগুলোতে তাই হাত কচমচ করেও প্রকৃত মূল্যের কাছাকাছিই নিতে বাধ্য হয় ওষুধের দোকানীরা। কিন্তু, যেগুলো দুর্লভ, অপরিচিত, সেগুলোর ব্যাপারে কশাইয়ের মতোই দাম হাঁকায়। আর খেটে খাওয়া মানুষেরা বিপদে পড়ে সবচেয়ে বেশি। রাতের বেলাতে বেশিরভাগ ওষুধের দাম হয়ে যায় দ্বিগুণ। আর জরুরি প্রয়োজনে তো কথাই নেই, তিন-চার গুণ বেশি দিয়েও পাওয়া যায় না কাক্সিক্ষত ওষুধটি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নতুন বিল্ডিং এর সামনের মসজিদ থেকে শুরু করে ইমার্জেন্সি গেট পর্যন্ত এরকম অস্বাভাবিক বেশি আগুনে দামে ওষুধ বিক্রি করা হয়। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এসব দোকানে কখনোই ওষুধের মেমো করা হয় না। ক্রেতারা চাইলেও তারা মুখে বা ক্যালকুলেটরে হিসেব করেই দাম রাখে। বা নিজেরা মন গড়া হিসেব করে প্যাড খাতায়। ‘কষ্ট লাগে দেখে, একটা মানুষ না জেনে বুঝে কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে! পকেট মারিং এর চেয়ে কম নয়!’- দীর্ঘশ্বাস বের হয় রাফির।
চিকিৎসকদের নানা দোষ-ত্রুটি চোখে ভাসে আমাদের। চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতায় বেশিরভাগ সময়ই আমরা চিকিৎসকদের গোষ্ঠী উদ্ধার করি। অতিরিক্ত ফি আদায়, কম সময়ে নাম মাত্র দেখে বড় বিল বানানো, রোগীর অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেওয়া, সরকারি হাসপাতালে দায়িত্বে অবহেলা... নানা অভিযোগই চিকিৎসকদের বেশিরভাগেরই বিরুদ্ধে। কিন্তু কেউ কেউ, পরিবার-পরিজন, সামাজিক অনুষ্ঠান, ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে সহজেই অবহেলা করতে পারেন। খুঁটেখুঁটে রোগীর সমস্যা সনাক্তকরণেই এসব চিকিৎসকের আনন্দ। তার হাত হয়ে যখন কোনো রোগীর মুখে হাসি ফুটে, আর কেউ তাদের মতো খুশি হয় না। আবার, যখন শত চেষ্টা সত্বেও রোগীর সেরে উঠা সম্ভব হয় না, তখন সংখ্যায় অল্প এসব চিকিৎসকের মুখেই দেখা যায় রাজ্যের বেদনার ছাপ। এরা অনেকেই বিনামূল্যে গরীব রোগীদের চিকিৎসা করেন। টেস্ট করার জন্য বা ওষুধ কেনার টাকাটাও ব্যয় করেন নিজ পকেট থেকেই। গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে অনেকের সাথেই উঠাবসা আমার। এসব ডাক্তারকে দেখলে আনন্দ লাগে। স্যালুট জানাতে ইচ্ছে করে।
রাফি তেমনই একজন। বয়সে তরুণ, ব্যস্ততায় প্রবীণ। হাসপাতালের ডিউটির সময় পার হয়েছে কখন, কিন্তু রোগী দেখা শেষই হচ্ছে না। একের পর এক রোগী আসছে, হাসিমুখে স্টেথোস্কোপ চেপে প্রেসার পরীক্ষা করছে। জরুরি প্রয়োজনে ছুটে যাচ্ছে কেবিনে, কখনো বা ওয়ার্ডে। কার কি লাগবে, তা নিয়েই তার টেনশন। অফিস শেষ করে ক্লান্ত অনেকটাই। তাকে নিয়ে বের হবো, নাস্তা করবো। ভদ্রলোক আমাকে আড়াই ঘন্টার মতো বসিয়ে রেখেছেন। রোগীদের প্রয়োজন বুঝে বলতেও পারছি না কিছু। আরো কিছুক্ষণ পর, একটু ফুসরত মিললো তার। বের হলাম হাসপাতাল থেকে।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ওষুধ শিল্পের সমস্যা সম্ভাবনা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রায়ই আলাপ হয়। জ্ঞানী মানুষ। অনেক পড়াশোনা তার। আলোচনায় বাদ যায় না পল্লী অঞ্চলের লাউ চাষ থেকে শুরু করে কেন্দ্রের রাজনীতি, সরকার ব্যবস্থাসহ কোনো কিছুই। মজার ব্যাপার হলো, যখনই আমরা কোনো বিষয়ে দ্বিধায় পড়ি, সাথে সাথে আলাপনে মেতে উঠি। কি গভীর রাতের প্রকট ঘুম, কি দিনের ব্যস্ততা!
ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আলাপ চলতে থাকে আমাদের। উঠে আসে চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশাও। প্রায়ই ওষুধের দাম বাড়ে আমাদের এখানে। কিছুটা বিরতি দিয়ে দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয় শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো। যুক্তি দেখানো হয় ‘দাম সমন্বয়ের’। তখন আমরা যারা সাধারণ মানুষ, কিছুই করার থাকে না তাদের। সারা দেশে চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধ জোগান দেয় যেসব কোম্পানি, তারাই হরহামেশা দাম বাড়িয়ে দেয়। দাম বৃদ্ধির তালিকায় জ্বর-সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধও বাদ পড়ে না। আর, নির্ধারিত দামের কয়েকগুণ বেশি দামে ওষুধ বিক্রি তো হয়ই।
অথচ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মূল্য নির্ধারণ কমিটি আছে। স্বাস্থ্য সচিব এ কমিটির সভাপতি। নিয়মিত তদারকির কথা থাকলেও, দায়িত্বপালনে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে এই কমিটি। যারা নিয়মিত ওষুধের দাম পর্যবেক্ষণ করে না। আবার, কখনো কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও, তা নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয় সরকারি এই কমিটি। তবে, ১৯৯৪ সালে জারিকৃত এক সরকারি আদেশে ওষুধের দাম নির্ধারণে কোম্পানিগুলোকে সুযোগ করে দেওয়া হয়। যাকে ব্যবহার করে অনৈতিকভাবে ওষুধের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে কোম্পানিগুলো। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য-১ শাখা থেকে জারি করা আদেশে বলা হয়, ‘তালিকাবহির্ভূত ঔষধসমূহের নির্দেশক মূল্য স্ব স্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করিবে।’ ফলে গেল দুই যুগ ধরে কোম্পানিগুলো যে দাম চাইছে, অধিদপ্তর সেই দামই অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।
ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার বাড়ছে। দেশের বাজেট ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে। আকার বাড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপির। তৃতীয় সারির তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থানও করে নিচ্ছে। কিন্তু, এতসব এই যে প্রবৃদ্ধি, তার সাথে কি পাল্লা দিয়ে নিচে নামছে আমাদের নৈতিকতা! আমরা প্রতিনিয়ত খুচরা কয়েক পয়সা বা টাকার কয়েকটি নোটের জন্য অন্যদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছি। বিপদে ফেলছি দুধের শিশু থেকে শুরু করে অশতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত। হায়! আমাদের উচ্চশিক্ষার হারও বাড়ছে। কিন্তু, নৈতিকতার স্তরকে নিচে নামাতে গিয়ে কি আমরা, চূড়ান্ত সীমারেখাই অতিক্রম করে চলেছি?
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল : shuvro.ju@gmail.com